Advertisement
০৩ ডিসেম্বর ২০২৩
Justin Trudeau

অন্যায় অভিযোগ

গণতান্ত্রিক দেশ কানাডায় যে কোনও ব্যক্তি তাঁর নিজের মত ও পথ প্রচার করতে পারেন, এমনকি অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও হয়তো তা করতে পারেন।

কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো।

শেষ আপডেট: ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৩ ০৬:২১
Share: Save:

ভারতের বর্তমান বিদেশ মন্ত্রক যখন অন্য রাষ্ট্রের বা রাষ্ট্রগোষ্ঠীর প্রতি বার্তা দিতে ভারতের রাষ্ট্রীয় স্বার্থ, সার্বভৌমতা ইত্যাদি নিয়ে উঁচু গলায় কথা বলে, তখন অনেক সময়ে তাতে জাতীয়তাবাদের একটা কড়া অনুপান থাকে, যেটা সহজপাচ্য নয়। সাম্প্রতিক অতীতে বিবিসি থেকে শুরু করে ইইউ-এর বৈঠকে মণিপুর মন্তব্য, নানা পরিস্থিতিতে এই অতিজাতীয়তাবাদ দেখা গিয়েছে। কিন্তু সম্প্রতি কানাডার প্রধানমন্ত্রী ট্রুডোর প্রতি যে বার্তা কড়া ভাষায় ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক থেকে ধ্বনিত হল, তার মধ্যে জাতীয়তাবাদের পরিমাণ মাত্রাধিক বলা যাবে না, বরং তা যথার্থ মাত্রাতেই বিদ্যমান। সত্যিই, যে ভাবে কানাডা ভারতের বিষয়ে অন্যায়, প্রায় অভূতপূর্ব অভিযোগ নিয়ে এসেছে— তার কঠোর সমালোচনা জরুরি ছিল, জরুরি ছিল আন্তর্জাতিক মহলে কানাডার এই অন্যায় আচরণ প্রকাশ্যে সমালোচনা করার। দিল্লি সেটা করেছে, অন্তত চেষ্টা করেছে। দুই দেশের মধ্যে যদি এমন কোনও সঙ্কটের জায়গা থাকে, তা হলেও প্রকাশ্য ভাবে রাষ্ট্রীয় স্তরে এমন মন্তব্য করা শোভন বা শালীন নয়, বুদ্ধির পরিচয়ও নয়। তদুপরি, সত্যিই এই অভিযোগ কতখানি তথ্যানুগ, তা নিয়েও সংশয়ের বিস্তর কারণ। সব মিলিয়ে এই মুহূর্তে ভারত-কানাডা দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক অতীব সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত যা করেছে, অধিকাংশ আত্মমর্যাদাময় রাষ্ট্রই এই পদক্ষেপ করতে বাধ্য হত।

বস্তুত ট্রুডো নিজের দেশের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে সরাসরি ভারতীয় সরকারের সঙ্গে হরদীপ সিংহ নিজ্জরের হত্যার সম্পর্ক বিষয়ে যে ভাবে ‘নির্ভরযোগ্য’ তথ্যের ভিত্তিতে ভারতের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করলেন, তা কিন্তু ভারতের উপর কূটনৈতিক আক্রমণের পর্যায়ে পড়ে। তাঁকে একটিই প্রশ্ন করার— এত ‘নির্ভরযোগ্য’ প্রমাণ তিনি পেলেন কোথায়। বিভিন্ন রাজনৈতিক ‘লবি’র চাপে অপ্রমাণিত সংবাদের ভিত্তিতে এত বড় অভিযোগ কী করে তুলল অটাওয়া? বুঝতে কি অসুবিধা আছে যে, সাততাড়াতাড়ি কূটনৈতিক রীতিনীতি লঙ্ঘন করে এই আক্রমণাত্মক বার্তা প্রেরণ আসলে নিজের দেশে খলিস্তানি ভাবাপন্ন ভারতীয় বংশোদ্ভূত অভিবাসী সমাজের রাজনৈতিক তাড়নার ফল? বহু কাল ধরেই এই গোষ্ঠী সে দেশে বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন। এখন শাসক নেতা তাদের তুষ্ট করার আপ্রাণ সাধনায় ব্রতী হয়েছেন। উল্টো দিকে এই চরমবাদী গোষ্ঠী কানাডায় সক্রিয় থেকে যে ভাবে ভারতের মধ্যে বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তিকে পূর্ণ সহায়তা দিচ্ছে— তা নিয়ে ভারত সরকারের একটি বার্তাতেও কানাডা সরকার কান দেয়নি। গণতান্ত্রিক দেশ কানাডায় যে কোনও ব্যক্তি তাঁর নিজের মত ও পথ প্রচার করতে পারেন, এমনকি অন্য রাষ্ট্রের বিরুদ্ধেও হয়তো তা করতে পারেন। মতপ্রকাশের স্বাধীনতার নীতি লঙ্ঘন করে এই ধারাকে থামানো হয়তো সম্ভব নয়, কিন্তু তাই বলে জরুরি ভোটব্যাঙ্ক হিসাবে গণ্য এই মতপ্রকাশকারীদের সন্তোষবিধানের জন্য এই অপপ্রচারে সরকারি স্বীকৃতির সিলমোহর দেওয়া? ট্রুডোর মনে রাখা উচিত ছিল, তিনি কোনও ক্লাবের নেতা নন। একটি বৃহৎ, অতি গুরুত্বপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রধান তিনি, যিনি কথা বলছেন অন্য একটি বৃহৎ নাতিসামান্য গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র সম্বন্ধে।

বিপরীতে, দিল্লির প্রতিক্রিয়া জরুরি এবং সমর্থনযোগ্য ঠেকলেও একটি আশঙ্কা রয়েই যাচ্ছে। দুই দেশে অতি দ্রুত নিজেদের সম্পর্কসূত্র ঢিলা করতে ব্যস্ত, দ্বিপাক্ষিক বোঝাপড়া টেনে নামিয়ে সফর-কামী নাগরিকদের ভিসা বাতিল করতে, বা ভিসা আদৌ না দিতে ব্যস্ত। কূটনীতিতে যে তিক্ততাই হয়ে থাক না কেন, এ ভাবে মানুষের যাতায়াত ও আদানপ্রদানে বাধাদান আধুনিক বিশ্বের ধরনধারণের সঙ্গে মোটেই খাপ খায় না। বিশেষত ভারতের যখন উন্নত দেশগুলির সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে নিজের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক স্বার্থসাধনের দায় এত তীব্র, তখন এই প্রতিক্রিয়া আত্মঘাতী হয়ে উঠতে পারে। সে দিকটিও ভেবে দেখা দরকার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement

Share this article

CLOSE