কর্তৃত্ববাদী শাসনের একটি নির্ভুল অভিজ্ঞান হল তথ্য গোপন করার প্রবণতা। প্রতীকী ছবি।
একটি পুরনো, সম্ভবত অতিরঞ্জিত, গল্প দিয়েই শুরু করা যাক। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার এক বড়কর্তার ডাক পড়ল জোসেফ স্তালিনের অফিসে। স্তালিন জানতে চান, এ বছর অর্থব্যবস্থার বৃদ্ধির হার কত হবে? বড়কর্তা গলাটা একটু নামিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করলেন, “আজ্ঞে, আপনি কত চান?” গল্পের অতিরঞ্জনের দুধটুকু সরিয়ে রাখলে যে জল পড়ে থাকে, দুনিয়া জুড়ে একনায়কতন্ত্রী, কর্তৃত্ববাদী শাসকের রাজত্বে সেই জল বহুধারায় প্রবাহিত হয়েছে। কর্তৃত্ববাদী শাসনের একটি নির্ভুল অভিজ্ঞান হল তথ্য গোপন করার প্রবণতা। কিন্তু, সে কথাটি নিশ্চিত করে জানার পক্ষে একটি মস্ত বাধা রয়েছে— কর্তৃত্ববাদী শাসন! সে লৌহ যবনিকা ভেদ করে কখনওসখনও তথ্য মুক্ত দুনিয়ায় পৌঁছতে পেরেছে বটে, কিন্তু তার জন্য কখনও অপেক্ষা করতে হয়েছে সমাজতন্ত্রী সাম্রাজ্যের পতনের জন্য, কখনও বা বিপুল দুর্ভিক্ষের জন্য। এ শুধু গত শতকের আখ্যান নয়, এখনও দুনিয়ার যে প্রান্তেই গণতন্ত্রে ঘাটতি আছে, সেখানেই তথ্য অপ্রতুল। ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোর অর্থনীতিবিদ লুইস মার্টিনেজ় সেই লৌহ যবনিকা ভেদ করার পথ দেখালেন।
বলা যেতেই পারে যে, মার্টিনেজ় মহাকাশ থেকে, রাতের অন্ধকারে, রহস্য ভেদ করেছেন। গত এক দশকে উপগ্রহ থেকে তোলা রাতের আলোর ছবি ব্যবহার করে অর্থব্যবস্থার মাপজোখের একটি পদ্ধতি ক্রমেই জনপ্রিয় হয়েছে। ২০১২ সালে ব্রাউন ইউনিভার্সিটি ও ন্যাশনাল বুরো অব ইকনমিক রিসার্চ-এর তিন গবেষক হেন্ডারসন জে ভার্নন, অ্যাডাম স্টোরিগার্ড ডেভিড এন ওয়েইল এক গবেষণাপত্রে দেখান যে, উপগ্রহ চিত্র থেকে রাতের আলোর তীব্রতা বিচার করে কোনও দেশের অর্থনৈতিক আয়তন সম্বন্ধে যথেষ্ট বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া যেতে পারে। পদ্ধতিটি জটিল, কিন্তু তার অন্তর্নিহিত যুক্তিক্রম সহজবোধ্য। অর্থব্যবস্থা যত সমৃদ্ধ হবে, কোনও দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ততই বাড়বে, এবং তা কেবল দিনে নয়, রাতেও চলতে থাকবে। অর্থাৎ, রাতে আলোর ব্যবহার বাড়বে। আধুনিক উপগ্রহ চিত্রে ধরা পড়ে সেই আলোর তীব্রতা। মার্টিনেজ় এই পদ্ধতিটিই ব্যবহার করেছেন আর্থিক বৃদ্ধির হার যাচাইয়ের কাজে। কোনও নির্দিষ্ট দেশের জন্য নয়, গোটা দুনিয়ার জন্য। তাঁর কাজের বৈশিষ্ট্য হল, তিনি দুনিয়ার দেশগুলির শ্রেণিবিভাজন করেছেন গণতন্ত্রের জোর অনুসারে— এবং তার পর দেখেছেন, যে দেশে গণতন্ত্রের ঘাটতি রয়েছে, সে দেশে কি আর্থিক তথ্যে জলের পরিমাণ বেশি হয়? দেখার পদ্ধতিটিও সহজ— দেশের সরকার কোনও একটি নির্দিষ্ট সময়কালে দেশের আর্থিক বৃদ্ধি সম্বন্ধে যে পরিসংখ্যান দিয়েছে, তিনি মিলিয়ে দেখেছেন, সেই একই সময়কালে সে দেশে রাতের আলোর তীব্রতার বৃদ্ধির হার তার সঙ্গে সমানুপাতিক কি না। ফলাফলটি প্রত্যাশিত, এবং একই সঙ্গে তাৎপর্যপূর্ণ— দেখা গিয়েছে, যে দেশগুলি গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে ‘ফ্রি’ বা ‘মুক্ত’, সেখানে এক বছরে আলোর তীব্রতা ১০% বাড়লে জিডিপি-র পরিমাণ বেড়েছে ২.৪ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু সেই একই সময়কালে গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে ‘অ-মুক্ত’ দেশে ১০% আলোর তীব্রতা বাড়লে জিডিপি বেড়েছে ২.৯ থেকে ৩.৪%।
পদ্ধতিটি আপাতদৃষ্টিতে এমনই সরল যে, প্রশ্ন উঠতেই পারে— কর্তৃত্ববাদী শাসনে কি এমন কিছু ঘটে, যার ফলে আলোর তীব্রতার সঙ্গে জিডিপি-র সম্পর্কটি ‘মুক্ত’ দুনিয়ার চেয়ে পৃথক? মার্টিনেজ় বিভিন্ন দিক থেকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছেন— অর্থব্যবস্থার গঠন, নগরায়ণের চরিত্র ইত্যাদিকে ‘কন্ট্রোল’ করে, অর্থাৎ এই বিষয়গুলির জন্য আলোর তীব্রতায় যে পার্থক্য হতে পারে, তাকে হিসাবের মধ্যে রেখেও দেখেছেন, এই ফারাকের ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না। বরং, অন্য কিছু বিষয় ফলাফলের উপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব ফেলছে— দেশে প্রকৃত অর্থে স্বাধীন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও বিচারবিভাগীয় প্রতিষ্ঠান রয়েছে কি না। দেখা যাচ্ছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধীনতায় ঘাটতি থাকলেই আলোর উজ্জ্বলতার সঙ্গে অর্থনৈতিক বৃদ্ধির হারের অমিলের পরিমাণ বাড়ছে। অগণতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদী শাসক যে তথ্য গোপন করেন, এই জানা কথাটির আরও এক দফা প্রমাণ দেওয়া মার্টিনেজ়ের এই গবেষণার মূল কথা। কিন্তু, এখান থেকে একটি অন্য কথাও কি শিখে নেওয়া যায় না— চেনা ছকের বাইরে বেরিয়ে ভাবতে পারলে, পৃথিবীটাকে খোলা চোখে দেখতে পারলে নতুন পথের সন্ধান পাওয়া সম্ভব। এমন পথ, কোনও লৌহ যবনিকাই যাকে রুদ্ধ করতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy