যে ক্ষমতা গরিবের কাজে লাগার সামর্থ্য জোগায় নেতাকে, সেটাই রাজনৈতিক ক্ষমতা।
আচ্ছা, কোনও শিক্ষক কি আর এক শিক্ষককে বলেন, “দিনকাল খারাপ, এখন পড়াশোনার সময় নয়”? কিংবা ডাক্তার আর এক ডাক্তারকে, “এই দুর্যোগে দয়া করে চিকিৎসা করবেন না”? বিজ্ঞানী গবেষণা বন্ধ করতে, কিংবা সাহিত্যিক লেখালিখি ভুলে যেতে বলছেন, ভাবা যায়? যায় না। অথচ তৃণমূল নেতা কেমন বিজেপি নেতাকে বলে চলেছেন, কোভিড-১৯ নিয়ে রাজনীতি করবেন না। আমপানে ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, এটা রাজনীতির সময় নয়। বিরোধীরাও পাল্টা বলছেন, তৃণমূলই তো এ সব নিয়ে রাজনীতি করছে। যেন রাজনীতি করা চুরি-জোচ্চুরির মতো মন্দ কাজ। রাজনৈতিক দলের লোকজন যদি রাজনীতি না করবে, তো করবেটা কী?
সঙ্কটকালে যা করতে নেই সেটাই রাজনীতি, পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়িয়ে এ কথা বলতে গেলে মুখে বেধে যাওয়ার কথা। কে ভুলতে পারে ১৯৭৮ সালের বন্যা? সমবেত অবচেতনে রয়ে গিয়েছে তার গল্প। সবে ভোটে জিতে অনেকগুলো পঞ্চায়েতে এসেছে বামফ্রন্ট। গামছা পরে কোমর-জল, বুক-জলে দাঁড়িয়ে থলে থেকে টাকা বার করে বিলি করেছিলেন পঞ্চায়েত সদস্য আর পার্টির নেতারা। বাংলায় জনপ্রতিনিধির সঙ্গে মানুষের এমন ঘনিষ্ঠ সংযোগ সেই প্রথম। বন্যার ঘোলা জল বাম-চালিত পঞ্চায়েত ব্যবস্থার শক্ত জমি তৈরি করল। ভূমি-সংস্কার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেল পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে। চাষিদের মিনিকিট বিতরণ করল পঞ্চায়েত, গ্রাম ও জেলা স্তরের রাজনৈতিক নেতারা ব্যাঙ্ককে চাপ দিয়ে কৃষিঋণের ব্যবস্থা করলেন। এ সবই রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল। যার ফলে এক দশকে পশ্চিমবঙ্গে দারিদ্র কমেছিল। তার গোড়ায় ছিল বন্যা মোকাবিলার নীতি। দলীয় নীতিই ছিল সেটা।
বাম আমলেই রাজনীতির সে দিন ভেসে গিয়েছে। এ বার আমপানের পরে চাঁদা তুলে চাল-ডাল-ত্রিপল কিনে সুন্দরবনে পৌঁছনো স্বেচ্ছাসেবীদের রাস্তা আটকে দাঁড়িয়েছেন বেশ কিছু নেতা। দাবি করেছেন, তাঁদের হাতে মালপত্র দিতে হবে, তাঁরা বিলি করবেন। অনেকে রাজি না হয়ে ফিরে এসেছেন। তেমন একটি দলকে প্রশাসনের এক কর্তা পরামর্শ দিয়েছেন, আগে স্থানীয় নেতা আর বিডিওদের বোঝাতে হবে, যারা ত্রাণ বিলি করতে চায়, তারা কোনও দলের লোক নয়। যেন বানভাসি গ্রামের মানুষ ক্ষুধার্ত থাকার চাইতেও বড় ঝুঁকি, অন্য দলের খাবার খাওয়া। না, এ রাজ্যে এটা নতুন কিছু নয়। অন্য দল পাছে কিছু সুবিধে পায়, তার পথ আটকানোই এখন রাজনীতি। তাতে ত্রাণ ফিরে গেল না কি উন্নয়নের টাকা কমে গেল (কৃষকের জন্য কেন্দ্রের অনুদান প্রত্যাখ্যান করেছে পশ্চিমবঙ্গ) তাতে কী এসে যায়।
আরও পড়ুন: স্বপ্ন দেখব বলে কাজও করব
সুষ্ঠু ত্রাণ বিতরণের জন্য সর্বদলীয় কমিটি তৈরি করেছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জেলায় জেলায় দুর্নীতি নিয়ে বিক্ষোভের পরে। যদি ত্রাণের সূচনাতেই এমন ঐক্যের বার্তা দিতেন! যেমন দিয়েছিল কেরল। ২০১৮ সালে ভয়াবহ বন্যার পর মুখ্যমন্ত্রী পিনারাই বিজয়ন রাজ্যের বিরোধী নেতা, কংগ্রেসের রমেশ চেন্নিথালার সঙ্গে একত্র হেলিকপ্টার সফরে যান, দুর্গতদের সঙ্গে কথা বলেন। মুখ্যমন্ত্রীর ডাকা সর্বদলীয় বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, ত্রাণ শিবিরে সব দলই কাজ করবে, তবে দলের পতাকা, ব্যাজ ব্যবহার করবে না কেউ। তা বলে কি দলাদলি হয়নি? কংগ্রেসিরা পরে মুখ্যমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামে। ত্রাণের খরচ অস্বচ্ছ, এমন অভিযোগও ওঠে। বিজয়ন সাংবাদিক বৈঠক করে খরচের হিসেব পেশ করেন। “ওর চেয়ে আমি বেশি দেব,’’ আর, “দিলে আমি দেব নইলে কাউকে দিতে দেব না’’— এর মধ্যে কোনটা রাজনীতি?
আরও পড়ুন: আগ্রাসনকারীর আক্রমণ রুখতে যে যার জায়গা থেকে প্রতিরোধ
দলে-দলে রেষারেষি থাকবে। তা বলে কি আর কিছুই থাকবে না? বিরুদ্ধ দলকে নস্যাৎ করা, নিজে কৃতিত্ব দাবি করা, রাজনৈতিক কর্মসূচির এই একটি দিক বড় হতে হতে আর সব কাজকে যেন গ্রাস করে ফেলেছে। নেতাদের একটি কাজ ছিল মধ্যস্থতা। সহমত তৈরি করা, স্বার্থের সংঘাতের মীমাংসা করা, এলাকায় খুচরো ঝামেলা রুখে দেওয়া। আজ ডাক্তার-নার্স, স্বাস্থ্যকর্মীদের হয়রান করছে কিছু বেয়াড়া লোক, পরিযায়ী শ্রমিকদের পাড়ায় ঢোকা আটকে দিচ্ছে, তখন নেতারা কই? ডাক পড়ছে পুলিশের। ত্রাণের খিচুড়ি থেকে মৃতের সৎকার, সব সামলাচ্ছে পুলিশ। মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, পঞ্চায়েত সদস্য ক্ষতিপূরণের তালিকায় নাম না তুললে থানায় গিয়ে নাম লেখান। এ ভাবে নির্বাচিত নেতা রাজনীতির জমি পুলিশকে ছেড়ে দিচ্ছেন নিঃশব্দে। গণতন্ত্রে এর থেকে ভয়ানক কী হতে পারে!
ভিন্রাজ্যে আটকে অগণিত পরিযায়ী শ্রমিক দিনের পর দিন কাউন্সিলার, সভাপতি, বিধায়কদের ফোন করে পাননি। ফোন ধরলেও নেতা জানিয়েছেন, তাঁর কিছু করার নেই। ব্লক বা জেলাস্তরের জনপ্রতিনিধি না পেরেছেন ঘরে ফেরা নিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিতে, না পেরেছেন আটকে-পড়া মজুরের সহায়তার ব্যবস্থা করতে।
যে ক্ষমতা গরিবের কাজে লাগার সামর্থ্য জোগায় নেতাকে, সেটাই রাজনৈতিক ক্ষমতা। যতই চোর, ঘুষখোর হোক না কেন, তবু নেতাকে না হলে চলে না, কারণ রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে লড়ে ন্যায় আদায় করার ক্ষমতা নেই গরিবের। গরিব রাজনীতি করে, কারণ সে ভাবে তার কেন্দ্রে আছে নাগরিক-নেতা সম্পর্ক। হাজার নালিশ সত্ত্বেও পরস্পরের প্রতি দায়বদ্ধতার বন্ধন। এ বার মহামারি আর তুফানের জোড়া দুর্যোগ দেখাল, তা এখন ছাইয়ের দড়ি। আকারটাই আছে, বস্তু কিছু নেই।
নেতা রাজনীতি করছেন না বলেই রাজ্যের সীমান্তে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়েছে অগণিত মজুরকে। ছ’শো-সাতশো টাকা দিয়ে ত্রিপল কিনতে হয়েছে বানভাসি গ্রামের গৃহস্থকে। রাজনীতি করলে নিরন্ন, নিরাশ্রয় মানুষকে এতখানি উপেক্ষা করা যেত না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy