দস্যু মোহনের কাহিনি সম্পর্কে পরিচিত রসিকতা: মোহন যখন কোনও অনতিক্রম্য পরিস্থিতিতে পড়িত এবং পাঠক রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করিত ইহা হইতে সে মুক্তি পায় কী রূপে তাহা জানিবার জন্য, লেখা থাকিত: তাহার পর কোথা হইতে কী হইয়া যাইল, মোহন মুক্তি পাইল। মানুষের জীবনে অনুরূপ অনুভূতি হয়, যখন সে মধ্যবয়সে আসিয়া পড়ে। এই সেই দিনও সে ছিল যৌবনবান দৃপ্ত আশাময়, অকস্মাৎ কোথা হইতে কী হইয়া যাইল, সে মধ্যবয়সে উপনীত হইল। সে সহস্র অঙ্ক কষিয়াও ভাবিয়া পায় না, কী করিয়া ত্রিশ বৎসর বয়স্ক একটি লোক প্রায় নিশি পোহাইতেই পঞ্চাশের দ্বারে করাঘাত করিতে পারে। এই বয়সে বাধো-বাধো ঠেকিলেও তাহা ন্যাকামি, লাগামছাড়া হইলেও তাহা বোকামি, কিছু না করিয়া থম মারিয়া বসিয়া থাকিলে তাহা মনস্তত্ত্ববিদের নিকট যাইবার যোগ্য বিষণ্ণতা। মধ্যবয়সে মানুষ দিশাহারা হইয়া দেখে, তাহার নিজ শরীর বিদ্রোহ করিতেছে, উপভোগ্য হন্টনটুকু সম্পাদন করিতে জিহ্বা বাহির হইয়া যায়, যে খাদ্যগুলি ছিল আত্মার আরাম আজ তাহা কোলেস্টেরলের ব্যারাম। মনের অবস্থা তো সুবিধার নহেই, মরিচা পড়িয়া মলিন অবসন্ন। তাহার গুরুজনেরা অসুস্থ হইয়া পড়েন ও অনেকেই চিরতরে বিদায় লন, সন্তান ক্রমশ অবাধ্য দুর্বিনীত কর্কশ হইয়া উঠে, সমবয়স্করা সুদূর হইয়া যায়। একটি মার্কিন সমীক্ষা জানাইল, এই সময় তাহার আরও একটি তড়িৎ-আঘাত লাগে, সেই আঘাতে সে বিবশ বিহ্বল হইয়া পড়ে, তাহা হইল ‘ওয়েল্থ শক’, অর্থাৎ, অর্থসম্পদজনিত আঘাত। সহজ কথায়, এই বয়সে আসিয়া সে বুঝিতে পারে, যে অর্থ সে উপার্জন করিতেছে তাহা তাহার জীবন যাপনের পক্ষে যথেষ্ট নহে, যে হারে সে উপার্জন করিয়া চলিতেছে তাহা সহসা না পরিবর্তিত হইলে সে অবশিষ্ট জীবনও স্বাচ্ছন্দ্যে বাঁচিতে পারিবে না। আশ্চর্য হইল, সমীক্ষকদের মতে, এই আঘাত কেবল নিম্নবিত্ত বা মধ্যবিত্তদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নহে, যেমনই আর্থিক অবস্থা হউক, মধ্যবয়সি মানুষের মনে হয়, তাহার অর্থ যথেষ্ট নাই। হয়তো উচ্চবিত্তদের প্রত্যাশা ও সচ্ছলতা-সংজ্ঞা এমনই উচ্চ যে তাহারাও সেই অনুযায়ী আর্থিক হতাশায় আক্রান্ত হয়। ।
যৌবনে মানুষের মনে বিনা কারণেই কিছু স্পর্ধার আধিক্য ঘটে। কোনও যুক্তি ব্যতীতই তাহার মনে হইতে থাকে, তাহার জীবনে বহু ভাল ব্যাপার ঘটিবে। এই সময় সে অর্থ সংগ্রহের পরিকল্পনাকে বেশ উপেক্ষাই করিয়া ফেলে। তাহার মনে হয়, জীবনের অর্থ তো কেবল টাকাপয়সায় আবদ্ধ নাই, সে এই প্রচলিত লোভ ও ক্ষুদ্র চাহিদার ব্যাকরণকে অতিক্রম করিয়া অন্য মার্গে যাইবে। এবং এই সময় প্রণয় তাহার জীবনে বিপুল গুরুত্বপূর্ণ হইয়া উঠে। সে ভাবে, দুইটি মানুষ পরস্পরকে চাহিলে সেই সম্পর্ক সকল দুঃখ সহন ও সকল অহঙ্কার বহন করিতে সমর্থ। তাহার পর ধীরে জীবনের নিত্যপ্রয়োজনগুলি দন্ত বিকশিত করে ও নানাবিধ দায় ও দায়িত্ব আসিয়া তাহাকে ঘিরিয়া ধরে। অস্বীকারের ঔদ্ধত্য ক্রমে শুকাইয়া আসে। মধ্যবয়সে আসিয়া সে অনুভব করে, হয়তো যৌবনের বৎসরগুলি অন্য ভাবে যাপন উচিত ছিল, টাকাপয়সাকে অধিক শ্রদ্ধা করা আবশ্যক ছিল। মহাপুরুষ তো সাধে বলেন নাই, ‘ইয়ুথ ইজ ওয়েস্টেড অন দ্য ইয়াং’! সত্যই, যখন অভিজ্ঞতা আসিয়া মানুষকে বিচক্ষণতা দান করে, তখন তাহার সাহায্যে জীবন চালনা করিবার সময় ফুরাইয়া আসে, প্রাণশক্তিও টোল খাইয়া যায়।
কিন্তু বহু মানুষ থাকে, যাহারা মধ্যবয়সে আসিয়া অন্য সঙ্কটের মুখোমুখি হয়। তাহারা সহসা দেখে, জীবনটি যে উদ্দেশ্যে ব্যয় করিবার কথা ছিল, বিভিন্ন চিত্তবিক্ষেপে তাহা আদৌ ঘটে নাই, ক্ষুদ্র অকিঞ্চিৎকর প্রথাগুলি পালন করিতেই সময় চলিয়া গিয়াছে। তখন সে সকল হিসাব ভাসাইয়া, সাংসারিক দায়িত্বকে উপেক্ষা করিয়া, কেবল নিজ মনচ্ছবি অনুসরণ করিয়া নূতন স্রোতে ঝাঁপাইয়া পড়ে। অবশিষ্ট জীবনকে ঈপ্সিত জীবনে রূপান্তরিত করিতে চাহে। ইহাও এক ধরনের আঘাতজনিত প্রতিক্রিয়া— সম্পদেরই আঘাত, তবে তাহা বস্তুগত নহে, অন্তরসম্পদের। এই সকল সিদ্ধান্ত সর্বদা বুদ্ধিসমর্থিত নহে, এমনকী নীতিসম্মতও নহে, বহু ক্ষেত্রেই এইগুলিকে পরে হঠকারিতা বলিয়া চিনিয়া লওয়া যায়। মধ্যবয়সে নিজেকে বঞ্চিত মনে হইবার উপসর্গও সর্বদা মহৎ নিরাময়ের জন্ম দেয় না। কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে ইহা আশ্চর্য উৎপাদন করে, এবং সেই জন্যই মানুষ সমীক্ষার ঊর্ধ্বে বিচরণকারী প্রাণী।
যৎকিঞ্চিৎ
‘কালো? তা সে যতই কালো হোক, দেখেছি তার হরিণী নির্মোক’ গেয়ে যে বীরপুরুষ হরিণকে বিঁধলেন, তাঁকে কোথায় সুপার-ব্যাধের সম্মান দেওয়া হবে, তা না, দোষী বলা হচ্ছে! ব্যাধেরা প্রাণী মারে, তা দেখে কারও হৃদয় দ্রব হয়ে শ্লোক উৎসারিত হয়, তবে তো মহাকাব্য রচিত হয়। এই রামায়ণের ভূমি বুঝতে পারল না, নিজের প্রাণ ও ইমেজের ঝুঁকি নিয়ে আত্মত্যাগী ভালমানুষটি এ কাজ করেছেন, যাতে কেউ এই উপাদান চিত্রনাট্যে লাগায়, আর বক্সঅফিসধন্য মহাসিনেমা উৎপন্ন হয়!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy