নরেন্দ্র মোদীর অনেক কিছুই বলিবার ছিল। অথচ, কোনও কথাই বলিবার উপায় তিনি রাখেন নাই। কংগ্রেস আক্রমণ শানাইতেছে, সোশ্যাল মিডিয়ায় সাধারণ মানুষের কণ্ঠস্বরও চড়িতেছে। ২০১৪ সালের জুন মাসে আন্তর্জাতিক বাজারে যখন অপরিশোধিত পেট্রোলিয়ামের দাম ব্যারেল-প্রতি ১০৭ ডলার ছিল, মুম্বইয়ে এক লিটার পেট্রোলের দাম ছিল ৮০ টাকা। এখন এক ব্যারেল তেলের দাম ৫৩ ডলার— অর্থাৎ, ২০১৪ সালের অর্ধেক। অথচ, মুম্বইয়ে এখন এক লিটার পেট্রোলের দাম ৭৯.৪৮ টাকা। কংগ্রেস প্রশ্ন করিয়াছে, মনমোহন সিংহের আমলে তেলের মূল্যস্তর বিজেপির মতে ‘অর্থনৈতিক সন্ত্রাস’ হইলে এখনকার অবস্থাকে কী বলা চলে? এই প্রশ্নের যথার্থ উত্তর দেওয়ার অবকাশ প্রধানমন্ত্রী নিজের জন্য রাখেন নাই। উত্তরটি হইল, মনমোহন সিংহের আমলে সরকার অন্যায় করিতেছিল বটে, কিন্তু সেই অন্যায় তেলের দাম বৃদ্ধি নহে। প্রকৃত অন্যায় ছিল, তেলের দাম যতখানি হওয়া উচিত ছিল, সরকার তাহার কম আদায় করিতেছিল। বাকি টাকা মেটানো হইতেছিল ভরতুকির মাধ্যমে। এবং, সেই ভরতুকি, স্বভাবতই, আসিতেছিল রাজকোষ হইতে, অথবা রাজকোষ ঘাটতি হইতে— অর্থাৎ, আজ হউক বা কাল, সে টাকা দেশের সাধারণ মানুষের পকেট হইতে যাইতেছিল। যাঁহাদের কখনও পেট্রোল কিনিবার সৌভাগ্য হইবে না, তাঁহাদেরও পরোক্ষ কর দিতে হয়। সেই করের টাকায় তেলের দামে ভরতুকি দেওয়া ছিল প্রকৃত অন্যায়। এই কথাটি বলিলে মধ্যবিত্তের মন জিতিবার রাজনীতি হয় না। ফলে, নরেন্দ্র মোদী তখন এই কথা বলেন নাই। আজ তিনি কী ভাবে বলিবেন, মনমোহন সিংহের আমলে পেট্রোলের দাম যত হওয়া উচিত ছিল, দাম তাহার ঢের কম ছিল।
পেট্রোলিয়ামের দাম ‘এত বেশি’ কেন, প্রধানমন্ত্রী সেই প্রশ্নের উত্তর দেন নাই। হয়তো ভাবিয়াছেন, সত্যটি জানাজানি হইলে ভোট কমিয়া যাইবে। বাড়তি টাকার কতখানি কররাজস্ব হিসাবে রাজকোষে ঢুকিতেছে, আর কতখানি দাম ভরতুকি তুলিয়া দেওয়ার ফলে বাড়িতেছে, সেই হিসাব জনসমক্ষে পেশ করিলেই বিতর্ক থাকিত না। পেট্রোলিয়ামের ন্যায় পরিবেশ-প্রতিকূল পণ্যের দাম বাড়া এমনিতেও ভাল। তাহাতে যদি চাহিদা কমে, পরিবেশ বাঁচিবে। বিদেশি মুদ্রাও বাঁচিবে। সহজ কথা, পেট্রোলের দাম চড়া থাকিলে অর্থনৈতিক ভাবে পিছাইয়া প়়ড়া মানুষদের লাভ, যাঁহারা তেমন ভাবে পেট্রোলিয়াম পণ্য ব্যবহার করিতে পারেন না বটে, কিন্তু তাহার মাশুল গণিতে বাধ্য থাকেন। ঠিক ভাবে সত্য কথাগুলি বলিলে তাহা ইতিবাচক রাজনীতিই হইবে।
কিন্তু, সেই কথা বলিবার পূর্বে নরেন্দ্র মোদীকে স্বীকার করিতে হইবে, ২০১৪ সালের পূর্বে তিনি সজ্ঞানে অপপ্রচার করিতেন। পেট্রোল-ডিজেলের দাম সংক্রান্ত সত্যটি তিনি বিলক্ষণ জানিতেন, কিন্তু মধ্যবিত্তের ভোট পাইবার জন্য সেই সত্য চাপিয়া গিয়াছিলেন। তাঁহাকে স্বীকার করিতে হইবে, বিদেশ হইতে কালো টাকা ফিরাইয়া আনিবার প্রসঙ্গে অথবা কর্মসংস্থানে গতি আনিবার প্রসঙ্গে তিনি যেমন ‘জুমলা’ করিয়াছিলেন, পেট্রোলিয়ামের দামের ক্ষেত্রেও তাহাই। বস্তুত, তাঁহাকে স্বীকার করিয়া লইতে হইবে, অর্থনীতি সংক্রান্ত যতগুলি কথা তিনি ২০১৪ সালের পূর্বে বলিতেন, তাহার কোনওটিতেই অর্থনীতি ছিল না। ছিল শুধু মিথ্যার রাজনীতি। এই কথাগুলি বলা তাঁহার পক্ষে অসম্ভব। ফলে, এখন তাঁহাকে কিল হজম করিতে হইতেছে। কেন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম অর্ধেক হইবার পরও তাঁহার জমানায় পেট্রোল মহার্ঘ, সেই উত্তর তাঁহার মুখে নাই। রাজনীতির কড়ায় লোক ভুলাইবার তৈলে অর্থনীতির যুক্তিকে ভাজিলে শেষ অবধি তাহার কী ফল হয়, নরেন্দ্র মোদী সম্ভবত টের পাইতেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy