প্রযুক্তি সময়ের ব্যবধান বিলুপ্ত করিয়া দিয়াছে। সময়ের জ্ঞানও। নিমেষে চরাচরে বাহিত হইতেছে তথ্য, প্রেম, ঘৃণা, বন্ধুত্ব ইত্যাদি। পলক না ফেলিতে মোবাইল যোগে অনুভূতি, আবেগ, হাস্যরস আছড়াইয়া পড়িতেছে মন হইতে মনান্তরে। এবং প্রায়শই গোল বাধিতেছে মূহূর্তকালের ব্যবধানে। কেহ বেখেয়াল হইয়া যে বার্তা পাঠাইবার নহে, তাহা পাঠাইয়া দিতেছে। কেহ রাগ সপ্তমে চড়িবামাত্র তাহা বিন্দুমাত্র সম্পাদনা না করিয়া ছুড়িয়া দিতেছে, কেহ অশালীন বার্তা বা অস্বস্তিকর ছবি ভুলবশত পাঠাইয়া হা-হুতাশে ব্যস্ত হইতেছে। কিন্তু বিড়ম্বনাই সার। এই সমস্যার মোকাবিলায় হোয়াট্সঅ্যাপ অ্যাপ্লিকেশন নির্মাতারা এই অ্যাপটির ব্যবহারিক প্রয়োগ আরও উন্নত করিবার চেষ্টা করিতেছেন। এই পথে কোনও বার্তা পাঠাইলে তাহা পাঁচ মিনিট অবধি ফের ফিরত লওয়া যাইবে এবং প্রয়োজনে সংশোধন করিয়া পাঠানো যাইবে। ইহাতে অনেকেরই উপকার হইতে পারে। মুহূর্তের রাগ, অন্যমনস্কতা বা ভুল ভাবে পাঠানো বার্তা যে যথাযথ না-ও হইতে পারে, তাহা বুঝিবার ক্ষমতা হয়তো সেই পলে মানুষের থাকে না। পরমুহূর্তেই সম্বিৎ ফিরিলেও উচ্চারিত শব্দ, নিক্ষেপিত তিরের মতোই, ফিরাইবার পথ থাকে না। হোয়াটসঅ্যাপের দুনিয়ায়, থাকিবে।
প্রযুক্তির এই বিস্ফোরণের পূর্বে অনুভূতি আদানপ্রদানের মূল মাধ্যম ছিল চিঠিপত্র, পরবর্তী কালে দূরভাষ। কিন্তু চরম আবেগপ্রবণতা বা রাগের সময় সচরাচর কেহই চিঠি লিখিতে বসিত না কিংবা লিখিলেও তীব্র মনের ভাব লিখিবার সময় তাহা কিছুটা স্তিমিত হইয়া আসিত। দূরভাষে যোগাযোগও এত সহজ ছিল না। লাইন পাইলেও সব সময় মানুষটিকে না-ও পাওয়া যাইতে পারিত। ফলে, বলিবার বা লিখিবার সময় তীব্রতা ও আবেগের মাত্রা কমিয়া যুক্তির গণ্ডিতে আসিয়া ভাব প্রকাশ করা হইত। সেই প্রকাশের মধ্যে নিজেকে যাচাই করিয়া লইবার ঈষৎ সময় পাওয়া যাইত। ভাবিয়া দেখিবার সময় ছিল, যে প্রকারে মনের ভাব প্রকাশ করা হইতেছে তাহা কত দূর উচিত বা অনুচিত, অপরকে তাহা আঘাত করিতে পারে কি না। অনুভূতি প্রকাশের অধিকার প্রত্যেকেরই রহিয়াছে। কিন্তু সেই অধিকার কত দূর প্রয়োগযোগ্য, তাহা নিজেকেই যাচাই করিয়া লইতে হয়। যাচাই করিয়া লওয়া ভাল। সভ্যতার বোধ অন্তত তাহাই শেখায়।
কিন্তু শিখাইলেও তাহা প্রয়োগের সময় বা ইচ্ছা আজ আর কাহারও নাই। নাই বলিয়াই হোয়াট্সঅ্যাপে নূতন ব্যবহারিক রক্ষাকবচটি যোগ করিতে হইতেছে। ইহা যুগেরই চাহিদা। লজ্জা ও বিড়ম্বনা হইতে মুক্তি দিবার প্রয়াস। কিন্তু এই বিড়ম্বনা ও লজ্জায় পড়িতে হয় কেন? হয়, কারণ দ্রুত যুগের সহিত তাল মিলাইয়া চলিতে চলিতে সব কিছুই অত্যন্ত দ্রুততায় হাতের নাগালে পাইবার একটি অভ্যাস মানুষের মধ্যে তৈরি হইয়া গিয়াছে। সবই সে ক্ষণিকে আয়ত্ত করিয়া ফেলে। সেই কাঠামোর মধ্যে পড়িয়া অনুভূতি প্রকাশের প্রক্রিয়াটিও দ্রুততার ভুলভুলাইয়ায় ঢুকিয়া পড়িয়াছে। অন্যান্য বহু পণ্যের মতো নিবিড়তম অনুভূতিকেও ক্ষণিকের প্রেক্ষিতে ব্যবহার করা হইতেছে। এই অভ্যাসের তাড়নায় নিজের অনুভূতির প্রতি অ-সচেতন হইয়া পড়িয়াছে মানুষ। প্রযুক্তি তাহাকে আত্মসংশোধনের সুযোগ আনিয়া দিল। তবে সময় মাত্র পাঁচ মিনিট।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy