ছবি: হিমাংশুরঞ্জন দেব
ইদানীং নাকি থিমও আর বৈচিত্র আনিতেছে না। চারটি মণ্ডপ ঘুরিলে নাকি একই থিম দুই বার দেখিবার সম্ভাবনা, ওয়েস্ট ইন্ডিজ়ের সহিত টেস্ট ম্যাচ চার দিনের মধ্যে ফুরাইয়া যাইবার সম্ভাবনার সমতুল। তবে, দুর্গাপূজা সংক্রান্ত একটি থিম এখনও বদলায় নাই। অদূর ভবিষ্যতে বদলাইবে, সেই সম্ভাবনাও ক্ষীণ। তাহার নাম মহিষাসুরমর্দিনী। মহালয়ার প্রভাতে বঙ্গবাসীর শারদসূচনা। বাঙালির পূজা, অতএব, বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র বা পঙ্কজকুমার মল্লিকের নামোল্লেখ ব্যতীত কাটে না। সেই বেতার অনুষ্ঠানে কী এমন আছে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম যাহার টানে ভোররাত্রে রেডিয়ো খুলিয়া বসে? এই প্রশ্নের উত্তর অন্যত্র। আপাতত একটি ভিন্ন প্রশ্ন— শুধু তো মহিষাসুরমর্দিনীই বাঙালির পূজা সংস্কৃতির অঙ্গ ছিল না। আরও অনেক কিছুই ছিল। যেমন, পূজার গান, জলসা, সাহিত্য, সিনেমা। তাহার কিছু টিকিয়া আছে, আর কিছু হারাইয়া গিয়াছে। যেগুলি থাকিল, সেগুলি কেন থাকিল? আর, যেগুলি হারাইয়া গেল, সেগুলি থাকিতে পারিল না কেন? পূজার জলসাই যেমন। একদা কলিকাতা ও শহরতলিতে পূজার বড় আকর্ষণ ছিল এই জলসাগুলি। সাধারণ মানুষ রাত জাগিয়া অপেক্ষা করিতেন, কখন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মন্দ্র কণ্ঠস্বর ভাসিয়া আসিবে, কখন গাহিবেন শ্যামল মিত্র বা মানবেন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অথবা কখন পিন্টু ভট্টাচার্যের প্যারডিতে খুলিবে পরিচিত গানের নূতন রূপ। শ্রোতাদের অনুরোধে শিল্পীরা সাগ্রহ গাহিতেন তাঁহাদের পূজার গান— বঙ্গজীবনের আরও একটি অবলুপ্ত অনুষঙ্গ। সেই জলসাগুলি হারাইয়া গেল কেন?
অনুমান করা চলে, অনেকগুলি কারণ আছে। যেমন, গত কয়েক দশকে পশ্চিমবঙ্গের বাহিরে, দেশের অন্য শহরে এবং অতি অবশ্যই বিদেশে, বাংলা গানের অনুষ্ঠানের সংখ্যা বাড়িয়াছে। সেখানে দক্ষিণার পরিমাণও বেশি। ফলে, আকাশে শরতের মেঘ ভাসিবার পূর্বেই খ্যাতনামা শিল্পীরা শহর ছাড়িতেছেন। কিন্তু, তাহাই একমাত্র কারণ নহে। গান বস্তুটি আর কেবল শ্রাব্য থাকে নাই। ভিডিয়োর আগমনে গান ক্রমেই দৃশ্য হইয়াছে, এবং বর্তমান স্মার্টফোনের যুগে সেই দৃশ্যই গানের একমাত্র রূপ হইয়া দাঁড়াইয়াছে। অতএব, শুধু গায়ক বা গায়িকাকে শুনিতে অথবা দেখিতে আজিকার শ্রোতার আর আগ্রহ নাই। তাঁহারা পুরাদস্তুর প্যাকেজ চাহেন। সেই চাহিদা পূরণও হয়, কিন্তু পূজা তাহার প্রকৃষ্ট সময় নহে। অতএব, পূজার জলসা গিয়াছে। কিন্তু, সিনেমা যায় নাই। কারণ, গত শতকের ষাট বা সত্তরের দশকের তুলনায় সিনেমায় প্রযুক্তিগত উন্নতি বিপুল পরিমাণে হইলেও মাধ্যমটির প্রতি গ্রাহকের চাহিদা মৌলিক ভাবে অপরিবর্তিত। এই পূজাতেও যতগুলি বাংলা সিনেমা মুক্তি পাইয়াছে, সেই সংখ্যা এই তত্ত্বকেই সমর্থন জোগাইবে।
অর্থনীতির তত্ত্বে ‘পাথ ডিপেন্ডেন্সি’র ধারণাটি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ, একই বিন্দু হইতে যাত্রা শুরু করিয়াও, যাত্রাপথের পার্থক্যের কারণে দুইটি বিষয়ের অন্তিম ফলাফলের মধ্যে বিপুল ফারাক থাকিতে পারে। গানের জলসা এবং বাংলা ছবির মধ্যে ফারাকটিও সেই ‘পাথ ডিপেন্ডেন্সি’র মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। জলসার ক্ষেত্রে জনপ্রিয়তা কমিয়াছে বলিয়া গায়করাও আগ্রহ হারাইয়াছেন, এবং গায়করা আগ্রহী নন বলিয়া মানুষের চাহিদাও হ্রাস পাইয়াছে। এক সময় দুই-ই এমন একটি স্তরে নামিয়া গিয়াছে যে তাহার পর অনুষ্ঠানগুলির কোনও তাৎপর্যই বাঁচে নাই। অন্য দিকে, যে হেতু ক্রমাগত ছবি নির্মিত হইয়াছে, মানুষেরও আগ্রহ বাড়িয়াছে, এবং সেই বর্ধমান আগ্রহ আরও ছবির জন্ম দিয়াছে। ঠিক যেমন, বহু মানুষের নিকট মহিষাসুরমর্দিনী বঙ্গসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বলিয়া আরও বহু মানুষের নিকট তাহা অবিচ্ছেদ্য হইয়াছে। সংস্কৃতি এই পথেই চলে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy