Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪
কী করবে রাজ্য কংগ্রেস, চাপ এ বার হাইকম্যান্ডের উপর

মমতার ব্রিগেড কৌশল

জাতীয় রাজনীতির বিজেপি-বিরোধী কুশীলবদের নিয়ে ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেড ভরাবেন বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন মমতা ।

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

ব্রিগেড সমাবেশ ডাকলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২১ জুলাইয়ের মঞ্চ থেকে আগামী লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূলের জন্য রাজ্যে ৪২-এর মধ্যে ৪২ আসন দখলের ডাক দেওয়ার পাশাপাশি তিনি জাতীয় রাজনীতির বিজেপি-বিরোধী কুশীলবদের নিয়ে ১৯ জানুয়ারি ব্রিগেড ভরাবেন বলে ঘোষণা করে দিয়েছেন। তাঁর এই পদক্ষেপে দু’টি জিনিস স্পষ্ট। এক, দেশে বিরোধীদের জোটবদ্ধ লড়াইয়ের উদ্যোগে মমতা অগ্রণী হয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা নিতে চান। এবং দুই, সেই জোট অন্যত্র যা-ই হোক, এই রাজ্যে তিনি লড়তে চান একাই।

জাতীয় স্তরে বিরোধীদের জোট তুলে ধরতে ব্রিগেড প্যারেড ময়দান অতীতে ইতিহাস তৈরি করেছিল। আজও যা আলোচনার বস্তু। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ তখন কংগ্রেস ভেঙে জনমোর্চা তৈরি করে রাজীব গাঁধীর বিরুদ্ধে বিরোধীদের এক মঞ্চে আনার ‘নায়ক’ হয়ে উঠছেন। লালুপ্রসাদ যাদবের পরামর্শে জ্যোতি বসু বিরোধী নেতাদের নিয়ে ১৯৮৮ সালের ২ জুলাই ব্রিগেডে ভি পি সিংহকে সংবর্ধনা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। সেই মঞ্চে ছিলেন বিজেপির শীর্ষনেতা অটলবিহারী বাজপেয়ীও। বিশাল জমায়েতে ভিপি-কে মাঝখানে রেখে হাতে হাতে ‘জোট’ গড়েছিলেন জ্যোতিবাবু এবং বাজপেয়ী। দেশের রাজনৈতিক অ্যালবামে এ এক ‘বিরলতম’ ছবি।

ব্রিগেড মমতাও আগে ভরিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রী বা তৃণমূল নেত্রী হওয়ারও আগে যুব কংগ্রেস সভানেত্রী থাকাকালীন একক চেষ্টায় ব্রিগেডে সিপিএম-বিরোধী সভা ভরিয়ে দিয়ে তিনি নজর কেড়েছিলেন। তার আগে পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে না এনে কংগ্রেস ব্রিগেড ভরানোর কথা ভাবতেও পারত না। সেটা খুব অহেতুকও নয়। সমাবেশস্থলের বিশালতা বিচার করলে নেতার ওজন ভাবতেই হয়। মমতা পেরেছিলেন তাঁর ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তায়। এখন পর্যন্ত সভায় ভিড় হওয়া নিয়ে তাঁকে বিশেষ ভাবতে হয় না। ভিড় জুটে যায়।

অতএব সেই মমতা ব্রিগেডে সভা ডাকলে তার সাফল্য সম্পর্কে সংশয় থাকার কথা নয়। তার উপর সেখানে সনিয়া-রাহুল থেকে শুরু করে সর্বভারতীয় বিরোধী নেতারা যদি উপস্থিত থাকেন, প্রাক-নির্বাচনী রাজনীতিতে তার চেয়ে বড় আর কী বা হতে পারে!

কিন্তু মমতার দিক থেকে দেখলে তাঁর এ বারের সমাবেশের চ্যালেঞ্জটা অন্য রকম। একটু কুশলীও বটে। ভিপি-কে নিয়ে বিরোধীদের ব্রিগেড করার সময় রাজীবের বিরুদ্ধে তিনিই ছিলেন নেতৃত্বের মুখ। তাঁকে ভাবী প্রধানমন্ত্রী মেনে নিতে কোথাও কারও কোনও দ্বিমত ছিল না। বস্তুত সেটাই হয়েছিল। সেই সরকার কেন টিকতে পারেনি, সেটা অন্য আলোচনা। তবে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে বিরোধী-মুখ হয়ে উঠতে সেই সময় ভিপি-র সামনে অন্য কোনও দাবিদার ছিলেন না।

এখন পরিস্থিতিটা একটু ভিন্ন। মমতার প্রস্তাবিত ফেডারাল ফ্রন্টই হোক, বা কংগ্রেসের উদ্যোগে বিরোধীদের জোট— নেতা কে, এখনও খোলা গলায় অনেকেই সেটা বলতে চাইছেন না। আলোচনা হচ্ছে, গোপন শলাপরামর্শ চলছে, প্রকাশ্যে বিবৃতি দেওয়ারও কসুর নেই। কিন্তু কাকে সামনে রেখে বিজেপির বিরুদ্ধে সম্মিলিত লড়াই দানা বাঁধবে, সেই পাকাপাকি নামটি এখনও উহ্য।

তবে বাসনা অতি বিষম বস্তু। সকলের পক্ষেই এটা প্রযোজ্য। কংগ্রেস থেকে মমতা এবং মায়াবতীর নাম ভাসিয়ে দেওয়ার পরে খেলা তাই আরও জমজমাট। মমতা যদিও গোড়া থেকেই বলে আসছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে লালায়িত নন। বলেছেন, ‘‘আমি চেয়ারকে কেয়ার করি না।’’ কিন্তু রাহুল গাঁধীর দল থেকে মমতাকে প্রধানমন্ত্রী করার আগাম ইঙ্গিত দেওয়া রাজনৈতিক মহলে কৌতূহল বাড়িয়ে দিল। কোনটা সত্যি, কোনটা মায়া— কে বলবে? তবে ধরে নেওয়া যেতেই পারে, আগামী কয়েক মাসে বিজেপি-বিরোধী জোট নিয়ে ধোঁয়াশা অনেকটা কাটবে। নেতৃত্বের ছবিটাও হয়তো পরিষ্কার হবে। দুধ ও জল আলাদা করতে বিশেষ অসুবিধা থাকবে না।

কিন্তু অন্য রাজ্যগুলির চেয়ে এই রাজ্যে রাজনৈতিক বোঝাপড়ার বাস্তব ছবিটা এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে আলাদা। উত্তরপ্রদেশে অখিলেশ-মায়াবতী কিংবা বিহারে লালুপ্রসাদের দল থেকে শুরু করে অন্ধ্রে চন্দ্রবাবু, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা, শরদ পওয়ারেরা কেউই খুব সম্ভবত নিজেদের রাজ্যে একা লড়বেন না। বরং কংগ্রেসের সঙ্গে বোঝাপড়ার সম্ভাবনাই প্রবল। ওই রাজ্যগুলিতে কংগ্রেস এখনও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে যায়নি, এটাও ঘটনা।

অন্য দিকে মমতার রাজ্যে দল ভাঙা এবং ভাঙিয়ে নেওয়ার ধাক্কায় কংগ্রেস আজ খুবই শোচনীয় অবস্থায় পৌঁছেছে। সিপিএমের হালও তথৈবচ। ফলে আপাতবিচারে তৃণমূল এখানে বিজেপির বিরুদ্ধে একক ভাবে লড়াই করার অবস্থায় রয়েছে। পুরনো অভিজ্ঞতায় মমতা আরও দেখেছেন, একা লড়েও তাঁর সংখ্যাগরিষ্ঠতায় চিড় ধরে না। সুতরাং এই অবস্থান বজায় রেখে অর্থাৎ রাজ্যে কংগ্রেসকে আসন না দিয়েই তিনি বোঝাপড়া করার পক্ষপাতী। তাই তিনি সে দিনও বলেছেন, রাজ্যে ৪২টি লোকসভা আসন জেতাই এ বার তৃণমূলের লক্ষ্য।

মমতার সঙ্গে জোট করার জন্য রাজ্যের কংগ্রেসও যে খুব উৎসাহী, তা নয়। প্রদেশ কংগ্রেসের শীর্ষনেতারা খোদ রাহুল গাঁধীর কাছে এই ব্যাপারে দরবারও করে এসেছেন বলে খবর। এই অবস্থায় এখানে মমতা এবং কংগ্রেস যদি পরস্পরের বিরুদ্ধে ভোট লড়ে, তা হলে বিরোধী ঐক্যের ছবিতে চিড় থাকবেই।

আর সে ক্ষেত্রে ব্রিগেডের মঞ্চ কী দেখাবে? মমতা বলেছেন, সনিয়া, রাহুল-সহ বিরোধীদের সকলকেই তিনি আমন্ত্রণ জানাবেন। এমনকি সিপিএমকেও তিনি অচ্ছুৎ রাখবেন না। বিরোধী ঐক্যের মঞ্চ অটুট রাখার জন্য এটা নিশ্চয় বাঞ্ছনীয়। কিন্তু তাঁরা এসে বিজেপিকে হারানোর জন্য একের বিরুদ্ধে এক প্রার্থীর কথা বলবেন, আবার এখানেই কংগ্রেস এবং সিপিএম লড়বে তৃণমূলের বিরুদ্ধে— এর চেয়ে অদ্ভুত পরিস্থিতি কী হতে পারে! বিশেষ করে তৃণমূল এবং কংগ্রেসের মধ্যে রাজ্য স্তরে নির্বাচনী বোঝাপড়ার বিষয়টি পরিষ্কার করে না নিলে উভয় দলের কাছেই তা বিড়ম্বনার কারণ হবে। হয়তো বেশি হবে কংগ্রেসের। সে ক্ষেত্রে পরিস্থিতির মোকাবিলাই হবে এ বারের ব্রিগেডে বড় চ্যালেঞ্জ।

রাজ্যে কাগজ-কলমে এখন কংগ্রেসের চারটি লোকসভা আসন রয়েছে। সিপিএমের দু’টি। সিপিএমের সঙ্গে মমতার আসন বোঝাপড়ার সম্ভাবনা কার্যত শূন্য। হিসাবে না রাখাই ভাল। কিন্তু কংগ্রেসের বেলায় হিসাব কষা সহজ হবে না। কারণ কংগ্রেস যদি সব রাজ্য মিলিয়ে বিরোধী শিবিরে ভাল সংখ্যক আসন পেয়ে উঠে আসে, তখন সরকার গড়ার সময় মমতার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ হওয়া স্বাভাবিক। কারণ এই রাজ্যে মমতাই যে বিপুল সংখ্যক আসনে জিতবেন, এখনও তার ব্যতিক্রম ঘটার মতো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কংগ্রেসের শীর্ষনেতৃত্বও এই ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। তাই বিজেপি-বিরোধী সরকার তৈরির স্বার্থে মমতাকে চটানোর পথে কংগ্রেস হাইকম্যান্ড এখন যাবে বলে মনে হয় না। সেটাই মমতার দর কষাকষির চাবিকাঠি। তা সে রাহুলকে সমর্থন করাতেই হোক, বা অন্য কোনও অঙ্কের নিরিখে।

সবাই জানেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু হয় না। রাজ্য কংগ্রেসকে ভোটের বাংলায় রাহুল গাঁধী ‘নিরস্ত’ করবেন, না কি লড়তে দেবেন, নিশ্চিত বলা কঠিন। তবে এটা বলতেই হবে, বিরোধী-ঐক্য ‘দেখাতে’ মমতার ব্রিগেড সমাবেশের ‘চাল’ সুচিন্তিত। এক ঢিলে অনেক পাখি মারার মতো!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE