Advertisement
১১ মে ২০২৪

পঞ্চকোট রাজবংশ এবং মানভূমের সভ্যতা

মধ্যপ্রদেশের ‘ধার’ স্টেট থেকে আগমন। সেই আগমন স্থায়িত্ব পেল মানভূমে। পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমান, ধানবাদ, বোকারো ও রাঁচিতে পঞ্চকোটের রাজত্ব বিস্তৃত ছিল। লিখছেন দিলীপকুমার গোস্বামীঝালদা, পাড়া, গড়পঞ্চকোট, মহারাজনগর, রামবনি, কেশরগড় এবং সর্বশেষ কাশীপুর— এই সাতটি রাজধানী থেকে পঞ্চকোটের রাজারা শাসন করতেন। মানভূমের সভ্যতা সৃষ্টিতে এই রাজবংশ অন্যতম প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে।

কাশীপুর রাজবাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

কাশীপুর রাজবাড়ি। —নিজস্ব চিত্র।

শেষ আপডেট: ২০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:৫৯
Share: Save:

পঞ্চকোট রাজবংশ মানভূম-পুরুলিয়ার প্রাচীন রাজবংশ। প্রায় ১,৯০০ বছর আগে ঝালদায় এই রাজবংশ প্রতিষ্ঠা হয়। ঝালদা, পাড়া, গড়পঞ্চকোট, মহারাজনগর, রামবনি, কেশরগড় এবং সর্বশেষ কাশীপুর— এই সাতটি রাজধানী থেকে পঞ্চকোটের রাজারা শাসন করতেন। মানভূমের সভ্যতা সৃষ্টিতে এই রাজবংশ অন্যতম প্রধান ভূমিকা গ্রহণ করেছে।

মধ্যপ্রদেশের ‘ধার’ স্টেট (ধাবানগর) থেকে পঞ্চকোট রাজবংশের উত্তরাধিকারীরা এসেছিলেন পুরুলিয়ায়। সেই আগমন স্থায়িত্ব পেল মানভূমে। এই রাজবংশকে ‘শিখরভূম রাজবংশ’ও বলা হয়ে থাকে। ধর্ম আন্দোলন, সাংস্কৃতিক আন্দোলন, জেলার ২২টি জনপদ নির্মাণ, বিভিন্ন জাতির বসতি বিস্তারে আনুকূল্য দান, মন্দির-স্থাপত্য শিল্পের প্রসার, দেশপ্রেমিক প্রজাদের নিষ্কর মৌজা বিতরণ এবং জনজাতিগুলির সঙ্গে রাজ পরিবারের আত্মিক সম্পর্ক রাজ পরিবারটিকে বিশিষ্টতা দিয়েছে।

পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বর্ধমান, ধানবাদ, বোকারো ও রাঁচি জেলার ২,৭৭৯ বর্গমাইল এলাকায় পঞ্চকোটের রাজত্ব বিস্তৃত ছিল। কটকের ডালিজোড়া ও বারাণসীতেও পঞ্চকোটের জমিদারি ছিল। গঙ্গাতীরে ‘পঞ্চকোট ঘাট’ এখনও বিদ্যমান।

প্রায় ১,৯০০ বছরের শাসনকালে পঞ্চকোট রাজপরিবার কোনও প্রজা বিদ্রোহের সম্মুখীন হয়নি। উপরন্তু, রাজ পরিবারটির অভ্যন্তরীণ বিপর্যয়ে, এমনকি, রাষ্ট্রবিপ্লবে পঞ্চকোট রাজ পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছেন প্রজারা। সারা পঞ্চকোট জুড়ে বহু জনজাতি। সাঁওতাল, কোল, ভূমিজ জাতির লোকেরা নিঃসঙ্কোচে তাঁদের জীবনযাপন, ধর্মপালন, উৎসব-অনুষ্ঠান করে গেছেন পঞ্চকোটদের রাজত্বে। রাজদণ্ড কখনও প্রজাদের স্বাধীন জীবনচর্যায় বাধা হয়নি। সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে এই পরমত সহিষ্ণুতার নিদর্শন সে কালে দুর্লভ।

পরবর্তীকালে পঞ্চকোটের হাত ধরে মানভূম-পুরুলিয়ায় ব্রাহ্মণ্যধর্ম প্রসারিত হয়েছিল। বৈষ্ণবধর্ম হয়েছে রাজধর্ম। তাই পঞ্চকোট জুড়ে ব্রহ্মোত্তর, দেবোত্তর মৌজার সংখ্যাধিক্য এবং স্থাপিত হয়েছে এত মন্দির। রঘুনাথ, মদনমোহন, শ্যামরঘুবরের টেরাকোটা, চারচালা, আটচালা মন্দিরের এত প্রসার। মানভূমে নবম, দশম, একাদশ শতাব্দীতে জৈনধর্ম ব্যাপক প্রসার লাভ করেছিল। জেলার নদীতীরগুলিতে হাজার হাজার মন্দির নির্মিত হয়েছিল। শিল্পীদের সমাবেশ হয়েছিল। ধর্মগুরুদের পাশে দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষও জৈন ধর্ম প্রচারে প্রতিষ্ঠায় আনুকূল্য দিয়েছিল। তখনও পঞ্চকোট রাজপরিবারের সঙ্গে জৈন ধর্ম প্রচারকদের সংঘর্ষের কাহিনি শোনা যায়নি।

সপ্তম, অষ্টম ও নবম শতাব্দী জুড়ে মানভূম-পুরুলিয়ায় ব্রাহ্মণদের বসতি শুরু হয়। বল্লাল সেনের সময় (১০৮৩-১১৬৯ খ্রিস্টাব্দ) উচ্চবর্ণের মধ্যে কৌলিন্য প্রথা প্রবর্তিত হয়েছিল। এই ব্রাহ্মণ-পৃষ্ঠপোষকতা ঘটেছিল পঞ্চকোটের হাত ধরেই। বৈদ্যজাতির বাস পঞ্চকোট রাজধানীর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলিতে। স্থানীয় চৌরাশি আর মহিষাড়া পরগনায় তাঁদের সংখ্যাধিক্য রয়েছে। এ কারণেই বৈদ্যদের একটি শাখার নাম ‘পঞ্চকোট্যা বদ্যি’। এমন ভাবে বহু জাতির নামের সঙ্গে শিখর্যা/পঞ্চকোট্যা নামগুলি যুক্ত। তাদের সকলের অভিবাসন পঞ্চকোট-পৃষ্ঠপোষকতায়। এলাকার বহু ব্রাহ্মণদের ‘উপাধি’ পঞ্চকোটের দেওয়া। ‘রাজ-উপাধি’ এই শব্দবন্ধ পঞ্চকোটেই ব্যবহৃত হয়।

চৈতন্যদেবের প্রয়াণের একশ বছরের মধ্যে সমস্ত জঙ্গলমহল, ‘ভূম’ অঞ্চলের সামন্ত শাসকেরা বৈষ্ণবধর্ম গ্রহণ করলেন। ১৬৫৩ খ্রিস্টাব্দে পঞ্চকোটে বৈষ্ণব ভাব স্থায়ী হল। সাহিত্য-শিল্প-ধর্ম-স্থাপত্য-ভাস্কর্যে বৈষ্ণবীয় ভাবধারার প্রভাব পড়ল। কাশীপুরের রাজসভা ‘দ্বিতীয় নবদ্বীপ’ হিসেবে গণ্য হত এক সময়। সারা দেশের কবি-সাহিত্যিক-নৃত্য বিশারদ, লোকগায়ক-গায়িকাদের সমাবেশে পঞ্চকোটের সপ্তম রাজধানী জমজমাট থাকত। ঝুমুরসম্রাট ভবপ্রীতানন্দ ওঝা রাজসভায় সমাদৃত হতেন। মহারাজা জ্যোতিপ্রসাদ দেওঘরে কবির জন্য বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। কমলা ধরিয়া এবং সিন্ধুবালা দেবী এক সময় পঞ্চকোট রাজসভার রত্ন ছিলেন। পঞ্চকোট রাজপরিবারই এই শিল্পীদের মর্যাদায় ভূষিত করেছিল।

আধুনিক যুগের বাংলা সাহিত্যে পঞ্চকোটের সংযোজন মহাকবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের ছ’টি সনেটের মধ্য দিয়ে। বাংলা সাহিত্যে ‘পুরুলিয়া’ শব্দটি তিনিই প্রথম ব্যবহার করেন। জীবনসায়াহ্নে কবি কাশীপুরে কাটিয়েছিলেন মহারাজা নীলমণি সিংহদেওয়ের রাজদরবারে। এই নীলমণি সিংহদেওয়ের সভাগায়ক ছিলেন যদুভট্ট এবং তাঁর পিতৃদেব মধুসূদন ভট্টাচার্য। যদুভট্টকে ‘রঙ্গনাথ’ উপাধি দেওয়া হয়। ভাদুগানেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন নীলমণি সিংহদেও।

সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামে পঞ্চকোটের অবদান অনস্বীকার্য। ১৭৯৫ খ্রিস্টাব্দে খাজনা ঠিক সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সেরেস্তায় না পৌঁছনোয় পঞ্চকোট রাজ্য নিলাম করার সিদ্ধান্ত নেয় কোম্পানি। পঞ্চকোটের প্রজারা তখন ঘোষণা করেন, ‘পঞ্চকোট রাজ ছাড়া, আর কাউকে খাজনা দেব না’। শেষ পর্যন্ত কোম্পানি নিলাম রদ করে পঞ্চকোট রাজকে তাঁর রাজ্য ফেরত দেয়। জয় হয় পঞ্চকোটের প্রজাদের (১৭৯৯, মে)। ইতিহাসে এ ঘটনা চুয়াড় বিদ্রোহের দ্বিতীয় পর্যায়ের ঘটনা হিসাবে খ্যাত।

১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহে যোগ দেওয়ার অভিযোগে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি পঞ্চকোটের মহারাজা নীলমণি সিংহদেওকে জেলে বন্দি করেছিল। কলকাতার আলিপুরে বন্দি ছিলেন তিনি। আমরা যা স্মরণে রাখি না, অথচ, মানভূম-পুরুলিয়ার মানুষের কাছে যা অমোঘ সত্য তা হল— কল্যাণেশ্বরী, আসানসোল, হিরাপুর, গড়পঞ্চকোট, রঘুনাথপুর, আদ্রা, পুরুলিয়া-সহ ২২টি জনপদ পঞ্চকোট রাজবংশের সৃষ্টি। জনপদ সৃজন ইতিহাসে শাসকের অন্যতম সাফল্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়। জাতি ও জনজাতির পৃষ্ঠপোষণও সভ্যতার প্রধানতম উপাদান। এমনই সব অলঙ্কার পঞ্চকোট রাজবংশের ভূষণ।

লেখক ইতিহাস এবং লোক সংস্কৃতি গবেষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Dynasty Panchkot Manbhum
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE