প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
গরমকালে গরমের ছুটি স্বাভাবিক বিষয়, কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে গত কয়েক বছর ধরে গ্রীষ্মের শুরুতেই প্রায় নিয়মের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে গরমের ছুটি— বিশেষত রাজ্যের সরকারি ও সরকার-পোষিত স্কুলগুলিতে। এপ্রিলের শুরুতেই সূর্য যেমন রক্তচক্ষু হানছে, তাপমাত্রা চল্লিশ ছাড়ানোর তোড়জোড় করছে তাতে এই সিদ্ধান্ত হয়তো অমূলক নয়, পড়াশোনার পাশাপাশি প্রবল গরমে পড়ুয়াদের সুস্থ থাকাও সমধিক জরুরি। রাজ্যের স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি নির্ধারিত ছিল ৯ থেকে ২০ মে, এরই মধ্যে তা বেড়ে হয়েছে ৬ মে থেকে ২ জুন, অর্থাৎ আগে শুরু, দেরিতে শেষ। কিন্তু এই সূচিই যে বহাল থাকবে তা বলা যাচ্ছে না, গত দু’বছর দেখা যাচ্ছে অত্যধিক গরমের জেরে এপ্রিলেই সরকারি ঘোষণায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে স্কুল, খুলছে জুনের শুরুতে। এ বছরও যদি তা হয়, ছাত্রছাত্রীদের স্কুলে এসে পড়াশোনার অভ্যাস ও শৃঙ্খলায় দাঁড়ি পড়বে প্রায় দু’মাসের জন্য।
গ্রীষ্মের উত্তরোত্তর প্রাখর্য এক প্রাকৃতিক সমস্যা, কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে তা হয়ে দাঁড়াচ্ছে এক প্রবল সঙ্কট— কারণ দীর্ঘ ছুটির কারণে পাঠ্যক্রম শেষ করা যাচ্ছে না, হচ্ছেও না, শিক্ষা থেকে যাচ্ছে অসম্পূর্ণ। বছরে মোট ছুটির সংখ্যা নির্দিষ্ট হলেও গরম পড়তেই একাদিক্রমে নানা পর্যায়ে লম্বা ছুটি দিয়ে দেওয়ায় সারা বছরের রুটিন ও শিক্ষা-পরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে, ক্ষতি হচ্ছে পঠনপাঠনের মোট সময়ের। অথচ ছুটির পরে যথাসময়ে পর্ষদ-নির্ধারিত মূল্যায়নে ছাড় নেই। এই সবই আসলে বুঝিয়ে দেয় যে, গরমকালে স্কুলশিক্ষা নিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট কোনও ভাবনা বা নীতি নেই; লম্বা ছুটি দিয়ে দেওয়াই তাদের কাছে একমাত্র সমাধান। আবার এ সমস্যা শুধু স্কুলেই নয়, যে দক্ষ ও অদক্ষ শ্রমজীবীদের প্রবল গরমে কাজ করতে হয় তাঁদের ক্ষেত্রেও, এবং সেখানেও গরমের জেরে ছুটি দিয়ে দিতে হলে মোট শ্রমসময় ও উৎপাদনেরও ক্ষতি। শ্রমবাজারের অনেকাংশই বেসরকারি সংস্থা দ্বারা পরিচালিত বলে সরকারের পক্ষে সেখানে গরমের বিরতির বিকল্প উদ্যোগ করা তুলনায় কঠিন, তবু ঠিক কোন পদক্ষেপ করলে শ্রমজীবী মানুষের সুস্থতা রক্ষা করেও গরমে কাজ, অবকাশ ও উৎপাদনের ভারসাম্য নিশ্চিত করা যায় সে ব্যাপারে রাজ্য সরকারের সামনে থেকে নেতৃত্ব দানই কাম্য, জরুরিও— যে-হেতু সে-ই দিনের শেষে নাগরিকের জীবন ও কাজের অভিভাবক, নিয়ামকও।
কিন্তু সরকারের তরফে কিছুই চোখে পড়ছে না— শ্রম বা শিক্ষা কোনও ক্ষেত্রেই নয়। ভাবনাচিন্তা থাকলে তবেই পদক্ষেপের প্রশ্ন: স্কুলে লম্বা গরমের ছুটি দিয়ে দেওয়াই মুশকিল আসান না ভেবে, জলবায়ু সঙ্কটের এই যুগে দাঁড়িয়ে সরকারের বরং শিক্ষাবর্ষের গোড়া থেকে বসা উচিত ছিল বার্ষিক ছুটির ক্যালেন্ডার ও তার বিকল্প ভাবনা নিয়ে; গরমে স্কুলের সময় এগিয়ে আনা, পরিকাঠামো অনুযায়ী সান্ধ্য ক্লাসের ব্যবস্থা করা নিয়ে; জরুরি ছিল এই নিয়ে শিক্ষক ও অভিভাবকেরা কী ভাবছেন তা শোনা। এ কোনও ছেলেখেলা নয়, শিক্ষার প্রশ্ন, ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের প্রশ্ন। শুধু গরমই যে একমাত্র সমস্যা তা নয়, সমস্যা ভোটও, এরই মধ্যে উত্তরবঙ্গের বহু স্কুলে ছুটির কথা ঘোষণা হল বলে— আর কেন্দ্রীয় বাহিনীকে আশ্রয় দিতে স্কুলের ঝাঁপ ফেলে রাখাও এ বঙ্গে এখন নিয়মে পর্যবসিত। বাকি জনজীবন যখন গরমে খোলা, ইস্কুল কেন ছুটির ফাঁদে, এ প্রশ্নের সদুত্তর সরকার দিতে পারবে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy