Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
UGC Guidelines

পশ্চাদ্‌বর্তী

সম্প্রতি ইউজিসি-র খসড়া নির্দেশিকা প্রকাশিত হল— কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়ুর্বেদ, যোগ, বৈদিক গণিত-সহ একগুচ্ছ বিষয়ের পাঠ্যক্রম চালু করা নিয়ে।

A Photograph of books

নতুন বিষয়গুলি কী ভাবে পাঠ্যক্রম তৈরি হবে, কারা পড়াবেন, এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই শিক্ষা কী ভাবে কাজে লাগানো যাবে, এ নিয়েও ভাবতে বলা হয়েছে। প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৩ ০৪:৫০
Share: Save:

উচ্চশিক্ষার অঙ্গনে যদি কেউ ভবিষ্যমুখী না হয়ে অতীতপন্থী হয়েই বাঁচতে চায়, অতীতকেই তুলে ধরতে চায় শিক্ষার সার্থকতা ও গৌরবের উৎস হিসাবে, তা হলে বিপদ আছে। ভারতে উচ্চশিক্ষার নিয়ামক সংস্থা ইউজিসি-র সাম্প্রতিক কাজ দেখে মনে হচ্ছে তারা জেনেশুনেই সেই বিপদের পথে পা বাড়িয়েছে। সম্প্রতি ইউজিসি-র খসড়া নির্দেশিকা প্রকাশিত হল— কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়ুর্বেদ, যোগ, বৈদিক গণিত-সহ একগুচ্ছ বিষয়ের পাঠ্যক্রম চালু করা নিয়ে। মনে করা হচ্ছে, এই বিষয়গুলিতে নিহিত ‘ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য’ বিদেশি ছাত্রছাত্রীদের আকর্ষণ করবে, তাঁরা ভারতের উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে এগুলি পড়তে আসবেন। নির্দেশিকায় বলা হয়েছে এগুলি হবে স্বল্প সময়ের ‘ক্রেডিট-বেসড মডিউলার প্রোগ্রাম’; ‘ইনট্রোডাক্টরি’, ‘ইন্টারমিডিয়েট’ ও ‘অ্যাডভান্সড’ তিনটি স্তরের কথা ভাবতে বলা হয়েছে, তদনুযায়ী কী ভাবে পাঠ্যক্রম তৈরি হবে, কারা পড়াবেন, এই সময়ে দাঁড়িয়ে এই শিক্ষা কী ভাবে কাজে লাগানো যাবে, এ নিয়েও ভাবতে বলা হয়েছে।

ভাববার কথা, প্রস্তাবিত বিষয়গুলির মধ্যে আয়ুর্বেদের সঙ্গেই রাখা হয়েছে ভারতীয় সঙ্গীত ও নৃত্যধারাকে, যোগের পাশে ভারতীয় ভাষাচর্চাকে, বৈদিক গণিতের সঙ্গে বিশ্বজনীন মানবিক মূল্যবোধের চর্চাকেও। প্রথম দর্শনে মনে হতে পারে এই সবই তো বৈচিত্রময়, ভারতের সাংস্কৃতিক বহুত্বের নিদর্শন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? শিক্ষাবিদদের একাংশ প্রশ্ন তুলেছেন, বিষয়ভাবনায় ভারতীয় ইতিহাসের মধ্যযুগটি একেবারেই অনুচ্চারিত, ইসলামি শাসনের সমান্তরালে যে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চা হয়েছিল, তার কোনও উল্লেখ নেই, নেই সুফিবাদের মতো সমন্বয়বাদী ভাবদর্শনের কথা। সমাজের নিম্নবর্গ ও দলিত মানুষের অধিকার আন্দোলন নিয়ে, এমনকি তাঁদের যাপিত ভাষা-সঙ্গীত-নৃত্যসংস্কৃতি নিয়ে উচ্চবাচ্য নেই। কোনও বিদেশি ছাত্র যদি সংস্কৃতের বদলে উর্দু বা আরবি ভাষা-সংস্কৃতি সম্পর্কে, কিংবা সুলতানি স্থাপত্যরীতি নিয়ে কোনও কোর্স করতে চান, কিংবা নিম্নবর্গের আন্দোলনের আতশকাচে জানতে চান সাঁওতাল বিদ্রোহের পূর্বাপর, সে ইচ্ছা কি পূরণ হবে? ভারতবিদ্যা-চর্চা কোনও নতুন ভুঁইফোঁড় বিষয় নয়, বিশ্বের বহু কৃতবিদ্যজন নানা সময়ে ভারতে এসে ও থেকে বিস্তর গবেষণা করেছেন, তাঁদের ভারত-চর্চার মূল আকর্ষণটিই ছিল এ দেশের বিবিধতার মিলন— একে বাদ দিয়ে ওকে মাথায় তোলা নয়।

উচ্চশিক্ষার মূল কথাটি কী? কালপ্রবাহের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জ্ঞানচর্চার পরিসরটি একই সঙ্গে প্রসারিত ও গভীর হচ্ছে, সেই উচ্চতা ও গভীরতাকে স্পর্শ করা। এর সঙ্গে যে আধুনিকতার— দিন বদলের সঙ্গে নিরন্তর পাল্টাতে থাকা ধারণা ও মূল্যবোধ ইত্যাদির এক অচ্ছেদ্য যোগ রয়েছে, তাকে অস্বীকার করার কোনও অর্থ হয় না। অথচ ইউজিসি-র প্রস্তাব দেখে মনে হচ্ছে এ যেন কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় শিক্ষানীতির সর্বানুসারী হয়ে শুধুই মুখ ঘুরিয়ে পিছনপানে তাকানো, তাও বেছে বেছে এমন ক্ষেত্রগুলিতে যা নিতান্তই সরকারের পছন্দের, সরকারি মতাদর্শ ও শাসক দলের ভাবধারার পোষক। ভারতীয় সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের নামে এ আসলে বিদ্যাচর্চার এক সঙ্কীর্ণ লক্ষ্মণরেখা কেটে দেওয়া, তার বাইরে যা কিছু সব অপাঙ্‌ক্তেয়। এ জিনিস প্রাথমিক শিক্ষা থেকেই শুরু হয়েছে, উচ্চশিক্ষার পরিসরে তা ভয়ঙ্কর হয়ে দাঁড়াবে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE