সুপ্রিম কোর্ট। —ফাইল চিত্র।
মেয়েদের সম্পর্কে যে শব্দগুলি আদালতে ব্যবহার করা চলবে না, সেগুলির তালিকা তৈরি করে দিল দেশের শীর্ষ আদালত। সেই সঙ্গে দিল বিকল্প শব্দের তালিকাও। শব্দের ব্যবহার-বিধি সম্বলিত এই ‘হ্যান্ডবুক’ আইনজীবী এবং বিচারক, বিচারপতিদের জন্য লেখা হলেও, বস্তুত গোটা দেশের মনোযোগ দাবি করে। মেয়েদের সম্পর্কে যে ধরনের ছাঁচে-ঢালা ভাবনা (স্টিরিয়োটাইপ) তৈরি করেছে পুরুষতন্ত্র, ভাষা তার প্রধান বাহক। অতএব যে ধরনের শব্দপ্রয়োগ মেয়েদের অবমূল্যায়ন করে, তাদের সম্পর্কে কদর্য ইঙ্গিত করে, সেগুলো বাতিল করে। তাই বেশ কিছু শব্দবন্ধ বিকল্পহীন। যেমন, ‘ভারতীয় মহিলা’ কিংবা ‘পশ্চিমি মহিলা’— এই দু’টিরই পরিবর্তে আদালত ব্যবহার করতে বলেছে কেবল ‘মহিলা’। এর কারণ বোঝা কঠিন নয়, ‘ভারতীয়’ বা ‘পশ্চিমি’, দু’টি শব্দ মেয়েদের ভৌগোলিক অবস্থান বোঝায় না, মেয়েদের স্বভাবচরিত্রের সম্পর্কে ইঙ্গিত করে। ভারতীয় মেয়েরা সমাজ-সংসারে অবনমিত, গৃহলক্ষ্মীর ভূমিকায় আবদ্ধ, আর পশ্চিমি মেয়েরা পরিবার-বিমুখ, নৈতিকতার প্রশ্নে শিথিল, এই অর্থই তৈরি করা হয়। এই অসম্মান এড়াতে কোনও মেয়ের বিবরণ দিতে ‘ভারতীয়’ বা ‘পশ্চিমি’ শব্দগুলি ব্যবহারই বাতিল করতে হবে। মেয়েদের খর্ব করার এমন আর একটি বিশেষণ হল ‘কেরিয়ার উয়োম্যান’। এ ক্ষেত্রেও আক্ষরিক অর্থ ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠছে শব্দের দ্যোতনা— যে মেয়ে পেশাকেই প্রাধান্য দেয়, সাংসারিক দায়িত্ব উপেক্ষা করে। লক্ষণীয়, পুরুষদের ক্ষেত্রে ‘কেরিয়ার’ বা ‘পেশা’ শব্দটি কখনওই এমন নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করা হয় না। ‘মহিলা’ শব্দটি একক ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে ব্যক্তি হিসাবে মেয়েদের মর্যাদার প্রতি আদালত সতর্ক করেছে বক্তা ও শ্রোতাকে।
মনে হতে পারে, শব্দের ব্যবহারে রাশ টানলেই কি মেয়েদের প্রতি বৈষম্য দূর হবে? ‘কনকুবাইন’ (উপপত্নী), ‘হার্লট’ (গণিকা) কিংবা ‘মিসট্রেস’ (বিবাহ-বহির্ভূত যৌনসঙ্গী) শব্দগুলি বাতিল করলেই মেয়েদের যৌন স্বাধীনতা কি মেনে নেবে সমাজ? ‘আনওয়েড মাদার’ বলার পরিবর্তে কেবল ‘মাদার’ বললেই কি অবিবাহিত মা যথাযোগ্য সম্মান পাবেন ভারতে? সম্ভবত সেই প্রশ্ন মাথায় রেখেই শব্দের শক্তির কথা মনে করিয়েছেন ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড়। ‘হ্যান্ডবুক’-এর ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, শব্দই হল সেই বাহন যার দ্বারা আইনের মূল্যবোধগুলি অন্যের কাছে পৌঁছনো যায়। আইনপ্রণেতা অথবা বিচারপতির যা অভিপ্রায়, তা শব্দের দ্বারাই বাহিত হয়। কিন্তু বিচারপতি যে সব শব্দ ব্যবহার করেন, সেগুলিতে কেবল আইনের ব্যাখ্যাই প্রতিফলিত হয় না, সমাজ সম্পর্কে তাঁদের ধারণারও প্রতিফলন হয়। বিচারপতিদের ব্যবহৃত শব্দে যদি প্রাচীন, ভ্রান্ত ধারণার প্রতিফলন হয়, তা হলে আইনের সমাজ পরিবর্তনের আরব্ধ কাজটিও ব্যাহত হয়। সেই সঙ্গে বাধাপ্রাপ্ত হয় ভারতের সংবিধান, যা সকলের জন্য সমানাধিকার চায়। হ্যান্ডবুকে আমরা তাই দেখি, মহিলাদের পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গ, সমকামী মানুষদের প্রতি বিদ্বেষমূলক নানা শব্দকে বাতিল করেছে শীর্ষ আদালত।
চতুর্দিকে যখন ঘৃণা-উদ্গিরক, বিদ্বেষপূর্ণ বাক্যের মন্থন চলছে, তখন শব্দ ব্যবহারে সতর্কতার এই নির্দেশ এক প্রায়-বিস্মৃত সত্যকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এল। সমাজের মতো, ভাষাও আমাদের উত্তরাধিকার। তার মধ্যে নিহিত রয়েছে ভ্রান্ত রীতিবাহিত নানা বৈষম্য। সম্বোধন, লিঙ্গ নির্ণয় থেকে শুরু করে নাম ও বিশেষণের ব্যবহার, সর্বত্রই সেগুলো ছড়িয়ে রয়েছে। সমাজ বদলাতে হলে তাই ভাষাকে সচেতন ভাবে বদলাতে হবে। সে কাজটি সর্বদাই আদালতের মতো কোনও কর্তৃত্বময় প্রতিষ্ঠান করবে, এমন ধরে নেওয়া চলে না। সংবাদ, সাহিত্য, নাটকের সংলাপে, দৈনন্দিন কথোপকথনে, শব্দের সতর্ক ব্যবহার সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার এক প্রধান শর্ত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy