Advertisement
E-Paper

একা হাতে স্কুলের ভোল বদলেছেন ‘মাস্টারমশাই’ ফুটবল

মানুষ গড়ার ব্রতে পিছিয়ে পড়া আস্ত একটা স্কুলকেই নতুন ভাবে গড়ে তুলেছেন শিক্ষক পার্থপ্রদীপ সিংহ। বহু সম্মান, স্বীকৃতি তাঁর ঝুলিতে। লাভপুরের এই কৃতীর সঙ্গেই কথা বললেন অর্ঘ্য ঘোষ।শিক্ষা দফতর এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে কালিকাপুরডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামটার বছর কয়েক আগেও কোনও বিশেষত্ব ছিল না। আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামের ওই স্কুলটি জেলার আর পাঁচটি প্রাথমিক স্কুলের থেকে একেবারেই আলাদা ছিল না।

শেষ আপডেট: ০৪ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:১৮
পার্থবাবুর কাছে বর্ণ পরিচয় পাঠ কালিকাপুরডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের। ছবি: কল্যাণ আচার্য

পার্থবাবুর কাছে বর্ণ পরিচয় পাঠ কালিকাপুরডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পড়ুয়াদের। ছবি: কল্যাণ আচার্য

প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বভার নিয়েই প্রতিকূলতার মুখোমুখি পড়তে হয়েছিল। সেই ঝড় সামলে বদলে দিয়েছিলেন স্কুলের পরিকাঠামোটাই। তারই স্বীকৃতি স্বরূপ শিক্ষারত্ন এবং জাতীয় পুরস্কারের শিরোপা। লাভপুরের কালিকাপুরডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পার্থপ্রদীপ সিংহকে এলাকার সবাই একডাকে চেনেন ‘মাস্টারমশাই’ নামে।

শিক্ষা দফতর এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে কালিকাপুরডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নামটার বছর কয়েক আগেও কোনও বিশেষত্ব ছিল না। আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রামের ওই স্কুলটি জেলার আর পাঁচটি প্রাথমিক স্কুলের থেকে একেবারেই আলাদা ছিল না। আর এখন ভোল বদলে ওই স্কুলটিই নজর কেড়েছে বীরভূমে।

গ্রামে ঢোকার রাস্তার এক দিকে প্রাচীর ঘেরা দোতলা স্কুলবাড়ি। আর এক দিকে মিড ডে মিল রান্না, খাওয়া, শৌচাগার, ফুলবাগান, খেলার জায়গা। সব যেন ছবির মতো সাজানো। স্কুলে ঢোকার মুখে ছোট ছোট পায়ের জুতো সারিবদ্ধভাবে রাখা। প্রতিটি ক্লাসঘরে পরিশ্রুত পানীয় জলের ব্যবস্থা। অফিসঘরে সাজানো বইয়ের আলমারি। ছোটখাটো একটা পাঠাগারই বলা চলে। আরেকটি আলমারিতে নাটকের পোশাক, মুখোশ সযত্নে রাখা। কম্পিউটার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও রয়েছে সরকারি এই প্রাইমারি স্কুলে। লেখাপড়ার ফাঁকে শিক্ষামূলক তথ্যচিত্র দেখানোর ব্যবস্থাও আছে এই স্কুলে। দোতলার হলঘরে ছাত্রছাত্রীদের আঁকা ছবির আর্ট গ্যালারি। ছাদে আধুনিক বৈদ্যুতিন ব্যবস্থায় ছাত্রছাত্রীদের গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান দেখানোর জন্য কৃত্রিম সৌরজগত। অন্যদিকে, পরিচ্ছন্ন রান্নাঘর, খাওয়ার জন্য প্রতিটি পড়ুয়ার নিজস্ব থালা, বাটি, গ্লাস। পড়ুয়াদের উচ্চতা অনুযায়ী তিনটি তিন উচ্চতার হাত মুখ ধোওয়ার বেসিন। খাওয়ার আগে সবাই নিয়ম করে লাইনে দাঁড়িয়ে সাবান দিয়ে হাত ধোয় এখানে। বেসিনের ব্যবহৃত জল পাইপের মাধ্যমে গিয়ে পড়ে লাগোয়া ফুলের বাগানে। সেখানে সারা বছরই ফোটে নানা মরসুমি ফুল। পাশেই ছেলে এবং মেয়েদের তিনটি করে শৌচাগার। খেলার জন্য স্লিপার, দোলনা, মানুষের ক্রমবিবর্তনের স্ট্যাচু, সংস্কৃতি মঞ্চ। স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ৯৮ জন। গড় হাজিরা ৯০ শতাংশ। এক ঝলকে এটাই এখনকার কালিকাপুরডাঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছবি। অথচ বছর দশেক আগের ছবিটা এমন ছিল না। ওই গ্রামের লক্ষ্মী মুর্মু, মঙ্গলা হাঁসদারা দিনমজুরী করে সংসার চালান। নিজেরা কাজে বেরিয়ে যাওয়ার পরে ছেলে মেয়েরা স্কুলে গেল কী না তা দেখার ফুরসতই মিলত না। ‘‘কিন্তু মাস্টারমশাই স্কুলের দায়িত্ব নেওয়ার পর পড়ুয়ারা না গেলে তিনিই বাড়ি বয়ে এসে ধরে নিয়ে যান। অভিভাবকদের কথা বলার সুবিধার জন্য তিনি আদিবাসী ভাষাও শিখেছেন। মাস্টারমশাই এখন আমাদের অভিভাবক।’’ — লক্ষ্মী, মঙ্গলাদের গলায় সম্ভ্রম ঝরে পড়ে।

তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র বুদ্ধিনাথ হেমব্রম, মোড়ল সোরেন, চতুর্থ শ্রেণির রাখী টুডু, মানসী সোরেনদের কথায়, ‘‘মাস্টারমশাই আসার পরে আমরা আর স্কুল কামাই করি না। শুধু লেখাপড়া নয়, খেলা, গল্প, খাওয়া দাওয়া কত রকম মজা হয় এখন স্কুলে।’’ শুধু পড়ুয়ারাই নয়, অভিভাবকেরাও সামিল হয়েছেন স্কুলের নানা কাজে। স্কুলের উন্নয়নে গ্রামবাসীদেরও সামিল করেছেন পার্থবাবু নিজেই। ফাল্গুনী সোরেন, বলাই মুর্মরা বলেন, আগে গ্রামে ৫/৬টি সরস্বতী পুজো হতো। মাস্টারমশাই সবাইকে নিয়ে স্কুলে ধুমধাম করে সরস্বতী পুজো শুরু করেন। সবাই এখন সেই পুজোতেই ব্যস্ত থাকে। তাতে অনেক টাকা সাশ্রয় হয়। সেই টাকায় ছেলে মেয়েদের সঙ্গে আমরাও নাটক, নাচ, নানা রকম আদিবাসী অনুষ্ঠান করি। একসঙ্গে খাওয়াদাওয়া হয়। আর কিছু টাকা থাকলে তা স্কুলের উন্নয়নের কাজে লাগানো হয়। ২০১৬ সালে ২৫ সদস্যের শিক্ষা পরিদর্শক প্রতিনিধিদল এসেছিলেন এই স্কুলে। তাঁরাও অবাক হয়েছিলেন ওই অঞ্চলে এমন নজিরবিহীন স্কুল গড়ে ওঠায়। ওই স্কুলের শিক্ষিকা বীথিকা মণ্ডল, শ্যামলী আচার্যরাও স্বীকার করেন, ‘‘পার্থবাবুর চেষ্টাতেই আমাদের স্কুল আজ সবার নজর কেড়েছে।’’

খুব সাধারণ পরিবারে জন্ম এই জাতীয় শিক্ষকের। বাবা আনন্দদুলাল সিংহ ছিলেন লাভপুর শম্ভুনাথ কলেজের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী। লাভপুরের ভালাস গ্রামে বৃদ্ধা মা স্বর্ণময়ীদেবী থাকেন। কিছুটা দূরে বিরামমন্দির পল্লিতে স্ত্রী, ছেলে, মেয়েকে নিয়ে থাকেন পার্থবাবু। ছেলে নীলাঞ্জন অসুস্থ। মাধ্যমিকের বেশি পড়া হয়নি তার। মেয়ে পৃথা দশম শ্রেণিতে পড়ে। বাবার কর্মস্থল যে কলেজে সেখান থেকেই পদার্থ বিদ্যার স্নাতক হন। শিক্ষকতার শুরুতে ১৯৯৫ সালে লাভপুরের মানপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগ দেন। ২০০৪ সালে প্রধান শিক্ষক হন স্থানীয় দুবসা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। সেখান থেকে ২০০৯ সালে কালিকাপুরডাঙা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন তিনি। তাঁর কথায়, ‘‘স্কুলের পরিবেশ, এখানকার মানুষজন, আদিবাসী সমাজই আমার মনকে বলেছিল এখানে আমার মানুষ গড়ার কাজ।’’ সেই কাজেরই স্বীকৃতিস্বরূপ ২০১৬ সালে রাজ্য সরকারের কাছে থেকে পেয়েছেন শিক্ষারত্ন পুরস্কার। ২০১৭ সালে মিলেছে জাতীয় পুরস্কার। নজরুল মঞ্চে রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর হাতে শিক্ষারত্ন পুরস্কার তুলে দেন। দিল্লির বিজ্ঞানভবনে জাতীয় পুরস্কার তুলে দেন উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু। সেই দুটি দিনের কথা তাঁর স্মৃতিতে এখনও উজ্বল। পার্থবাবুর সহকর্মীদের কথায়, ‘‘নিজের প্রাপ্য সম্মান উনি পেয়েছেন। কিন্তু পুরস্কারের টাকার সিংহভাগই খরচ করেছেন স্কুলের জন্য। স্কুলের ছাদে কৃত্রিম সৌরজগৎ তৈরি এবং মানুষের ক্রম বিবর্তণের ছবিটা ছাত্রদের বোঝানোর জন্য যাবতীয় আয়োজন করেছেন।’’

শুধু শিক্ষারত্ন বা জাতীয় পুরস্কারই নয়, ২০১৮ সালে দিল্লির ইন্টারন্যাশানাল পাবলিশিং হাউস অমিতাভ বচ্চন, মীরাকুমার, মহেন্দ্র সিংহ ধোনির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশের ১৪২ জন কৃতি মানুষের মধ্যে পার্থবাবুকেও বেস্ট সিটিজেন অফ ইন্ডিয়া অ্যাওয়র্ড দিয়েছে। শুধু শিক্ষাক্ষেত্রেই নয়, সাংস্কৃতিক জগতেও পার্থবাবুর অবাধ বিচরণ। এলাকায় নাট্যকর্মী হিসাবেও তাঁর যথেষ্ট পরিচিতি আছে। ‘দিশারী সাংস্কৃতিক চক্র’ নামে একটি নাটকের দলও গড়েছেন তিনি। ২৫ বছরের ওই নাট্যদলের বিশেষত্ব শুধুমাত্র কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিভিন্ন কাহিনীর নাট্যরূপকে মঞ্চস্থ করা। একই সঙ্গে ‘মঞ্জরী’ নামে কচিকাঁচাদের নাচ, গান, আবৃত্তি, নাটক, আঁকা শেখার একটি সংস্থাও আছে তাঁর। সেখানে মাসিক ১০ টাকা বেতনে ১৫০ জন শিক্ষার্থী প্রশিক্ষণ নেয়।

পার্থবাবু বলেন, ‘‘স্কুলের উন্নয়নে সবাইকে সামিল করতে পেরেছিলাম বলেই কাজটা সহজ হয়েছে। তাই স্বীকৃতিটা গ্রামের মানুষজনেরও প্রাপ্য।’’ পার্থবাবুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ জেলা স্কুলবোর্ডের চেয়ারম্যান রাজা ঘোষও। তিনি বলেন, ‘‘পার্থবাবু এলাকার মানুষকে দেখিয়ে দিয়েছেন সরকারি প্রতিষ্ঠানকে নিজের ভাবতে পারলে কী হয়। সত্যিই তিনি কৃতী মানুষ। তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ যোগ্য।’’

School Teacher Infrastructure
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy