Advertisement
১১ মে ২০২৪

পাশ-ফেল প্রথা চালু হোক প্রথম শ্রেণি থেকেই

তথ্য বলছে, প্রাথমিকে এখনও সাত শতাংশ শিক্ষার্থীর অক্ষরজ্ঞান হয়নি। পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে পাশ-ফেল চালু করে রেমিডিয়ালের ব্যবস্থা আরও অবৈজ্ঞানিক। লিখছেন জয়ন্ত দত্ত২০০৯ সালে সারা দেশে চালু হল শিক্ষার অধিকার আইন। সেখানে বলা হল, সারা দেশে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সমস্ত শিশুকে নিখরচায় বাধ্যতামূলক শিক্ষা দিতে হবে সরকারকে। এটা শিক্ষার মৌলিক অধিকার। আরও বলা হল, পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন হবে। 

শেষ আপডেট: ০৮ নভেম্বর ২০১৯ ০৫:১৬
Share: Save:

আমরা জানি সংবিধানেই শিক্ষাকে যুগ্ম তালিকাভুক্ত (রাজ্য ও কেন্দ্র) করা হয়েছে। ফলে শিক্ষার ব্যাপারে কেন্দ্রের সিদ্ধান্ত রাজ্যকে মেনে চলতে হয়। তবে রাজ্যেরও শিক্ষার উন্নয়নের ব্যাপারে স্বাধীন ভাবে চিন্তাভাবনা করার সুযোগ রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে রাজ্য সেই চিন্তাভাবনা করে সিদ্ধান্ত নেয়।

আমরা দেখছি, আমাদের দেশে এবং রাজ্যে বিদ্যালয় স্তরে শিক্ষার উপর বিভিন্ন সময়ে যে বিভিন্ন পরীক্ষা নিরীক্ষা চলছে তাতে সরকারি বিদ্যালয়গুলির উপর শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আগ্রহ প্রশ্নচিহ্নের মুখে পড়ছে। সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষার মানের লেখচিত্রও ক্রমশ নিম্নমুখী। এক জন শিক্ষক হিসেবে এর কারণগুলি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করছি।

২০০৯ সালে সারা দেশে চালু হল শিক্ষার অধিকার আইন। সেখানে বলা হল, সারা দেশে ৬ থেকে ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত সমস্ত শিশুকে নিখরচায় বাধ্যতামূলক শিক্ষা দিতে হবে সরকারকে। এটা শিক্ষার মৌলিক অধিকার। আরও বলা হল, পরীক্ষা পদ্ধতির পরিবর্তন হবে।
ধারাবাহিক নিরবচ্ছিন্ন মূল্যায়নের মাধ্যমে এবং প্রতিটি বিষয়ে নম্বরের পরিবর্তে ‘গ্রেড সিস্টেম’ চালু করে ওই মূল্যায়নের মাধ্যমেই প্রতিটি শিশু পরবর্তী শ্রেণিতে উঠবে। এতে শিশুদের স্কুলে আসার আগ্রহ বাড়বে। বছরে দু’বার পরীক্ষা দেওয়ার দুশ্চিন্তা এবং ভীতি থাকবে না। বছরে বেশ কয়েকটি মূল্যায়নের সম্মুখীন হলে এবং শিশুর বিদ্যালয়ে কথা বলা, খেলাধুলা, বিভিন্ন সহপাঠক্রমিক কার্যকলাপে যোগ দেওয়ার বিষয়গুলোকে বিচার করে তাদের পরবর্তী শ্রেণিতে পাঠানো হবে। তাতে স্কুলছুটের সংখ্যাও কমবে, শিশুর কাছে বিদ্যালয় অনেকটা বন্ধুর মতো হবে। ফলে সব শিশুর মধ্যে পড়াশোনার আগ্রহ বাড়বে। বিদ্যালয়ে ‘Chalk to Talk’ ধারণার পরিবর্তন করে শিশুর সারাবছর ধারাবাহিক সার্বিক মূল্যায়নের মাধ্যমে তাকে পরবর্তী শ্রেণিতে তোলা হবে। আমাদের রাজ্যে এই ‘no detention’ পদ্ধতি উচ্চ প্রাথমিক স্তরে চালু হলো ২০১৩ সাল থেকে।

কিন্তু সরকার ভাবল না যে, এই পদ্ধতি ভালভাবে কার্যকর করতে গেলে প্রথমেই বিদ্যালয়ে কোন কোন বিষয়ে নজর দেওয়ার দরকার।
প্রথমত, পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচির আমূল পরিবর্তন করে শিশুর কাছে অনেক সহজ ভাবে পাঠক্রম ও পাঠ্যসূচি উপস্থাপিত করার দরকার ছিল। যা একেবারেই হয়নি। এ ব্যাপারে শিক্ষক হিসেবে আমার নিজস্ব অভিমত, যে সমস্ত অভিজ্ঞ শিক্ষক-শিক্ষিকা বিদ্যালয়ে পড়ান বা পড়াতেন তাঁদের দিয়েই পাঠ্যসূচি তৈরি করা দরকার।

দ্বিতীয়ত, বিদ্যালয়ের পরিকাঠামোর পরিবর্তন করা জরুরি। বিষয় অনুপাতে আরও শিক্ষক নিয়োগ করা দরকার। দেখা যায়, অনেক বিদ্যালয়ে একটি বিষয়ের একাধিক শিক্ষক আছেন কিন্তু অন্য বিষয়ের জন্য রয়েছেন এক জন শিক্ষক যা অবৈজ্ঞানিক।
তৃতীয়ত, বিদ্যালয়ের প্রতিটি শ্রেণিতে বাধ্যতামূলক ভাবে ১:৪০ অনুপাতে শিক্ষক-ছাত্র থাকতে হবে যাতে শিক্ষকেরা প্রত্যেক ছাত্র ও তাদের কাজ নজরে রাখতে পারেন।

চতুর্থত, শিক্ষকদের শিক্ষা বহির্ভুত কোনও কাজে যুক্ত না করাই ভাল। সেই কাজের চাপ বিদ্যালয়ে পড়ার পরিবেশ নষ্ট করে দিচ্ছে। পঞ্চমত, অবশ্যই প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্তই আগের মতো পাশ ফেল ফিরিয়ে আনতে হবে। কারণ, শিশু বিশেষজ্ঞরা জানাচ্ছেন, শিশুরা সব চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতেই পারে যদি সে আগে থেকে নিজেকে প্রস্তুত করতে পারে। তাই পাশ-ফেল শিক্ষার্থীর কাছে কোনও ভীতির কারণই হবে না যদি সরকার শিক্ষার্থীদের জন্য বিদ্যালয়ে সমস্ত রকম ব্যবস্থা করতে পারে।
আর তা না হলে পাশ ফেল তুলে দিয়ে, বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা দিয়েও স্কুলছুটদের সংখ্যা কমানো যাবে না এবং বিদ্যালয় স্তরের শিক্ষার মানেরও উন্নতি হবে না। তথ্য বলছে, রাজ্যের প্রাথমিকে এখনও সাত শতাংশ শিক্ষার্থীর অক্ষরজ্ঞান হয়নি। বিগত দু’বছরে স্কুলছুট হয়েছে ১০ লক্ষ শিশু।

এর পরে আবার পঞ্চম এবং অষ্টম শ্রেণিতে পাশ ফেল চালু করে রেমিডিয়ালের ব্যবস্থা আরও অবৈজ্ঞানিক। যে ছাত্র এক বছর পড়ে পাশ করতে পারে না, সে দু’মাসে বিশেষ ভাবে শিক্ষার সুযোগ পেলে তা কতটা ফলপ্রসূ হবে সেটা অবশ্য ভবিষ্যৎ বলবে। তার পরে দু’মাস পরে যারা পরীক্ষা দিয়ে পাশ করবে তারা পরের শ্রেণিতে উঠে তিন মাস পিছিয়ে লেখাপড়া শুরু করবে। ফলে নতুন শ্রেণিতে উঠে সেই শিক্ষার্থী আরও অসুবিধার সম্মুখীন হবে।

তাই শুধু ছাত্রদের স্বার্থের কথা ভেবে ও বিদ্যালয় স্তরে একটা সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে শিক্ষা দফতরের আরও চিন্তাভাবনা করে একটা স্থায়ী, দীর্ঘ মেয়াদি, বিজ্ঞানভিত্তিক, পাঠক্রম, পাঠ্যসূচি তৈরি করে প্রথম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পাশ ফেল চালু করতেই হবে। যাতে রাজ্যের মানুষ বেসরকারি বিদ্যালয় থেকে মুখ ফিরিয়ে আবার সরকারি বিদ্যালয়ে তাদের ছেলেমেয়েদের ভর্তির আগ্রহ দেখান।

লেখক : প্রধান শিক্ষক, বহরমপুর আইসিআই

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Education System
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE