Advertisement
E-Paper

চুক্তি ভাল, তবে কিছু প্রশ্নও আছে

বাড়িতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের একটা চুক্তির আওতায় আনার কথা ভাবছে সরকার। এই ব্যবস্থা বহু কর্মীর পক্ষেই খুব গুরুত্বপূর্ণ।বাড়িতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের একটা চুক্তির আওতায় আনার কথা ভাবছে সরকার। এই ব্যবস্থা বহু কর্মীর পক্ষেই খুব গুরুত্বপূর্ণ।

সুগত মারজিৎ

শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৫ ০০:০৪
অধিকারের দাবি। গৃহকর্মীদের বিক্ষোভ। কলকাতা, ২০১০

অধিকারের দাবি। গৃহকর্মীদের বিক্ষোভ। কলকাতা, ২০১০

অ নেক দিন আগে টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছিলাম— যার মূল বিষয় ছিল বাড়ির কাজের মানুষদের চুক্তিবদ্ধ করা উচিত কি না। অর্থাৎ, কাজের লোকেরা কে কত বেতন পাবেন, ক’দিন ছুটি পাবেন, কী কী কাজ করবেন, ইত্যাদি বিষয়ে চুক্তির বন্দোবস্ত করা উচিত কি না। স্পষ্ট মনে আছে, সেই সময় অনেক ফোন আসত, বিশেষ করে যাঁদের বাড়িতে কাজের লোক আছে, তাঁদের কাছ থেকে। অর্থাৎ, গৃহিণীদের ফোন। চুক্তিবদ্ধ বা চুক্তিনির্ভর শ্রম নিয়ে শ্রমিক-মালিক বিতর্কও হত। আমার দায়িত্ব ছিল চুক্তিবদ্ধ বা চুক্তিহীন শ্রমের মূল পার্থক্য, বিশেষ করে ঘরের কাজের প্রসঙ্গে এই অর্থনীতির পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ। সম্প্রতি সেই স্মৃতি জাগ্রত হল, যখন দেখলাম সরকার বাহাদুরও গৃহশ্রমের ক্ষেত্রে চুক্তিনির্ভর ব্যবস্থার কথা ভাবছে এবং গৃহশ্রম বাবদ গড় আয় বা মজুরিরও একটা ন্যূনতম মূল্য ধার্য করার পরিকল্পনা করছে।

আমার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের এ-মাথা থেকে ও-মাথা পর্যন্ত যত গৃহিণীর ফোনে কথা হত, তাঁরা সবাই একবাক্যে চুক্তিনির্ভর শ্রমের পক্ষে সওয়াল করতেন। বিশেষ করে বাঁধাধরা ছুটির ব্যাপারে। কাজের লোকেরা ফাঁকি দেওয়া বা যখন-তখন কাজ না করে ডুব মারার ব্যাপারটা নিয়ে সবাই উত্তেজিত হয়ে পড়তেন। অবশ্যই যখন গৃহকর্মীদের সঙ্গে কথা হত, তাঁরা চুক্তিবদ্ধ শ্রমের বিপক্ষেই কথা বলতেন। অর্থাৎ, এক অর্থে মালিকপক্ষ যতটাই নথিবদ্ধ বা চুক্তিবদ্ধ শ্রমের পক্ষে যুক্তি দিতেন, শ্রমিকেরা ঠিক সে ভাবেই অনেক খোলামেলা নিয়মের বাঁধন-না-মানা শ্রমের পক্ষে সায় দিতেন। তবে বিতর্কের সবচেয়ে বড় বিষয় ওই ছুটির প্রশ্ন— চুক্তিমত ছুটির বেশি ছুটি নিলে মাইনে কাটা যাওয়ার প্রশ্ন। ব্যাপারটি এক অর্থে অর্থনীতি তথা উন্নয়ন তত্ত্বের একটি বহু দিনের প্রশ্নের সঙ্গে জড়িত।

উন্নয়নের অর্থনীতির এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে অসংগঠিত বা ইনফরমাল ক্ষেত্র। স্বভাবতই এই ক্ষেত্রগুলির বিপুল অর্থনৈতিক কর্মযজ্ঞকে আইনের আওতায় নিয়ে আসা উচিত কি না, সেটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। অসংগঠিত ক্ষেত্রে মজুরির বা কাজের রীতি-নীতির ওপরে কোনও ধরনের সরকারি নিয়ন্ত্রণ বলবৎ করা কি ঠিক, না ঠিক নয়? এ ধরনের গভীর প্রশ্নের সঙ্গে বাড়ির কাজের মানুষদের ক্ষেত্রে চুক্তির বিষয়টিও বিশেষ ভাবে জড়িত।

এই প্রশ্নের উত্তর অত সহজ নয়। সাধারণ বুদ্ধি বলে, যদি রোজগার বাড়ে, কাজকর্মের শর্তগুলো আরও স্পষ্ট হয়, তা হলে তো ভালই। কিন্তু চুক্তি বা বাঁধাধরা নিয়মের দুটো দিক আছে। রোজগার বাড়লে ভাল, কিন্তু ছুটির সংখ্যা বাঁধা হয়ে গেলে যখন-তখন কামাই করা মুশকিল। বাড়তি রোজগার ওই ধরনের স্বাধীনতায় যদি হস্তক্ষেপ করে, তা হলেই কর্মীদের আপত্তি ওঠে। স্বাধীনতা বনাম বেতন, এই দুইয়ের মধ্যে টানাপড়েন তৈরি হয়, তার ফলে একটা বেছে নেওয়ার ব্যাপার চলে আসেই।

আবার, মাইনে বাড়ানোর ফল কী দাঁড়াবে, তা-ও বিচারসাপেক্ষ। জিনিসের দাম বাড়লে যেমন মানুষ কম জিনিস কেনেন, তেমনই শ্রমিকের মাইনে বেড়ে গেলে, অর্থাৎ মনিবের খরচ বেড়ে গেলে, সেই মনিব লোক না রেখে নিজে বেশি কাজ করতে পারেন। তা হলে কাজের লোকের চাহিদা কমবে। মার্কিন মুলুকের মতো বড়লোক দেশে মোটামুটি সবাই বাড়ির কাজ নিজেরা করে নেন। হয়তো কোনও কোনও জায়গায় মাসে দু-চার দিন বাইরের কাজের লোক আসেন কাজ করতে, তাঁদের মাইনে সুপ্রচুর। অবশ্যই কাজের মানুষদের সংখ্যা অপ্রতুল বলেই। সংগঠিত ক্ষেত্রে ন্যূনতম মজুরি বাড়ালে লোকে অসংগঠিত ক্ষেত্র থেকে বেশি শ্রমিক নেয়। অসংগঠিত ক্ষেত্রেও মজুরি বাড়ালে মনিবেরা অন্য ধরনের স্ট্র্যাটেজি করতে পারবেন, যাতে তাঁদের খরচ একই রকম থাকে।

চুক্তিবদ্ধতার একটি বিশেষ সমস্যা হল, যাঁদের জন্য চুক্তির নিয়মকানুন বেঁধে দেওয়া হল, তাঁরা নিজেরাই ওই চুক্তি না মেনে নিজেদের মতো একটা ব্যবস্থা করে নেবেন। অর্থাৎ, সরকারের নিয়মকানুন ঠিক ঠিক পালিত হচ্ছে কি না, তার তদারকির পদ্ধতি যদি দক্ষ না হয় এবং নাগরিকদের ইচ্ছের বিরুদ্ধে যায়, তা হলে সেই ধরনের চুক্তি কার্যকর হবে না। মনিব যদি ভাবেন যে তাঁর প্রচুর খরচ বাড়ছে, তিনি প্রতিদিনের বদলে সপ্তাহে দু’দিন কাজের লোক ডাকবেন বা তাঁকে বলবেন চুক্তির মধ্যে না গিয়ে নিজেদের মতো একটা ব্যবস্থা করে নিতে। কাজের লোক যদি দেখে, চুক্তির মধ্যে থাকলে ছুটিছাটা নিয়ে দুর্ভোগের, কিংবা সম্পূর্ণ থেকে আংশিক কর্মীতে পরিণত হওয়ার ভয় আছে, এবং সরকার যদি বাড়ি-বাড়ি গিয়ে চুক্তি পালন হচ্ছে কি না, সেটা তদারকি করতে না পারেন, তা হলে যতই চুক্তি-আইন হোক না কেন, সেটা বাস্তবায়িত হবে না।

যাঁরা মুক্ত অর্থনীতিতে বিশ্বাস করেন তাঁরা বলবেন, সরকারি নিয়ন্ত্রণের এই ব্যর্থতা বুঝিয়ে দেয় যে, বাজারকে বেশি নিয়ন্ত্রণ না করাই ভাল। অবশ্যই এ রকম একটা ধারণা ক্ষেত্রবিশেষে প্রযোজ্য। আইনি নিয়ন্ত্রণের বাড়াবাড়ি চালু থাকলে সরকারি তদারকির কাজে নিযুক্ত মানুষজনের উপরি রোজগার সুনিশ্চিত হয়। গৃহকর্মে চুক্তি পালন হচ্ছে কি না, সেটা তদারক করতে সরকার লোক নিয়োগ করলে হয়তো নজরদারদের উপরি বাড়বে।

এ বার চুক্তিবদ্ধ শ্রমের উপকারের কথা বলি। চুক্তিবদ্ধ হওয়া মানে আমি যে কাজ করি, সেটা নথিবদ্ধ হওয়া। এটা কাদের পক্ষে সুবিধাজনক? আসলে, আমাদের দেশে জনসংখ্যার অনুপাতের হিসেবে দারিদ্র অনেকটাই কমে গিয়েছে। অবশ্যই ১২০ কোটির দেশে দরিদ্র মানুষ কম হলেও সংখ্যায় নিদেনপক্ষে কম নয়। তবে রাজনীতির মানুষজন বা মাটি থেকে দু’এক ইঞ্চি উপর দিয়ে ভ্রাম্যমাণ, দরিদ্রদের জন্য কুম্ভীরাশ্রু মোচনকারী পণ্ডিতদের কাছ থেকে ইষ্টকবৃষ্টির ভয় উপেক্ষা করেই বলি— মোটামুটি ভাবে ২০-২৫ কোটির বেশি দরিদ্র মানুষ এ দেশে নেই। পড়াশোনার অবস্থা খারাপ, কিন্তু কম পড়াশোনার বা পড়াশোনার দরকার নেই এমন কাজের অবস্থা খারাপ নয়। এ সব কাজে যাঁরা আছেন, তাঁরা অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিক। এই ক্ষেত্রের কর্মকাণ্ড খানিকটা চুক্তিবদ্ধ হলে এঁদের উপকার হবে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য; সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতিবিদ। মতামত ব্যক্তিগত

abp post editorial domestic worker sugata marjit domestic workers act domestic workers post editorial calcutta university vice chancellor
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy