E-Paper

ক্ষুদ্রের শক্তি

সমস্যা এই যে, ছোট শিল্পের বৃদ্ধির আলোচনাটি কেবলই ভর্তুকি-অনুদান এবং সহজ শর্তে ঋণদানের প্রসঙ্গগুলিতে আবদ্ধ থাকতে চায়।

শেষ আপডেট: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩ ০৭:৫৭
Mamata Banerjee.

মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। —ফাইল চিত্র।

বিশ্ববাংলা শিল্প সম্মেলনে এ বছরও প্রাধান্য পেয়েছে অতি ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পক্ষেত্রটি (মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ়েস বা সংক্ষেপে এমএসএমই)। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করেছেন যে, পশ্চিমবঙ্গের ছোট শিল্পে সম্প্রতি এক লক্ষ কোটি টাকারও বেশি বিনিয়োগ হয়েছে, যার ফলে একচল্লিশ লক্ষেরও বেশি কাজ তৈরি হবে। সহজে ঋণ, বিশেষ উৎসাহ ভাতা, দূষণ হ্রাস, এমন নানা ব্যবস্থা করার আশ্বাস দিয়েছে রাজ্য সরকার। ভারতের অর্থনীতিতে ছোট শিল্পগুলির অবদান প্রায় ত্রিশ শতাংশ; বড় শিল্পের তুলনায় ছোট শিল্পেই বেশি কাজ তৈরি হয়। কেন্দ্র ও রাজ্য, দু’তরফেই ছোট শিল্পকে উৎসাহ দিতে সুবিধা দেয়। শিল্প সম্মেলনে রাজ্য সরকার জানিয়েছে, ছোট শিল্পের পরিকাঠামো বৃদ্ধি এবং উদ্যোগপতিদের সহায়তার জন্য প্রায় ১৮ হাজার ‘ভবিষ্যৎ ক্রেডিট কার্ড’-এ ঋণ দেওয়া হয়েছে। ঋণ এবং ভর্তুকি মিলিয়ে তার আর্থিক পরিমাণ প্রায় সাড়ে তিনশো কোটি টাকা। এই ধরনের ব্যবস্থাগুলি প্রয়োজনীয়, তাতে সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হল, এই সব পদক্ষেপ বাস্তবে ছোট শিল্পের কতখানি উন্নতি ঘটাতে পারছে, আর কোথায় মৌলিক চাহিদায় ফাঁক থেকে যাচ্ছে, তার ছবিটা কতখানি স্পষ্ট? যেমন, ভারতে নানা সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে, বন্ধকহীন ঋণদানের নানা সরকারি প্রকল্প সত্ত্বেও, যথা সময়ে যথেষ্ট ঋণ না পাওয়া ছোট শিল্পগুলির সঙ্কটের অন্যতম কারণ। তেমনই, পশ্চিমবঙ্গের বিদ্যুৎ গ্রাহকদের একটি সংগঠন সম্প্রতি অভিযোগ করেছে যে, ক্ষুদ্র শিল্পগুলির উপরেও বিদ্যুৎ ব্যবহারের ন্যূনতম চার্জ আরোপ করেছে রাজ্য সরকার। তারই ফলে নাকি গত তিন মাসে কয়েক হাজার ক্ষুদ্র শিল্প বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অপরিমিত ভর্তুকি দান কখনওই সরকারি নীতি হতে পারে না, কিন্তু উৎপাদনের উপকরণের খরচ ক্ষুদ্র শিল্পোদ্যোগীদের সাধ্যের বাইরে চলে যাচ্ছে কি না, তা-ও দেখা প্রয়োজন।

সমস্যা এই যে, ছোট শিল্পের বৃদ্ধির আলোচনাটি কেবলই ভর্তুকি-অনুদান এবং সহজ শর্তে ঋণদানের প্রসঙ্গগুলিতে আবদ্ধ থাকতে চায়। তার বাইরে আলোচনারও প্রয়োজন রয়েছে। সর্বাগ্রে দরকার পরিকাঠামোর পর্যালোচনা। বিদ্যুতের দামই কেবল নয়, তার মান যথেষ্ট ভাল না হওয়ার জন্য— অর্থাৎ নির্দিষ্ট মাত্রায় সমান ভাবে বিদ্যুৎ সরবরাহ না হওয়ার জন্য— ক্ষতিগ্রস্ত হয় বহু যন্ত্র, ছোট কারখানাগুলি আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে। পরিবেশ-বান্ধব উপায়ে জল সরবরাহ হবে কী করে, তা-ও একটি বড় প্রশ্ন। জমি, বিদ্যুৎ, রাস্তা ও পরিবহণের পাশাপাশি ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে ডিজিটাল পরিকাঠামোও। উন্নত তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে না পারলে উন্নত ধরনের পণ্যের উৎপাদন সম্ভব নয়। সমস্যা এই যে, ছোট শিল্পের আলোচনায় পরিসংখ্যান নিয়ে যত কথা হয়, মান নিয়ে তত হয় না। কতগুলি শিল্প কাজ করছে, তারা কত লোক নিয়োগ করছে, কত ঋণ, কত বিনিয়োগ, এমন কয়েকটি সংখ্যাতেই কেবল মূল্যায়ন হয়।

অথচ, কেবল নিয়োগ বাড়ানোই কোনও শিল্পের লক্ষ্য হতে পারে না, প্রয়োজন রোজগার বাড়ানো। পাঁপড়, আচার, বড়ি, পাটের ব্যাগ, কাপড়ের পুতুল তৈরি, এমন ধরনের উদ্যোগ এ রাজ্যে অতি ক্ষুদ্র উদ্যোগের বড় অংশ। যাতে ব্যবহৃত হয় নিম্নপ্রযুক্তি, শ্রমের তুলনায় আয় অত্যন্ত কম। কী করে এই উদ্যোগীদের উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও পরিকাঠামো দিয়ে আরও উন্নত এবং লাভজনক পণ্য উৎপাদনে উৎসাহী করা যায়, রাজ্য সরকারের নীতিতে তার দিশা থাকতে হবে। নিম্ন আয়ের কাজের প্রসার ঘটলে তাতে মানব সম্পদের অপচয়ই বাড়বে। নানা সমীক্ষায় ধরা পড়েছে যে, ক্ষুদ্র শিল্পের সূচনায় উদ্যোগীরা নানা সহায়তা পেলেও, উদ্যোগের প্রসার ঘটিয়ে আরও বড় শিল্প করার পথটি সহজ নয়। সেখানে বহু বাধা, যার অন্যতম হল রাজনৈতিক দলগুলির উৎকোচের দাবি। দুর্নীতিমুক্ত, তৎপর প্রশাসনও শিল্পের পরিকাঠামোর একটি অঙ্গ।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

BGBS 2023 MSME Mamata Banerjee

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy