Advertisement
০১ নভেম্বর ২০২৪
Lok Sabha Election 2024

বিতর্কের আহ্বান

কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বিতর্কে সম্মতি জানানোর সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি নেত্রী স্মৃতি ইরানি বিদ্রুপের বাণ ছুড়লেন, রাহুল কে? তিনি কি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’-র তরফে প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার বলে নির্ধারিত হয়েছেন?

(বাঁ দিকে) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী।

(বাঁ দিকে) প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী। —ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ১৬ মে ২০২৪ ০৭:৩৫
Share: Save:

গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা যে বিতর্ক, সে কথা রাজনৈতিক নেতাদের স্মরণ করাতে হল নাগরিক সমাজকে। দুই অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এবং এক বর্ষীয়ান সাংবাদিক একটি চিঠি লিখে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধীকে অনুরোধ করলেন, তাঁরা জনসমক্ষে বিতর্কে আসুন। প্রস্তাবটি গুরুত্বপূর্ণ। গণতন্ত্র-নির্দিষ্ট পথে রাজনীতি চালাতে হলে বিতর্ক অপরিহার্য। কিন্তু সে অভ্যাস বহু দিন আগেই ছুটে গিয়েছে ভারতের শাসকদের। ফলে কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী বিতর্কে সম্মতি জানানোর সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি নেত্রী স্মৃতি ইরানি বিদ্রুপের বাণ ছুড়লেন, রাহুল কে? তিনি কি বিরোধী জোট ‘ইন্ডিয়া’-র তরফে প্রধানমন্ত্রিত্বের দাবিদার বলে নির্ধারিত হয়েছেন? এই প্রশ্নটি কেবল অপমানজনক নয়, ভুল। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিতর্কে অবতীর্ণ হতে পারেন যে কোনও নাগরিক। যিনি প্রশ্ন করতে আগ্রহী, তিনিই যোগ্য। প্রধানমন্ত্রিত্বের দীর্ঘ দশ বছরে যে মোদী যে সাংবাদিকদের প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়েছেন, এমনকি সংসদেও বিতর্কে যোগ দেননি, দলের ভিতরে এবং বাইরে তাঁর কাজ নিয়ে প্রশ্ন তোলার মানুষদের সর্বশক্তিতে প্রতিহত করেছেন, এটা ভারতবাসী মোদীর অযোগ্যতা বলেই গণ্য করে। প্রশ্নকারীর বিরুদ্ধে আক্রমণের রাজনীতি থেকে ভারতবাসী একটি নতুন শব্দ শিখেছে— ‘হোয়াট-অ্যাবাউটারি।’ অর্থাৎ, অমুক প্রশ্ন করার সাহস পায় কী করে, সে (অথবা তার দল, তার ধর্ম-জাত-ভাষার লোক) তো অতীতে এই দুষ্কর্ম করেছে। সেই ‘দুষ্কর্ম’ ঠিক কী যুক্তিতে প্রশ্নকর্তাকে ‘অযোগ্য’ প্রমাণ করে, তার ব্যাখ্যা মেলে না। কিন্তু বিতর্কে অবতীর্ণ হওয়ার দায় থেকে বাঁচায় শাসককে। টিভি চ্যানেলগুলির কল্যাণে এই কৌশলের অবিরাম প্রয়োগ ভারতে গণতন্ত্রের চর্চাকে দুর্বল করেছে।

তা সত্ত্বেও যে বিতর্কের দাবি উঠছে, তা প্রমাণ করে যে, রাজনৈতিক বিরোধী ও নাগরিক সমাজের উপর নিরন্তর দমন-পীড়ন চালিয়েও গণতন্ত্রকে নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। বুলডোজ়ারের মুখে ছাই দিয়ে বাক্‌স্বাধীনতা বেঁচে-বর্তে আছে, এত জেল-জরিমানার পরেও বিতর্কের দাবি তুলছে। অমর্ত্য সেন তাঁর ‘সংবাদমাধ্যম ও উন্নয়ন’ নিবন্ধে সংবাদের স্বাধীনতার যে চারটি প্রয়োজনের কথা বলেছিলেন, তা প্রয়োগ করা যায় বিতর্কের ক্ষেত্রেও। প্রথমত, বিতর্কে লাভ হোক না হোক, গণতন্ত্রে বিতর্কের নিজস্ব মূল্য রয়েছে। বিতর্কের অভ্যাস ও আগ্রহ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ গড়ে দেয়। দ্বিতীয়ত, বিতর্কের মাধ্যমেই প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া সম্ভব। নাগরিক সমাজের তিন প্রতিনিধি যথার্থই বলেছেন যে, নির্বাচনী বন্ড, সংবিধানের উপর আক্রমণ, চিনের প্রতি ভারতের নীতি, এই বিষয়গুলি নিয়ে কংগ্রেসের মল্লিকার্জুন খড়্গে যে প্রশ্নগুলি তুলেছেন, তার উত্তর দেশবাসী পায়নি। তেমনই, সংরক্ষণ, ৩৭০ ধারা কিংবা সম্পদ বণ্টন নিয়ে কংগ্রেসের অবস্থান বিষয়ে মোদী প্রশ্ন তুলেছেন, কিন্তু কংগ্রেস উত্তর দেয়নি। অথচ, এই বিষয়গুলিতে দুই প্রধান দলের অবস্থান কী, তা না জানলে দেশবাসী সিদ্ধান্ত নেবেন কিসের ভিত্তিতে?

অন্যের সমালোচনার মুখোমুখি হয়ে সরকার যে নিজেকে সংশোধন করতে বাধ্য হয়, এ হল বিতর্কের তৃতীয় প্রয়োজন। আজ ভারতের রাজনৈতিক দলগুলি শাসকের প্রতি প্রশ্নকে দেশের নিরাপত্তা বা সম্মানের উপর আঘাত বলে দেখাতে চায়। প্রকৃত পক্ষে বিতর্কে শাসকের প্রতিপক্ষ জনসাধারণের স্বার্থকে সুরক্ষিত করে। সর্বোপরি, বিতর্কের মাধ্যমেই তৈরি হয় সহমতের জমি। এ কথাগুলি জনসাধারণ বোঝে, কিন্তু শাসক জেনেবুঝেও অবজ্ঞা করে। তাই সংসদ-বিধানসভাগুলি বিতর্কহীনতায় পর্যবসিত হয়েছে, নির্বাচনী প্রচার কেবল বিপক্ষের প্রতি অপশব্দ বর্ষণে, নিন্দা ও অনাস্থার প্রদর্শনে পরিণত হয়েছে, সরকারের বিরোধিতাকে ‘দেশদ্রোহ’ বলে দেখানো হচ্ছে। এই পরিস্থিতি থেকে ভারতের গণতন্ত্রকে উদ্ধার করতে হলে দরকার বিভিন্ন দলের নেতাদের মধ্যে শ্রদ্ধাশীল, সৌজন্যপূর্ণ বিতর্ক।

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE