Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

মাথা যদি হেঁট হয়, দায় নিতে হবে এই সর্বনেশে শিক্ষাকে

গোড়ায় কি সুন্দর মিলে যাচ্ছিল সব! শেষটায় গিয়ে আবার সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে! কোনও হিসেবই যেন ঠিকঠাক মিলছে না আর। অনেকটা যেন ‘হ য ব র ল’— ‘...ঢাক-ঢোল, সানাই-কাঁশি, লোক-লস্কর, সেপাই-পল্টন হৈ-হৈ, রৈ-রৈ, মার-মার, কাট-কাট-এর মধ্যে হঠাৎ রাজা বলে উঠলেন, ‘‘পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?’’

সিমি জঙ্গিদের খতম করার পর। ফাইল চিত্র।

সিমি জঙ্গিদের খতম করার পর। ফাইল চিত্র।

অঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ০২ নভেম্বর ২০১৬ ০৩:২৪
Share: Save:

গোড়ায় কি সুন্দর মিলে যাচ্ছিল সব! শেষটায় গিয়ে আবার সব কেমন গুলিয়ে যাচ্ছে! কোনও হিসেবই যেন ঠিকঠাক মিলছে না আর।

অনেকটা যেন ‘হ য ব র ল’— ‘...ঢাক-ঢোল, সানাই-কাঁশি, লোক-লস্কর, সেপাই-পল্টন হৈ-হৈ, রৈ-রৈ, মার-মার, কাট-কাট-এর মধ্যে হঠাৎ রাজা বলে উঠলেন, ‘‘পক্ষীরাজ যদি হবে, তা হলে ন্যাজ নেই কেন?’’ শুনে পাত্র, মিত্র, ডাক্তার, মোক্তার, আক্কেল, মক্কেল সবাই বললে, ভালো কথা! ন্যাজ কী হল? কেউ তার জবাব দিতে পারল না, সব সুড়সুড় করে পালাতে লাগল।’

ভোপাল কিন্তু গোড়ায় নিজেকে বেশ মিলিয়েই ফেলেছিল ‘হ য ব র ল’-র সঙ্গে। সেন্ট্রাল জেলের কঠোর নিরাপত্তা আর উঁচু পাঁচিল নস্যাৎ করে আট সিমি জঙ্গি বেশ আচমকাই পালিয়ে গেল। মিডিয়াও অমনি ‘ব্রেকিং নিউজ, ব্রেকিং নিউজ’ বলে হৈ-হৈ, রৈ-রৈ শুরু করে দিল। তার পর শোনা গেল, পুলিশ আর জঙ্গিদের মধ্যে মার-মার, কাট-কাট হয়েছে। আট জঙ্গি পটা-পট মরেও গিয়েছে।

এর পর রাজা কোনও প্রশ্ন তোলেননি। কিন্তু অন্য কেউ জিজ্ঞাসা করলেন, ‘গপ্পের ন্যাজ নেই কেন?’ যে-ই না এই প্রশ্ন তোলা, অমনি গোল বেঁধে গিয়েছে। আর কোনও হিসেবই মিলছে না। ভিডিও ফুটেজে এনকাউন্টারের প্রমাণ মিলছে না। জঙ্গিরা কী করে পালাল, তার বাখ্যা মিলছে না। পলাতক জঙ্গিরা কোথা থেকে অস্ত্র পেল এবং কী অস্ত্র পেল, সে উত্তর মিলছে না। অস্ত্র যদি তাদের হাতে ছিলই, তা হলে এনকাউন্টারের পর সে সব গেল কোথায়, সে জবাবও মিলছে না।

আশ্চর্যের বিষয় হল, এখন কিন্তু রাজার পাত্র, মিত্র, ডাক্তার, মোক্তার, আক্কেল, মক্কেলরা আর জিজ্ঞাসা করছেন না, হিসেবটা মিলছে না কেন? সবাই কেমন সুড়সুড় করে মেনে নিচ্ছেন যাবতীয় ‘গোঁজামিল’।

এই কি তা হলে ভবিতব্য আমাদের? কেউ আর কোনও প্রশ্ন তুলব না? দেশপ্রেমের নামে, জাতীয়তাবাদের নামে, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার নামে যদি বিষও গেলানো হয়, চোখ বন্ধ করে তাই গিলে নেব?

প্রশ্ন কেউ তোলেননি, তেমন নয়। কোনও কোনও কণ্ঠস্বর এখনও মাথা তুলছে। সেই বিরোধী কণ্ঠগুলি সরব হয়েছে বলেই হিসেবটা শেষ পর্যন্ত খুব সরল ভাবে মিলিয়ে দেওয়া যায়নি। কিন্তু যাবতীয় বিরোধিতাকে, সত্যান্বেষণের যাবতীয় প্রয়াসকে, শাসকের পক্ষে অস্বস্তিকর হয়ে ওঠা অনুসন্ধিৎসাগুলোকে সমূলে বিনাশ করার যে সঙ্ঘীয় প্রবণতা মাথা তুলছে দেশে, তা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর!

এত বড় ঘটনা, বিতর্ক হবে না তা নিয়ে? প্রশ্ন উঠবে না? গণতন্ত্রে প্রশ্ন করার অধিকারটা তো বুনিয়াদি। দেশভক্তির নাম করে গণতন্ত্রের সেই বুনিয়াদি অধিকারকে অস্বীকার করার যে শিক্ষা চারিয়ে দেওয়া হচ্ছে গোটা দেশে, তা বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্রের ভিতটাকেই কাঁপিয়ে দিতে পারে।

ভোপালের ঘটনা নিয়ে কোনও তদন্তই শুরু করা যায়নি এখনও। স্বাভাবিক ভাবেই জিইয়ে রয়েছে অনেক প্রশ্ন। তা সত্ত্বেও প্রশ্ন করতে ভয় পাচ্ছে ভারতবাসী। পাছে ‘দেশদ্রোহী’ তকমা পেতে হয়! পাছে আক্রান্ত হতে হয় স্বঘোষিত দেশভক্তদের হাতে! পাছে আরও ভয়ঙ্কর কিছু ঘটে যায়!

ভারতীয় উপমহাদেশে গণতন্ত্র বিপন্ন হওয়ার দৃষ্টান্ত ইতিউতি ছড়িয়ে রয়েছে বিস্তর। প্রতিবেশী দেশগুলিতে বার বার গণতন্ত্রের নিধন যজ্ঞের সাক্ষী হয়েও সাত দশক ধরে উন্নতশির ভারতীয় গণতন্ত্র। সে মাথা যদি হেঁট হয় আজ, দায় কিন্তু নিতে হবে এই সঙ্ঘীয় শিক্ষাকেই।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Anjan Bandyopadhyay Newsletter
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE