—প্রতীকী চিত্র।
দশ বছর আগে, ২০১৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রচারপর্বে ভারতে ‘নব্য মধ্যবিত্ত’ নামক একটি শ্রেণির উত্থান নিয়ে বিস্তর চর্চা হয়েছিল। রাজনৈতিক অর্থনীতির পরিসরে এই শ্রেণির উত্থানকে দেখা হয়েছিল মূলত ‘অ্যাস্পিরেশন’ বা উচ্চাশার সূচকে— বিশ্ব অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত সচ্ছল জীবনের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করেছিলেন যাঁরা, তাঁরাই এই শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত হিসাবে গণ্য হয়েছিলেন। মনে পড়তে পারে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী গুজরাতের মুখ্যমন্ত্রী তাঁর প্রচারের একটি বড় অংশ জুড়ে রেখেছিলেন এই শ্রেণির উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের প্রতিশ্রুতি— যে স্বপ্ন তিনি ফেরি করেছিলেন, তার মধ্যে প্রধানতমটি ছিল চাকরি। দরিদ্র মানুষের কাছে আর্থ-সামাজিক সচলতার সর্বপ্রধান হাতিয়ার হল চাকরি। নরেন্দ্র মোদী আশ্বাস দিয়েছিলেন, তিনি ক্ষমতায় এলে বছরে দু’কোটি নতুন কর্মসংস্থান হবে। তিনি ক্ষমতায় এলেন। তার পর দশ বছর কেটে গেল। বছরে দু’কোটি নতুন কর্মসংস্থান দূরের কথা, ভারতে বেকারত্বের হার নিত্যনতুন রেকর্ড গড়ল তাঁর জমানাতেই। ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচন দরজায় কড়া নাড়ছে। প্রধানমন্ত্রী এখন দেশ জুড়ে রোজগার মেলা করছেন। ভোটের আগে দশ লক্ষ সরকারি চাকরির নিয়োগপত্র দেওয়া হবে বলে জানা গিয়েছে। হিসাব বলছে যে, সেটুকুও করে ওঠা মুশকিল— এত দিনে ছ’লক্ষ চাকরির চিঠি দেওয়া গিয়েছে।
সরকারি চাকরির নিয়োগপত্র দেওয়ার জন্য ‘রোজগার মেলা’ করতে হবে কেন, আর তার জন্য প্রধানমন্ত্রীরই বা দরকার পড়বে কেন, সে প্রশ্ন করাই যেত, কিন্তু তার চেয়ে অনেক গুরুতর প্রশ্ন রয়েছে। প্রথমে একটি অনুপাতের হিসাব— বছরে দু’কোটি চাকরি হলে দশ বছরে মোট যত চাকরি হত, দশ লক্ষ চাকরি তার মাত্র ০.৫ শতাংশ। চক্ষুলজ্জা বস্তুটি নেহাত দুর্লভ না হলে তা নিয়ে ঢেঁড়া পেটানোর কথা নয়। এই দশ লক্ষ চাকরিও অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতিমাফিক ‘নতুন’ নয়। এগুলি কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন খালি পদে রুটিন নিয়োগ মাত্র। ফলে, একে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা বললে সত্যের চূড়ান্ত অপলাপ হবে। বস্তুত, সরকারি চাকরির মাধ্যমে কোনও ভাবেই এই নতুন কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা সম্ভব নয়। এই পরিমাণ চাকরির ব্যবস্থা করতে পারে কেবলমাত্র বাজার। বেসরকারি ক্ষেত্রে যথেষ্ট কর্মসংস্থান হলে তবেই বছরে দু’কোটি নতুন চাকরির কথা ভাবা যায়। ভক্তরা আপত্তি করতে পারেন যে, সে নিয়োগ তো প্রধানমন্ত্রীর হাতে নয়। কিন্তু, বেসরকারি ক্ষেত্রে চাকরি সৃষ্টি হওয়ার মতো পরিস্থিতি আছে কি না, তা নিশ্চিত করা প্রধানমন্ত্রীরই কর্তব্য ছিল।
সে কাজে তাঁর ব্যর্থতা প্রশ্নাতীত। তাঁর শাসনের প্রথম দফাতেই নোট বাতিল এবং অপরিকল্পিত ভাবে জিএসটি ব্যবস্থা প্রবর্তনের দু’টি সিদ্ধান্ত অর্থব্যবস্থার যে বিপুল ক্ষতি করেছিল, তার প্রভাব এখনও কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। অতিমারির সূচনার আগেই ভারতীয় অর্থব্যবস্থা ধুঁকছিল— ২০২০-র আগের চারটি অর্থবর্ষের প্রতিটিতে আর্থিক বৃদ্ধির হার ছিল অব্যবহিত পূর্ববর্তী বছরটির বৃদ্ধির হারের তুলনায় কম। ভারতে গ্রামাঞ্চলে প্রকৃত ভোগব্যয়ের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছিল, বাজারে চাহিদা তলানিতে এসে ঠেকেছিল। এই বেহাল অর্থনীতির উপরেই এসে পড়েছিল অতিমারির কোপ। বাজারে চাহিদা না থাকলে উৎপাদন বাড়ানোর তাগিদও থাকে না, ফলে কর্মসংস্থানও হয় না। স্মরণীয় যে, চাহিদার এমন অভাবের মধ্যেও কোভিডকালীন যে ত্রাণপ্রকল্প কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, তা ছিল মূলত ঋণকে তুলনায় সহজলভ্য করার পন্থা। অর্থব্যবস্থার বিপন্নতার প্রকৃত ছবিটি হয় সরকার বোঝেনি, অথবা বুঝেও অবজ্ঞা করেছে। রোজগার মেলার আয়োজন করে তার প্রায়শ্চিত্ত করা কঠিন। সেই ছলনায় ভোটারের মন গলবে কি না, তা ভিন্ন প্রশ্ন, কিন্তু অর্থব্যবস্থার যে অপূরণীয় ক্ষতি এই আমলে হল, তাকে অস্বীকার করা যাবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy