প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি।
সমীক্ষাটির নাম হতেই পারত ‘দারিদ্র বিষয়ে দু’টি একটি কথা, যা সরকার জানাতে চায়’। ২০২২-২৩ সালের গৃহস্থালি ভোগব্যয় সমীক্ষার একেবারে গোড়ায় রয়েছে স্বেচ্ছা-ধূসরতা, যা থেকে আশঙ্কা হয় যে, সরকার আসলে অনেক কিছুই জানাতে চায় না। নমুনা সমীক্ষার ক্ষেত্রে নমুনা নির্বাচনের গুরুত্ব অনস্বীকার্য। ভোগব্যয় সমীক্ষার ক্ষেত্রে— যা দেশে দারিদ্রের ব্যাপ্তি ও গভীরতার অন্যতম নির্ভরযোগ্য তথ্যভান্ডার— নির্বাচিত পরিবারগুলির মধ্যে কত অংশ দারিদ্রের সিঁড়ির কোন ধাপে অবস্থান করে, সেই প্রশ্নের উপরে নির্ভর করে প্রাপ্ত তথ্যের গ্রহণযোগ্যতা। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার এর আগের প্রকাশিত ভোগব্যয় সমীক্ষাটি ছিল ২০১১-১২ সালের জন্য। বর্তমান ও ২০১১-১২ সালের সমীক্ষার গবেষণাপদ্ধতির পাতাগুলি খুললে দেখা যাবে, নমুনা বাছাইয়ের পদ্ধতি পাল্টে গিয়েছে। গত দফায় গ্রামীণ নমুনার তিনটি স্তর ছিল— সম্পন্ন গৃহস্থালি (যে পরিবারের মালিকানায় অন্তত ১০টি নির্বাচিত সম্পদ ও স্থায়ী ভোগ্যপণ্য রয়েছে); সম্পন্ন নয় এমন গৃহস্থালি, যার আয়ের মূল উৎস কৃষিবহির্ভূত ক্ষেত্র; এবং অন্যান্য গৃহস্থালি। এ দফায় তিনটি স্তর যথাক্রমে মোট জমির মালিকানার হিসাবে সর্বোচ্চ পাঁচ শতাংশ গৃহস্থালি; তার পরবর্তী ১৫ শতাংশ; এবং অন্যান্য গৃহস্থালি। গত দফায় শহরাঞ্চলে স্তর বিভাজন হয়েছিল ৬৬তম নমুনা সমীক্ষার তথ্যের ভিত্তিতে ২০০৯-১০ সালের আনুমানিক মাথাপিছু ভোগব্যয়ের হিসাবে— যথাক্রমে শীর্ষ ১০%, মধ্যবর্তী ৬০% এবং নিম্নতম ৩০%। এ বার তিনটি ভাগ হয়েছে এই রকম— যে সব বাড়িতে ব্যক্তিগত ব্যবহারের গাড়ির ক্রয়মূল্য দশ লক্ষ টাকার বেশি; যাদের গাড়ির মূল্য দশ লক্ষ টাকার কম; এবং যে সব বাড়িতে গাড়ি নেই। কোন যুক্তিতে পুরনো স্তরগুলি বর্জিত হল, তার উত্তর না থাকলেও এটা আঁচ করা যায় যে, নমুনার এমন স্তরবিভাজনের ফলে গড় ভোগব্যয় প্রকৃত পরিস্থিতির চেয়ে বেশি আসবে। দারিদ্র কমেছে, সে কথা দেখাতে সুবিধা হবে। এই জমানায় পরিসংখ্যানের মূল ব্যবহার যে রাজনৈতিক, সে কথা কে না জানে!
হিসাবের একেবারে গোড়ায় গলদ থাকায় এই পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণ বিভ্রান্তিকর হতে পারে। কিন্তু, যেখানে সংশয় হয় যে নমুনা বাছাইয়ের উদ্দেশ্য ভোগব্যয় বৃদ্ধি দেখানো— সেখানেও পরিসংখ্যান যদি বলে যে, মানুষের অবস্থা ভাল নয়, তবে সে কথাকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হয় বইকি। প্রথম কথা হল, ভারতে গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের মধ্যে ভোগব্যয়ের ব্যবধান অনেক বেড়ে-কমে শেষ অবধি ১৯৯৯-২০০০ সালের স্তরের চেয়ে সামান্য কম হয়েছে। অর্থাৎ, গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন বা গ্রামাঞ্চলে সামাজিক খাতে ব্যয়ের যাবতীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ব্যবধান প্রকট— শহরাঞ্চলে ভোগব্যয়ের গড় পরিমাণ গ্রামীণ গড় ভোগব্যয়ের ৭১ শতাংশ বেশি। দ্বিতীয়ত, গ্রামাঞ্চলে এখনও মোট আয়ের কার্যত অর্ধেক খরচ হয় শুধু খাদ্যের সংস্থান করতে; শহরাঞ্চলেও এই অনুপাত ৪০ শতাংশের কাছাকাছি। রুটি জোগাতেই আয়ের অর্ধেক বেরিয়ে গেলে কাপড় এবং মকানের কী দশা, আঁচ করা যায়। প্রসঙ্গত, পশ্চিমবঙ্গে উভয় ক্ষেত্রেই এই অনুপাতটি সর্বভারতীয় গড়ের চেয়ে বেশি। তৃতীয়ত, ১৯৯৯-২০০০ সালের তুলনায় ২০২২-২৩’এ চাল-গমের মতো খাদ্যশস্যের পিছনে ব্যয় পরিবারের মোট ব্যয়ের অনুপাতে বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছে; শতাংশ-বিন্দুর হিসাবে খাদ্যের পিছনে মোট খরচও কমেছে তার ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। কিন্তু, দুধ ও দুগ্ধজাত পণ্য, ফল ও প্রাণিজ প্রোটিনের পিছনে ব্যয়ের অনুপাত সে ভাবে বাড়েনি। অর্থাৎ, পুষ্টিতে ঘাটতি থাকছেই। ভারতে দারিদ্রের হার কমে পাঁচ শতাংশের নীচে চলে এসেছে, এমন একটি অবিশ্বাস্য তথ্য প্রতিষ্ঠা করার চেয়ে সরকার যদি বর্তমান নমুনা সমীক্ষা থেকে উঠে আসা প্রকৃত সমস্যাগুলির দিকে মন দিত, মানুষের উপকার হওয়ার সম্ভাবনা বাড়ত। কিন্তু, এ জমানার রাজনীতি আর কবেই বা অতশত ভেবেছে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy