গণতন্ত্রের দাবি। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়। ২২ অগস্ট। ছবি: সঞ্জয় চট্টোপাধ্যায়।
যে ভাবে বাঘা বাঘা লোকজন ও তাবড় নেতারা প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র-আন্দোলনকে কালিমালিপ্ত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন, তাতে এই আন্দোলনের সমর্থনে কলম ধরতে বাধ্য হলাম। এই প্রয়াস ষাটের দশকে প্রেসিডেন্সি কলেজে ছাত্র-আন্দোলন, যা এখন ইতিহাসের সম্পদ, এবং পশ্চিমবঙ্গের বিপ্লবী ছাত্র-আন্দোলনের প্রতি দায়বদ্ধতাজাত। গত ৩১ অগস্ট ছাত্রছাত্রীদের আহ্বানে প্রেসিডেন্সি কলেজে গিয়েছিলাম। আজও ছাত্রছাত্রীদের স্বাভাবিক ন্যায়-অন্যায় বোধ প্রবল, তাঁদের আদর্শ-উজ্জ্বল মুখগুলি বার বার ষাটের দশকের উদ্বেলিত মুখগুলিকে সামনে নিয়ে আসে। অপরিসীম মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে বার বার মনে পড়ে, কী ভাবে এখন আমাদের মহাপণ্ডিতরা বিনা দোষে এদের কাঠগড়ায় তুলছেন!
এই আন্দোলন নিয়ে আমাদের সমালোচকদের বক্তব্য কী?
সমালোচনা এক, উপাচার্যের আমন্ত্রণে কলেজে আগত মুখ্যমন্ত্রীকে কালো পতাকা দেখানো ঠিক হয়নি। উপাচার্য নিজস্ব সমীকরণে মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাতেই পারেন, কিন্তু ২০১৩’র ১০ এপ্রিল পুলিশ ও তৃণমূল বাহিনীর দাপটে ছাত্রমনে সৃষ্ট দগদগে ক্ষত মেরামত না করে সেই আমন্ত্রণ গ্রহণ করা মুখ্যমন্ত্রীর উচিত হয়নি। এখানে মমতার ভুলগুলি হল: এক, তিনি ভেবেছেন, ছাত্ররা ১০ এপ্রিল উচিত শিক্ষা পেয়ে গেছে, তার পর দু’বছর কেটে গেছে, স্মৃতি স্বল্পায়ু, তাই এ নিয়ে মাথা ঘামানো অপ্রয়োজনীয়। ঘটনা দেখিয়ে দিচ্ছে, এই চিন্তা ভুল। দুই, নির্বাচিত কিছু ছাত্র বাদ দিয়ে বিক্ষুব্ধদের সঙ্গে মত বিনিময় মুখ্যমন্ত্রী পরিহার করেছেন। ছাত্ররা উদ্যোগ নিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলে তাঁদের পিটিয়ে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাঁচ জন ছাত্র আহত হন, দুই জন হাসপাতালে ভর্তি। দুর্ভাগ্য, এর ফুটেজ যাদবপুরের মতো সংবাদমাধ্যমে আসেনি, ছাত্ররাও এই ফুটেজ রাখার ব্যবস্থা করেনি। তিন, রাজ্য জুড়ে অনুদান দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী মানুষের কৃতজ্ঞতা কিনে নিতে সচেষ্ট। প্রেসিডেন্সি জানে যে অনুদানে কর্মসংস্থান হয় না, স্তাবক তৈরি হয়। তাই তারা ঘোষণা করেছে যে, টাকা দিয়ে প্রেসিডেন্সি কলেজকে কেনা যায় না। মমতার ৩০ কোটির উদ্যোগ আত্মঘাতী হয়েছে। এর ওপর ৩০ কোটির মধ্যে দেড় কোটি লাইব্রেরির জন্য এবং ১০ কোটি কলেজের সৌন্দর্যায়নের জন্য দেওয়া হয়েছে। এর সরল অর্থ ছাত্রছাত্রীরা বুঝেছে যে, কলেজকে ঝাঁ-চকচকে কর্পোরেট সংস্কৃতির আখড়া বানাবার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। এর বিরুদ্ধে ছাত্রদের রুষ্ট প্রতিবাদ হিসেবে ‘কলেজ কারও বাপের নয়’ বক্তব্য উঠে এসেছে। বিশেষত অনুদান দেওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীর উপস্থিতি অপ্রয়োজনীয়, অনভিপ্রেত শুধু নয়, অভূতপূর্বও। এর আগে এমন ঘটনা ভূভারতে ঘটেনি। এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রীকে কালো পতাকা দেখানো খুব স্বাভাবিক ঘটনা ছিল। এতে কোনও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না।
সমালোচনা দুই: এই আন্দোলন ভব্যতার সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। সমালোচকরা ভুলে মেরে দিয়েছেন যে, এটি কোনও রেজিমেন্টেড পার্টির সুনিয়ন্ত্রিত আন্দোলন নয়, বরং স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলন। পৃথিবার যে কোনও প্রান্তে স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র আন্দোলন কোনও বাঁধাধরা পথে চলে না, বরং বহু ক্ষেত্রেই আবেগের আতিশয্যে তাতে নানাপ্রকার ‘একসেস’ বা অতিরেক দেখা যায়। ঘটনা হল, ছাত্র আন্দোলনের মূল্যায়নে ইতিহাস কখনও অতিরেক বিচার করে না, ‘এসেন্স’ বা মর্মবস্তু বিচার করে। এই মর্মবস্তুর বিচারে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র আন্দোলন সমর্থনযোগ্য সঠিক আন্দোলন।
সমালোচনা তিন: এই আন্দোলন অতি অল্পসংখ্যক ছাত্রদের আন্দোলন, সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্ররা এর শরিক নন। পৃথিবীর কোথায়, কবে কোন আন্দোলনে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছাত্ররা ভেসেছে, আমার জানা নেই। সব সময়েই ছাত্রদের ক্ষুদ্রসংখ্যকই সামনের সারিতে থাকে, পাশে থাকে সমর্থক এক বৃহৎ অংশ, বেশ কিছু ছাত্র নিরপেক্ষ থাকে, এক অতি ক্ষুদ্র অংশ বিরোধিতা করে। প্রেসিডেন্সি এখানেও ব্যতিক্রম নয়। স্বাভাবিক ধারাতেই, স্বাভাবিক খাতে এই আন্দোলন প্রবাহিত হয়ে চলেছে।
সমালোচনা চার: এই আন্দোলন বিকৃত রুচির। বহিরাগত একটিমাত্র ছাত্র অন্তর্বাস পরে আন্দোলনে শামিল হওয়ায় এই বক্তব্য উঠেছে। এক জনকে চিহ্নিত করে বাকিদের নস্যাৎ করার এই দৃষ্টিভঙ্গিই বিকৃত। ওই ছাত্রের অনুকরণে অন্যরা অন্তর্বাস ধারণ করলে এই সমালোচনার অর্থ বোঝা যেত। স্পষ্টতই, ব্যাপক ছাত্ররা সঠিক ভাবেই ব্যাপারটিকে গুরুত্বই দেননি। প্রশ্ন উঠেছে যে, ওই ছাত্রটিকে বের করে দেওয়া হল না কেন? ছাত্রদের বক্তব্য হল, যে যার মতো প্রতিবাদ করে, বের করে দেওয়া ছাত্রদের কাজ নয়। ছাত্ররা সঠিক ভাবেই ঘটনাটিকে উপেক্ষা করেছে।
সমালোচনা পাঁচ: এ আন্দোলন এই কলেজের ঐতিহ্য-বিরোধী, উপাচার্যের ঘরে স্লোগান দেওয়া, দেওয়াললিখন ইত্যাদি সে ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। কোন ঐতিহ্যের কথা সমালোচকরা বলছেন? ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলনের আগে যে ঐতিহ্য ছিল, সেখানে দেশ, জনগণ বা রাজনীতির কথা বললেই কলেজ থেকে বিতাড়ন অনিবার্য ছিল। আর তা ছিল এমনই কঠিন-কঠোর যে নেতাজি সুভাষ বসুর অসমসাহসী বিদ্রোহে প্রেসিডেন্সি শামিল হয়নি, তাঁকে বিতাড়িত হতে হয়েছিল। ষাটের দশকের ছাত্র আন্দোলন এই ঐতিহ্যে দাঁড়ি টেনে নতুন ঐতিহ্য গড়ে তোলে। ১৯৬৬-র ছাত্র আন্দোলনে অধ্যক্ষের ঘর স্লোগানে মুখরিত ছিল, সারা ঘরে ছিল দেওয়াল লিখন। মনে আছে, ’৬৭ সালে চার মাস বাদে কলেজ খোলার দিনই বিশাল মিছিল কলেজ প্রদক্ষিণ করে, পোস্টার, দেওয়াল লিখনে কলেজ ছেয়ে যায়। অচলায়তন ভেঙে সে দিনই নতুন ঐতিহ্য গড়ে ওঠে। গত প্রায় পাঁচ দশক এই নতুন ঐতিহ্যেই কলেজ অটল থেকেছে। আজকের আন্দোলন অবশ্যই এই নতুন ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। হাজার চেষ্টা করেও আজকের সমালোচকরা সেই পুরনো ঐতিহ্যে প্রেসিডেন্সিকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন না।
সমালোচনা ছয়: উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিকে আমাদের সমালোচকরা অমার্জিত অপরাধ ভাবছেন। অথচ যে উপাচার্য নিজস্ব লাভালাভ বিচারের ভিত্তিতে নিজস্ব সমীকরণের তাড়নায় কলেজের স্বাধিকারের প্রশ্ন বা উপাচার্য পদের গরিমা বিসর্জন দিয়ে অনায়াসে মুখ্যমন্ত্রীর বিদেশ যাত্রার সঙ্গী হতে পারেন, বা প্রশাসনিক বৈঠকে শামিল হতে পারেন, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্ষমতাসীন থাকার কোনও নৈতিক অধিকার তাঁর নেই। পুলিশি নিপীড়ন বা লুম্পেনবাহিনীর থেকে ছাত্রছাত্রীদের রক্ষার দায়িত্ব যে তাঁর, সেই সচেতনতাটুকুও তাঁর নেই। তাই তিনি অনায়াসে বলতে পারেন যে, পুলিশি জুলুমের জন্য তাঁর পদত্যাগের দাবি অর্থহীন। এমন উপাচার্যের পদত্যাগের ন্যায়সঙ্গত দাবিটিই ছাত্রছাত্রীরা করেছেন। আমাদের রাজ্যপালের বক্তব্য হল, ছাত্ররা কলেজে পড়াশোনা করতে এসেছে, উপাচার্যের পদত্যাগের দাবি তাদের কাজ নয়। এর সরল অর্থ হল, কলেজ নিয়ে, ছাত্রস্বার্থ নিয়ে, দেশ-দুনিয়া নিয়ে কোনও প্রশ্ন তোলার অধিকার ছাত্রছাত্রীদের নেই। আমাদের মাননীয় রাজ্যপাল ডায়নোসরের যুগে বাস করছেন। তিনি ভুলেই গেছেন যে, দেশের মুক্তিকামনায় এই কলেজের অন্তত তিনশো জন ছাত্র লেখাপড়া কেরিয়ার বিসর্জন দিয়ে কৃষি বিপ্লবের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
আসলে দ্বন্দ্ব এখানেই। কলেজের গরিমায় প্রশাসক-অধ্যাপকদের ভূমিকা অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু শেষ বিচারে নির্ণায়ক ভূমিকা ছাত্রছাত্রীদেরই। এঁদের ভূমিকা নাকচ করে দিয়ে প্রেসিডেন্সি এক পা-ও এগোতে পারবে না। ছাত্ররা সেই দাবিটিই তুলেছেন। যে শৃঙ্খলার কথা রাজ্যপাল থেকে উপাচার্য সকলেই বলছেন, ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসিই তা সুনিশ্চিত করার একমাত্র পথ। প্রেসিডেন্সি কলেজকে উৎকর্ষকেন্দ্র গড়তে হলে তাই ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি সুনিশ্চিত করতে হবে। চিন্তা-সংঘর্ষই চিন্তার বিকাশ ঘটায়। তাই নিত্যনতুন চিন্তার বিকাশের শর্ত হিসেবে ক্যাম্পাস ডেমোক্রেসি তথা ছাত্রছাত্রীদের যোগ্য ভূমিকা প্রয়োজন, যাতে মুক্ত চিন্তার সুবাতাস প্রবাহিত হতে পারে।
তাই আমি মনে করি, প্রেসিডেন্সি কলেজের আন্দোলন কোনও নৈরাজ্যবাদী ভ্রষ্ট আন্দোলন নয়, বরং ষাটের দশকের ঐতিহ্যকে বহন করে চলেছে আজকের প্রজন্ম। ধারে বা ভারে আজকের আন্দোলন ষাটের দশকের সমকক্ষ না হলেও এরাই সেই ইতিহাসের প্রকৃত উত্তরসূরি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy