Advertisement
০২ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ৩

‘তুমি ফেল’ বলেই তবে শিশুর প্রতি দায় সারব!

শিশু স্কুলে আসে শিখতে। এখন সে যদি ফেল করে, তার দায়টা তো সবার আগে বর্তায় আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থার উপর। কোনও শিশু আসলে ফেল করে না, ফেল করে স্কুল, ফেল করেন শিক্ষক, ফেল করে শিক্ষাব্যবস্থা।শিশু স্কুলে আসে শিখতে। এখন সে যদি ফেল করে, তার দায়টা তো সবার আগে বর্তায় আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থার উপর। কোনও শিশু আসলে ফেল করে না, ফেল করে স্কুল, ফেল করেন শিক্ষক, ফেল করে শিক্ষাব্যবস্থা।

তোয়া বাগচী ও পিয়া সেন
শেষ আপডেট: ১২ নভেম্বর ২০১৫ ০০:০৯
Share: Save:

মানুষের মানুষ হয়ে ওঠার একটা লক্ষণ, সে তার অর্জিত ক্ষমতা কতখানি বৃহত্তর সামাজিক প্রয়োজনে লাগাতে পারছে। শুধু তা-ই নয়, এটা একটা বড় সামাজিক দার্শনিক চাহিদাও। ‘সুত্ত নিপাত’তে বুদ্ধ বলেছেন, মা যে তাঁর সন্তানের দেখাশোনা করেন, তা শুধুমাত্র জন্ম দেওয়ার কারণেই নয়, তিনি জানেন সন্তানকে ঠিক দিশা দেখাতে, তাকে সুপথে চালিত করতে, সর্বোপরি তার ভাবনাচিন্তার সংগঠিত বিকাশের জন্য মায়ের সাহায্যের প্রয়োজন আছে। কোনও শিশুরই এই ক্ষমতা থাকে না যে, সে নিজে নিজেই তার কাজগুলি করতে পারবে। তাই বড় হওয়ার সম্পূর্ণ দায়িত্বটাই বর্তায় তার মায়ের উপর।

আবার, একটু বড় হলে সে স্কুলে যেতে শুরু করে। শুরু হয় প্রথাগত শিক্ষার। বিদ্যালয়ে শিক্ষকের সহায়তায় এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাড়িতে বাবা-মায়ের সান্নিধ্যে তার শেখার পর্ব চলতে থাকে। শহরাঞ্চলে বা অপেক্ষাকৃত অবস্থাপন্ন শিক্ষিত পরিবারগুলিতে বাবা-মায়ের পক্ষে বাচ্চাকে পড়াশোনায় সাহায্য করাটা যতটা সহজ হয়, গ্রামাঞ্চলে খেতমজুর-খেটে খাওয়া পরিবারের ক্ষেত্রে কিন্তু তা প্রায় অসম্ভব। এর মাঝে হঠাৎ করে প্রথম শ্রেণি, দ্বিতীয় শ্রেণি বা অন্য কোনও শ্রেণিতে গিয়ে শিশু যদি ফেল করে, ব্যর্থতার দায়টা কার ঘাড়ে বর্তাবে? প্রথম শ্রেণিতে পড়তে আসা একটি শিশুকে ফেল করিয়ে দিয়ে আমরা যদি বলি, ‘আরে, ও তো বোঝে কম— কিছুই পারে না!’, তবে আমাদের বোঝার ক্ষমতা নিয়েই প্রশ্ন ওঠে। বড় প্রশ্ন।

নিয়ম ছিল, বছরের শেষে শিশুর পরীক্ষা নেওয়া হবে এবং সেই পরীক্ষার ভিত্তিতে সে কতটা শিখতে পারল বা পারল না, তা নির্ধারিত হবে। যে পারল না, তাকে অনায়াসে ‘ফেল’ ঘোষণা করিয়ে দেওয়াটাই ছিল মূল্যায়নের মাপকাঠি। যে শিশু পরীক্ষায় পাশ করতে ব্যর্থ হল, তার ব্যর্থতা কী কী কারণে— এ ব্যবস্থা কিন্তু কোনও দিনই তার কোনও বিশ্লেষণ করতে যায়নি। শিশু তো স্কুলে আসে শিখতে। এখন সে যদি ফেল করে, তার দায়টা তো সবার আগে বর্তায় আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থার উপর। শিক্ষাবিদরা অনেকেই বলেন, কোনও শিশু কখনও ফেল করে না, ফেল করে স্কুল, ফেল করেন শিক্ষক, ফেল করে শিক্ষাব্যবস্থা। অথচ এই ব্যর্থতার দায় একা ঘাড়ে নিতে হয় শিশুটিকে, শিক্ষক বা অন্যান্যদের অবহেলা, একই সঙ্গে নিচু শ্রেণির বাচ্চাদের সঙ্গে আবারও একই ক্লাসে পড়ার লজ্জা ও টিটকিরি ইত্যাদির কারণে খুব শীঘ্রই বিদ্যালয়ে আসার স্পৃহা চলে যায় তার। মেয়েদের লেখাপড়ার ক্ষেত্রে এই পদ্ধতি বিশেষ প্রভাব ফেলে। কোনও নিম্নবিত্ত পরিবারের মেয়ে যদি ফেল করে, তবে ধরে নেওয়া যেতেই পারে, শীঘ্রই তাকে স্কুল থেকে ছাড়িয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দেওয়া হবে। এক দিকে আমরা ‘কন্যাশ্রী’ প্রকল্প চালু করে মেয়েদের বাল্যবিবাহ রুখতে চাইছি, অন্য দিকে শিক্ষাব্যবস্থায় পাশ-ফেল প্রথার পক্ষে গলা ফাটিয়ে মেয়েদের শিক্ষার আঙিনা থেকে তাড়ানোর বন্দোবস্তও পাকা করছি।

শিশু নিজে নিজে শিখে নিতে পারে না বলেই তার জন্য স্কুল, শিক্ষক ইত্যাদির আয়োজন। এগুলো থাকার পরও যদি সে ন্যূনতম শিক্ষাটা না পায়, তবে তার দায় তো শিশুর একার হতে পারে না। সমগ্র বিশ্বই যখন শিক্ষা ব্যবস্থায় এ সত্যটি মোটামুটি মেনে নিতে পেরেছে, তখন আমাদের দেশ তথা কিছু রাজ্য (এ রাজ্যও!) আবার পাশ ফেল প্রথা চালু করে পিছনে যেতে চাইছে! ভারতবর্ষের ধনুর্ভাঙা পণ: বিশ্ব সংসার থেকে সে কিছুই শিখবে না! তাই তার নীতিতে শিক্ষায় ব্যয়বরাদ্দ বাড়ে না, যেটুকু থাকে তাতেও মৌলিক শিক্ষা প্রাধান্য পায় না। জাপান বা ইংল্যান্ড, কোরিয়া, জার্মানি— যে সব দেশ শিক্ষায় প্রগতি ঘটিয়েছে, তারা প্রথমেই মৌলিক শিক্ষাকে বিকশিত করেছে। কেউ বলেনি শিশুরা নিজেদেরটা নিজেরা বুঝে নিক। শিশুকেন্দ্রিক সেই ব্যবস্থায় তারা যে মূল্যায়ন করে, তাতে শিশুকে ফেল বা পাশ করানোর কথা নয়। ভাবা হয়, তাদের যতটা দেওয়ার কথা, ততটা দেওয়া গেল কি না, কোথায় কোথায় খামতি রইল বা কোথায় জোর দিতে হবে, যাতে সব শিশুই উৎকর্ষ অর্জন করতে পারে। এটাই শিশুকেন্দ্রিক দর্শন।

যুক্তি দেওয়া হয়, বহির্বিশ্বে যে পরিকাঠামো রয়েছে, তার পরিপ্রেক্ষিতে যে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে, আমাদের দেশে তা সম্ভব নয়! প্রসঙ্গত, এখনও বহু শিক্ষক, নীতি-নির্ধারক বা অন্যান্যরা আছেন, যাঁরা পাশ-ফেল প্রথা তুলে দেওয়ার নীতি মন থেকে গ্রহণ করতেই পারেননি, নিয়ম হয়েছে বলে মেনে চলেছেন। তাঁদের ভাবনার ভিত হল, ব্যর্থতার ভয়ের তাড়নাতেই শিশু শিখতে পারে। যদি এখনও এটাই সাধারণ বিশ্বাস হয়, তবে সংস্কারের গোড়াতেই ঘাটতি রয়ে গেছে। নৈতিক ভাবে যদি বিষয়টাকে আমরা অনুধাবন করতে না পারি, তবে কোনও দিনই মৌলিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না।

তা বলে কি মূল্যায়ন থাকবে না? নিশ্চয়ই থাকবে। কিন্তু তা মুখস্থবিদ্যার জোরে সবটুকু শেখা বছরের শেষে এক দিনে উগরে দিয়ে নয়, বরং সারা বছর ধরে নিয়মিত পারস্পরিক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে। শিশুর উপর পরীক্ষা নামক ভৌতিক চাপ না দিয়ে, সে কতটা শিখল তা ঠিক ঠিক যাচাই করতে পারাটাই হতে পারে যথাযথ মূল্যায়নের সংজ্ঞা। এই উদ্দেশ্যেই ২০০৯-এ বিগত কেন্দ্রীয় সরকারের আমলে বিনামূল্যে আবশ্যিক শিক্ষা আইন করে পাশ-ফেল প্রথা উঠিয়ে ধারাবাহিক সার্বিক মূল্যায়ন (কন্টিনিউয়াস কমপ্রিহেনসিভ ইভ্যালুয়েশন) ব্যবস্থার প্রবর্তন করা হয়। এ রাজ্যে পূর্ববর্তী সরকার অবশ্য সেই আশির দশকেই প্রাথমিক স্তরে পাশ-ফেল প্রথা তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। বর্তমান সরকার তত দ্রুতই প্রথম শ্রেণি থেকেই পাশ-ফেল প্রথা ফেরাতে তৎপর হয়ে উঠেছেন।

শোনা যাচ্ছে, পাশ-ফেল প্রথা না থাকার কারণেই নাকি শিক্ষা ব্যবস্থার ক্রমশ অবনতি ঘটছে। ঘটনা হল, উপযুক্ত মূল্যায়ন ব্যবস্থা না থাকলে পাশ-ফেল তুলে দেওয়াটাই সমাধান হতে পারে না। অথচ ধারাবাহিক সার্বিক মূল্যায়ন ব্যবস্থাটা আসলে কী, সে কথা বুঝতেই সময় লেগে গেল অনেকটা। পদ্ধতিটা সম্পর্কে স্বচ্ছতার অভাবে সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন অধিকাংশই। প্রতীচী (ইন্ডিয়া) ট্রাস্ট এবং ক্রাই-এর যৌথ উদ্যোগে ধারাবাহিক সার্বিক মূল্যায়ন ব্যবস্থার উপর আয়োজিত একটি সাম্প্রতিক আলোচনাসভায় শিক্ষকদের অধিকাংশের অভিযোগ ছিল, তাঁদের এই নতুন ব্যবস্থাটা বোঝার মধ্যেই অনেকখানি ফাঁক থেকে গেছে। সে ক্ষেত্রে তো দরকার ছিল সরকারি প্রয়াসে এই মূল্যায়ন পদ্ধতিটি সম্পর্কে স্কুলগুলিকে আরও সুস্পষ্ট ভাবে অবহিত করা। কোনও পদ্ধতিই ফলপ্রসূ হয়েছে কি হয়নি, তিন-চার বছরের মধ্যে সে বিষয়ে সিদ্ধান্তে আসা যায় না, বিশেষত যেখানে পদ্ধতিটি রূপায়ণেই অনেকখানি ফাঁক থেকে গেছে। তা ছাড়া, এমন কোনও উদাহরণও কি দেওয়া যেতে পারে যে ফেল করার ফলে কোনও শিশু বা ছাত্রের উন্নতি হয়েছে! বরং সাদা চোখে তা আমরা ফেল করা ছাত্রদের বরাবরই দূরে সরিয়ে রেখেছি। শিক্ষাব্যবস্থার নীতিকাররা এই গোড়ার কথাগুলো একটু ভাববেন না?

প্রতীচী ইনস্টিটিউটে কর্মরত

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE