E-Paper

গণনার ফাঁদ

সরকারি যুক্তি: জাতগণনার বিষয়টি অত্যধিক জটিল, তাই এখন অসম্ভব। যুক্তিটি ফেলনা নয়, কিন্তু অসঙ্গত। জটিল কাজও অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় অনেক সময়ে।

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০২৩ ০৬:২৯
An image representing Caste Discrimination

জাতগণনার সঙ্গে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের সংযোগটি স্পষ্ট ভাবে মণ্ডল-পরবর্তী ভারতে প্রতিষ্ঠিত। প্রতীকী ছবি।

আপেক্ষিকতা একটি মহাসত্য। তাই কেউ ভাবতে পারেন, বিরোধী থাকার সময়ে ভারতীয় জনতা পার্টি জাতভিত্তিক জনগণনার বিশেষ সমর্থক ছিল, এখন আর নেই— এ কেবল তার অবস্থানে আপেক্ষিক পরিবর্তনের ফল। বাস্তবে কিন্তু বিষয়টি এত সরল নয়। স্মরণ করা প্রয়োজন, কেবল ২০১০ সালেই বিজেপি জাতগণনার সরব সমর্থক ছিল না, ২০১৮ সালেও ছিল। ২০১৯ সালের জাতীয় নির্বাচন আসার কয়েক মাস আগে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ বেশ জোর গলায় জাতগণনার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন। সংসদে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করেছিলেন যে, ২০২১ সালের শেষে অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়া যাবে এর মাধ্যমে। চক্রটি একশো আশি ডিগ্রি ঘুরে জাতগণনা-বিরোধিতায় এসে পৌঁছেছে গত দুই বছরে— নরেন্দ্র মোদী সরকার এখন জাতগণনা আটকাতে বদ্ধপরিকর। বিরোধী দলগুলি এ নিয়ে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। তারা সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির প্রয়াসী। তবে কিনা, সাম্প্রতিক ভারতে বিরোধী ক্ষোভ-বিক্ষোভের কর্মসূচির দৌড় যতটা দেখা গিয়েছে, তাতে ধরে নেওয়া যেতে পারে, ২০২১ সালের সেই যে অসংঘটিত জাতগণনা, ২০২৪ সালের নির্বাচনের আগে ও পরে তা ঘটার সম্ভাবনা ক্ষীণ, অতি ক্ষীণ।

সরকারি যুক্তি: জাতগণনার বিষয়টি অত্যধিক জটিল, তাই এখন অসম্ভব। যুক্তিটি ফেলনা নয়, কিন্তু অসঙ্গত। জটিল কাজও অবশ্যকর্তব্য হয়ে দাঁড়ায় অনেক সময়ে। জাতগণনার সঙ্গে আর্থ-সামাজিক বৈষম্য দূরীকরণের সংযোগটি স্পষ্ট ভাবে মণ্ডল-পরবর্তী ভারতে প্রতিষ্ঠিত। মণ্ডল কমিশন উনিশশো নব্বইয়ের দশকে যে সব প্রস্তাব এনেছিল, তার ভিত্তি ছিল ১৯৩১ সালের জনগণনা। তার পর এত রকম পরিবর্তন ঘটেছে জাত-চিত্রে যে সামাজিক ন্যায়ের প্রয়োজনে তাকে ধরার চেষ্টাটিও অত্যন্ত জরুরি হয়ে উঠেছে। ২০১১ সালে আর্থ-সামাজিক জাতগণনা (এসইসিসি)-র যতটা তথ্য উঠে এসেছিল, তা যথেষ্ট ভাবে কাজে লাগানো যায়নি, গণনার কাজটিও সুষ্ঠু ও শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাবে সংঘটিত হয়নি। রাহুল গান্ধী-সহ বিরোধী নেতারা সে বারের দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার-পরিচালিত জাতগণনার সম্পূর্ণ তথ্য প্রকাশিত করার দাবি তুলেছেন মোদী সরকারের দরবারে। কিন্তু সেই তথ্য প্রকাশেও বিজেপি সরকার অনাগ্রহী, কেননা তার থেকে অনেক রকম রাজনৈতিক দাবিদাওয়া উৎসারিত হতে পারে, যেগুলি ভোটের হিসাবে গোলমেলে।

এবং এই ভোট-হিসাবই প্রকৃত সত্য। দেশব্যাপী অনগ্রসর শ্রেণির সংরক্ষণের প্রশ্নের সামনে বিজেপি সতর্ক হতে চায়। এই শ্রেণির জনসংখ্যার হিসাব এক-এক রাজ্যে এক-এক রকম: তদনুযায়ী বিভিন্ন রাজ্যে রাজনৈতিক আবহাওয়াও এক-এক রকম। রাজ্যবৈচিত্র যে রকমই হোক না কেন, প্রায় সর্বত্রই যে ওবিসি জনসংখ্যার অনুপাতে সংরক্ষণের পরিমাণ কম, সে কথা সংশয়াতীত। বিজেপির কাছে ২০১৪ সালের পর বিভিন্ন রাজ্যে ওবিসি জনতার কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্য করে তোলার তাড়নায় সংরক্ষণ ও জাতগণনার দাবি সমর্থন করা ছাড়া পথ ছিল না। গত কয়েক বছরের মোদী-জাদু সেই সমর্থন অনেকাংশে সম্ভব করার পর মনে করা হচ্ছে, জাতগণনার বিষয়টি বেশি প্রচার পেলে উল্টো বিপত্তি হতে পারে। জাত-বিভেদ অতিক্রমী ‘হিন্দুত্ব ছাতা’ তৈরির কাজটি এতে বাধা পেতে পারে। জাতীয় নির্বাচন সামনে, এই মুহূর্তে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ ওবিসি-অধ্যুষিত রাজ্যে অনগ্রসর শ্রেণির ভোট বিজেপির পাল থেকে এক চুল সরলেও মুশকিল। এই জন্যই জাতগণনার প্রশ্নে এখন এই প্রবল অনীহা। নতুন কোনও রাজনৈতিক দাবি এসে হিন্দুত্বের পালের হাওয়া কেড়ে নিলে মোদী-ভারতের তৃতীয় পর্বারম্ভের পথটি ঊষর এবং ধূসর হতেই পারে। সুতরাং, অমৃতকালে অবধারিত ভাবে পিছু হটছে দেশে সামাজিক ন্যায়ের প্রশ্ন, এবং সেই প্রশ্নের সামনে জাতগণনার উত্তর।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Caste Discrimination Caste Census Caste System

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy