বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে সারা ভারতে ক্যান্সার রোগী অন্তত পঁচিশ লক্ষ, যাঁদের মধ্যে ষোলো লক্ষের সেরে ওঠার আশা নেই। অপারেশন, কেমোথেরাপি, রেডিয়োথেরাপি, কিছুই এঁদের নিরাময় করতে পারবে না। এঁদের মধ্যে বারো আনা, মানে অন্তত দশ লক্ষ মানুষের মূল কষ্ট হল তীব্র যন্ত্রণা আর সেই কারণে নিদ্রাহীনতা। পরিবারের মানুষরাও তাঁদের সঙ্গে সেই সব ভয়ানক রাত আর দিন কাটাতে থাকেন, কেউ এক মাস, কেউ এক বছর।
ক্যান্সার নিয়ে মানুষের আতঙ্কের একটা বড় কারণ হল এই শেষের ব্যথা-যন্ত্রণা। রোগকে সারাবার জন্য, অন্তত সহনীয় করার জন্য যে কোনও আশ্বাসকে আঁকড়ে ধরেন মানুষ। তাতে শুধু অর্থের অপচয়ই হয় না, সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়া শক্রকোষগুলোর ঘাঁটি নষ্ট করার জন্য যে বিপুল পরিমাণে রাসায়নিক মারণাস্ত্র ও শক্তিশালী রশ্মি প্রয়োগ করা হয়, তাতে আশপাশের সুস্থ সবল দরকারি কোষগুলোও ঘায়েল হয়। রোগের সঙ্গে লড়াই করবার ক্ষমতা আরও দ্রুত কমে যায়।
অথচ রোগীদের কষ্ট কমানোর অনেক কম ক্ষতিকর এবং সহজ পথ আছে। তা হল মরফিন। ঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করলে মরফিন জাতীয় ওষুধ বিছানার সঙ্গে মিশে-থাকা মানুষগুলোকে যন্ত্রণামুক্ত রেখে স্বাভাবিক কাজ করার উপযোগী রাখা যায়। বিদেশে মরণাপন্ন, ব্যথাকাতর ব্যক্তিদের স্বস্তি দিতে মরফিন দেওয়া রুটিন-মাফিক হয়ে থাকে। রোগীদের সঙ্গে পরামর্শ করে তার মাত্রা বেশি বা কম করেন ডাক্তারেরা। অথচ ভারত, যা বিশ্বের প্রধান মরফিন উৎপাদনকারী দেশ, উৎপাদনের প্রায় সবটাই রফতানি করে উন্নত দেশগুলোতে।
এ দেশে মরফিন দুর্লভ, কারণ মাদকাসক্তি কমাতে গিয়ে কোপ পড়েছে ক্যান্সার রোগীর উপর। আশির দশকে মাদকাসক্তির বাড়াবাড়ি নিয়ে হইচই হওয়ায় আবগারি দফতর, গোয়েন্দা পুলিশ, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, নানা তরফ থেকে নজরদারি শুরু হয়। গাঁজা, চরস, হেরোইন ইত্যাদির নিয়ন্ত্রণের জন্য আইন (নার্কোটিক ড্রাগস অ্যান্ড সাইকোট্রপিক সাবস্ট্যান্সেস অ্যাক্ট) পাশ হয় ১৯৮৫ সালে। মরফিনের ব্যবহারে কোনও শিথিলতার নিদর্শন মিললে চিকিৎসকদের জন্য অত্যন্ত কঠিন শাস্তির বিধান দিল সেই আইন। ফলে ডাক্তাররা মরফিনের ব্যবহার কমিয়ে দিলেন। অনেক হাসপাতাল মরফিন রাখতেই অস্বীকার করল। অন্য দিকে নতুন নতুন ওষুধ, প্রযুক্তি আকর্ষণ করতে লাগল সমাজকে। সেই সঙ্গে, মরফিনের ক্ষতিকর দিক নিয়ে সমাজে অনেক আলোচনাও হল। রোগী নেশাসক্ত হয়ে পড়বে, ঝিমিয়ে থাকবে, আশঙ্কা করল পরিবার।
ফলে ভারতীয়দের অবস্থা দাঁড়াল গ্রিক পুরাণের চরিত্র ট্যান্টালাসের মতো, জলে থেকেও যে সর্বদা তৃষ্ণার্ত। ভারত মরফিনের এক নম্বর উৎপাদক, কিন্তু ভারতের ক্যান্সার রোগীদের এক শতাংশও মরফিন পান কি না সন্দেহ। আইনের ফাঁসে বাঁধা পড়ে অসহনীয় যন্ত্রণা সহ্য করে প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ মানুষ মারা যাচ্ছেন। রোগীর স্বার্থেই ২০১৫ সালে ফের আইন সংশোধন করে মরফিনের মতো পাঁচটি ব্যথার ওষুধকে ‘অত্যাবশ্যক ওষুধ’-এর তালিকায় আনা হয়েছে। কিন্তু সেই পরিবর্তন রয়ে গিয়েছে খাতায় কলমে। যাদের প্রয়োজন, সেই রোগীরা আজও নাগাল পাচ্ছেন না মরফিনের। মাদক হিসেবে মরফিনকে দেখার ঝোঁক থেকেই যাচ্ছে।
অথচ গবেষকরা মরফিনের ব্যবহারের বিষয়ে নানা তথ্য পেয়েছেন। এক, মাদকাসক্তরা তাড়াতাড়ি মজা পেতে চান, তাই শ্বাসপথে বা শিরার ভিতর ইঞ্জেকশন দিয়ে কাজ করে এমন নেশার দ্রব্য পছন্দ করেন। ঢিমে গতির মরফিন ট্যাবলেটের কদর নেই তাঁদের কাছে। হেরোইন, ব্রাউন সুগার, এলএসডি, কিটামিন, এমনকী কাশির সিরাপেরও আকর্ষণ বেশি। দুই, মরফিন এবং অন্যান্য ব্যথামুক্তির ওষুধ জীবনকেও প্রলম্বিত করে। ব্যথা না কমলে রোগীর মৃত্যু তাড়াতাড়ি আসে। ওষুধ দিয়ে স্নায়ুপথে ব্যথার গতিকে আটকে দিতে পারলে রোগীরা দীর্ঘজীবী হন। তিন, যাঁরা শুধু নেশার জন্য মরফিন বা আফিমজাতীয় ওষুধ খান, তাঁরা নেশাগ্রস্ত হলেও, ক্যান্সারের ব্যথা কমানোর কাজে মরফিন ব্যবহার করলে রোগীদের নেশাগ্রস্ত হতে দেখা যায় না।
এমন নানা সাক্ষ্যপ্রমাণ মরফিনের পক্ষে গিয়েছে, আইনও আর বাধা নয়। নিয়মকানুন আগের চেয়ে অনেক যুক্তিপূর্ণ হয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ হাসপাতালে সে বার্তা যেন এখনও সে ভাবে পৌঁছয়নি। হয়তো মরফিনের দাম কম বলেই বেসরকারি ক্ষেত্রে তার ব্যবহারে উৎসাহ কম। রোগীরাও অনেকে ভাবেন, মরফিন হেরোইন, চরসের মতোই ক্ষতিকর, তা মানুষকে নিস্তেজ করে, মৃত্যু ত্বরান্বিত করে। ক্যান্সার রোগী যে বস্তুত অনেক স্বস্তি বোধ করেন, চাঙ্গা হয়ে ওঠেন মরফিন ব্যবহারে, তা তাঁরা জানেন না। ফলে দামি ‘প্যাচ’ দিয়ে ব্যথা কমানোর প্রচলন রয়েই গিয়েছে। রোগীর কাছে মরফিন পৌঁছতে চিকিৎসক সমাজ, প্রশাসন, মিডিয়া, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, সর্বত্র আলোচনা চাই।
চিকিৎসক, ব্যথা বিশেষজ্ঞ
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy