—ছবি পিটিআই।
কাশ্মীর উপত্যকা বৃহস্পতিবার যে মর্মান্তিক ঘটনার মুখোমুখি হইল, তাহার নিন্দার যথাযোগ্য ভাষা খুঁজিয়া পাওয়া দুষ্কর। শুধু সেনার কাজে যোগ দিবার অপরাধে এতগুলি নিরপরাধ মানুষের প্রাণ অকালে চলিয়া গেল, পড়িয়া রহিল শোকসন্তপ্ত বিধ্বস্ত পরিবারগুলি। ক্ষোভ ও দুঃখের সহিত মিশিয়া থাকিতেছে এক বিষম অসহায়তাবোধও। জঙ্গি গোষ্ঠী জইশ-ই-মহম্মদ দায় স্বীকার করিয়াছে। তবে সন্ত্রাসী হানা যাহারাই হানিয়া থাকুক, বুঝিতে কষ্ট হয় না যে উপত্যকার স্থানীয় সমর্থন তাহাদের সঙ্গে রহিয়াছে। নতুবা নিধন কার্যক্রম বারংবার সফল হইত না। অবশ্য এ ছাড়াও অসহায়তার আরও একটি কারণ আছে। গত কয়েক বৎসরে কাশ্মীর উপত্যকা ও ভারত-পাকিস্তান সীমান্তরেখায় সন্ত্রাসী হানার ধরনটি ভারতীয় প্রতিরক্ষাব্যবস্থা বিষয়েও অত্যন্ত গুরুতর প্রশ্ন উঠায়। গোয়েন্দা দফতর লইয়া জিজ্ঞাসা তোলে। এত বড় একটি সেনা-কনভয় যেখান দিয়া যাইবে, সেই পথে কী প্রকারে অন্য গাড়ি আসিয়া পড়িতে পারে, কী ভাবে সেনার মধ্যে আত্মঘাতী জঙ্গি গোপনে এত বড় ধ্বংসের প্রস্তুতি লইতে পারে— সে সব জবাবদিহি গোয়েন্দাদেরই করিবার কথা। ইনটেলিজেন্স বস্তুটি ছেলেখেলা নয়। ইহার উপর দেশের লক্ষকোটি নাগরিকের জীবনমরণ নির্ভর করে। বিস্ময়াহত হইয়া ভাবিতে হয়, কাশ্মীরের মতো নিয়ত-বিপন্ন অঞ্চলেই যদি গোয়েন্দা দফতরের কাজকর্মের এই হাল, বাকি দেশের মানুষ তবে কিসের ভরসায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার উপর নির্ভর করিয়া বাঁচিয়া আছেন।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যে এই স্বাভাবিক আত্মজিজ্ঞাসার আ পর্যন্ত উঠাইবে না, জানাই ছিল। জানা ছিল যে ঘটনা ঘটামাত্র তাঁহারা স্থিরনিশ্চিত হইয়া যাইবেন যে, ইহা পাকিস্তানের অপকীর্তি! প্রধানমন্ত্রী মোদী সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানকে ‘যোগ্য প্রত্যুত্তর’ দিবার হুমকি শুনাইবেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলিবেন, পাকিস্তানই এই ধ্বংসকাণ্ডের পিছনে! পাকিস্তানের হাত এই ঘটনার পিছনে থাকিতেই পারে। কিন্তু এখনও তাহার প্রমাণ জনসমক্ষে আসে নাই। বাস্তবিক, সরকার যেখানে গোয়েন্দা তথ্য পর্যন্ত জোগাড় করিতে অসমর্থ, সেখানে কী করিয়া এত দ্রুত পাকিস্তানের ‘হাত’-এর প্রমাণ পাওয়া যায়, সে প্রশ্ন উঠিতে পারে। কেননা এত দিনে চিত্রনাট্যটি পুরাতন হইয়া গিয়াছে। জানা হইয়াছে যে, এমন একটি ভয়াবহ ঘটনা ঘটামাত্র তাহা রাজনৈতিক ভাবে বিজেপি সরকারের ‘কাজ’-এ লাগিবে, আসন্ন নির্বাচনে বিজেপির পক্ষে হাওয়া টানিবে। দেশের অধিকাংশ প্রচারমাধ্যম মুহূর্তে সরকারি ধুয়াটি লুফিয়া লইবে, এবং হইহই রবে পাকিস্তানবিরোধিতার তুফান বহাইবে। সঙ্ঘের প্রচণ্ডতর প্রবক্তারা বৃহস্পতিবার সন্ধ্যাতেই সুচিন্তিত বক্তব্য পেশ করিবেন যে, পাকিস্তানের উপর এখনই প্রতিশোধমূলক হানা শুরু হউক।
বাস্তবিক, কাশ্মীর সঙ্কট যে গত পাঁচ বৎসরে ধাপে ধাপে গভীরতর ও রক্তাক্ততর হইয়াছে, তাহার কারণ বিজেপি সরকারের কাশ্মীর-রাজনীতির এই ধরনটি। বিজেপির চোখে কাশ্মীর সঙ্কট তাহাদের পাকিস্তানবিরোধিতা তথা মুসলিমবিরোধিতার প্রধান যুক্তি ও দেশব্যাপী চরম জাতীয়তাবাদ বা জিঙ্গোইজ়ম ছড়াইবার অব্যর্থ কৌশল। কাশ্মীর অশান্তিকে তাই ঘরোয়া রাজনীতির অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করিয়াছেন মোদী ও তাঁহার সরকার। সঙ্কটের মীমাংসার চেষ্টায় সময় নষ্ট না করিয়া সেনার দমনমূলক কাজকর্মের উপর জোর দিয়াছেন। উপত্যকার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন জলাঞ্জলি দিয়া পেলেট বন্দুকের ব্যবহার বাড়াইয়াছেন। স্বভাবতই উপত্যকার জনমন গত পাঁচ বৎসরে আরও বেশি ভারতবিরোধী হইয়া উঠিয়াছে। নরেন্দ্র মোদীরা যাহাই বোঝান না কেন, নাগরিক জানেন, আত্মঘাতী জঙ্গির আক্রমণে ছেদ টানা অসম্ভব, যদি তাহাদের সহমর্মী ও সহকর্মী হন সাধারণ মানুষ।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy