কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়ন্ত সিন্হা। ছবি: সংগৃহীত।
রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা তো থাকবেই। কিন্তু সাংবিধানিক বা গণতান্ত্রিক বাধ্যবাধকতাটা আরও গুরুত্বপূর্ণ নয় কি? দেশের মন্ত্রী হওয়ার পরেও যদি কারও এই উপলব্ধিটুকু না থাকে, তা হলে বড় দুর্ভাগ্যজনক ছবি তৈরি হয়। যেমনটা হয়েছে ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগে।
গোরক্ষার নামে মানুষ খুনের অভিযোগ। ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে দোষী সাব্যস্ত। সাজাও ঘোষিত। সে রায়কে হাইকোর্টে চ্যালেঞ্জ জানায় আসামিরা। রায়ে স্থগিতাদেশ দিয়ে ৮ জনকে জামিন দেয় হাইকোর্ট। মামলা শেষ হয়নি, নতুন করে বিচার হবে। কিন্তু জামিনকেই শংসাপত্রের রূপ দেওয়ার চেষ্টা হল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী জয়ন্ত সিন্হার বাড়িতে সাদর অভ্যর্থনা পেলেন জামিনে মুক্তরা, মালা পরিয়ে তাঁদের স্বাগত জানালেন মন্ত্রী, এক পঙ্ক্তিতে দাঁড়িয়ে বুক ফুলিয়ে মন্ত্রী ছবিও তুললেন তাঁদের সঙ্গে।
গোরক্ষার নামে মানুষ খুনে অভিযুক্ত যাঁরা, তাঁরা জামিন পেতেই তাঁদের নিয়ে এমন মাতমাতি এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর! বিস্মিত হতে হয়। বিস্মিত হয়েওছে এক বিরাট জনগোষ্ঠী। তীব্র বিতর্ক ছড়িয়েছে। কিন্তু মন্ত্রী জয়ন্ত যেন অবিচলিত, নিজের অবস্থানে অবিচল, একেবারেই ক্ষমপ্রার্থী নন, কোনও অনুশোচনা নেই। মন্ত্রীর সাফাই হল— যা করা হয়েছে, আইনকে সম্মান জানিয়েই করা হয়েছে।
সম্পাদক অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা আপনার ইনবক্সে পেতে চান? সাবস্ক্রাইব করতে ক্লিক করুন
আইনকে কী ভাবে সম্মান জানানো হল? জয়ন্ত সিন্হার বক্তব্য— ফাস্ট ট্র্যাক কোর্ট যে রায়ই দিক, পরবর্তী কালে হাইকোর্টে গিয়ে সে রায় তো স্থগিত হয়েছে। অর্থাৎ জয়ন্ত সিন্হা বলতে চাইছেন, অভিযুক্তরা নতুন করে দোষী সাব্যস্ত না হওয়া পর্যন্ত, তাঁদের অপরাধী বলা যাবে না।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর সাফাইটা যদি এই রকম হয়, তা হলে দু’টো প্রশ্ন তোলা যায় পাল্টা।
আরও পড়ুন
খুনের আসামিকে মালা গোরক্ষকদের, প্যাঁচে মন্ত্রী
প্রথম প্রশ্ন— ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে যাঁরা অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিলেন, হাইকোর্ট কি তাঁদের নিরপরাধ আখ্যা দিয়েছে? উত্তর হল— দেয়নি, শুধু সাজা স্থগিত করে জামিনে মুক্তি দিয়েছে, নতুন করে বিচারের বন্দোবস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ অপরাধী বলা না যাক, নির্দোষও বলা যাচ্ছে না ওই ৮ জনকে। তা হলে এই মুহূর্তে কি নিজের বাড়িতে তাঁদের অভ্যর্থনা জানানো উচিত ছিল একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর?
দ্বিতীয় প্রশ্ন— যদি ধরেও নিই যে, দেশের আইনি কাঠামো অনুযায়ী কোনও অন্যায় কাজ জয়ন্ত সিন্হা করেননি, তা হলেও কি এই অভ্যর্থনা মানায়? গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ বলতে আমরা যা বুঝি, তা তো আইনের বইয়ে হুবহু লেখা থাকে না। আইনের ধারা-উপধারা বা ফৌজদারি বিধি বা দণ্ডবিধির যে সুনির্দিষ্ট এবং স্থূল কাঠামো, তাকে ঘিরে প্রলেপের মতো বিরাজ করে এক সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধি। সেই বিচারবুদ্ধি বা উপলব্ধি বা মূল্যবোধই তো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন আইনের ব্যাখ্যাটা খুঁজে দেয়। একজন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী কি সেই সূক্ষ্ম বিচারবুদ্ধিকে অস্বীকার বা নস্যাৎ করতে পারেন? নাকি তেমনটা করা উচিত? হাইকোর্ট জামিন দিয়েছে, এই দোহাই দিয়ে গোরক্ষার নামে মানুষ খুনের দায়ে অভিযুক্ত একটা দঙ্গলকে নিজের বাসভবনে সাদরে অভ্যর্থনা জানানো কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর উচিত হল? দেশ কি খুব ইতিবাচক বার্তা পেল এই ঘটনায়?
দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গের এই দায়িত্বজ্ঞানহীন কার্যকলাপে দুষ্কৃতীরা উৎসাহিত হয়। জয়ন্ত সিন্হা যা করলেন, তাতে সাম্প্রদায়িক খুনোখুনি কোথাও যেন মহিমান্বিত হল। জয়ন্ত সিন্হার দল যে রাজনীতিতে বিশ্বাসী, তাতে জয়ন্তর এই পদক্ষেপ দলের পক্ষে হয়তো লাভজনক হতে পারে। কিন্তু দেশের পক্ষে এ ছবি কিছুতেই মঙ্গলজনক হতে পারে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy