Advertisement
E-Paper

কবির সঙ্গে তিনি কর্মযোগী, দেখি এক অন্য রবীন্দ্রনাথকে

ভবিষ্যৎদ্রষ্টা রবীন্দ্রনাথ কালের ভবিতব্যতা নিয়ে তাঁর সাহিত্যকৃতিতে এত প্রকাশ করেছেন, আর তাঁর বিদ্যালয় যে এক দিন বিশাল মহীরুহ হয়ে উঠবে— এটা দেখতে পাননি, তা কখনও হতে পারে? লিখছেন সুকুমার দাস।আমরা ভাবতে পারি, সে সময় এই বিশ্ববাণীর প্রয়োগ শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হয়ে উঠছে।

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:৪৪
শিক্ষক: ক্লাস নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি সৌজন্যে রবীন্দ্রভবন

শিক্ষক: ক্লাস নিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ছবি সৌজন্যে রবীন্দ্রভবন

কবি লিখেছিলেন, ‘...চরাচরকে বেষ্টন করে অনাদিকালের যে অনাহত বাণী অনন্তকালের অভিমুখে ধ্বনিত তাতে আমার মনপ্রাণ সাড়া দিয়েছে। মনে হয়েছে যুগে যুগে এই বিশ্ববাণী শুনে এলুম।’

আমরা ভাবতে পারি, সে সময় এই বিশ্ববাণীর প্রয়োগ শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে একটি অন্যতম উদ্দেশ্য হয়ে উঠছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালের এপ্রিল মাসে জগদানন্দ রায়কে লিখছেন, ‘... মালাবারের নায়ার ছেলেটিকে আমাদের বিদ্যালয়ে যদি বিনা বেতনেও নিতে হয় তা হলে উপকার আছে বলে মনে করি। ভারতবর্ষের দূর প্রদেশের ছেলেরা আমাদের আশ্রমে একত্র হলে সকল ছাত্রেরই পক্ষে ভাল।’(৭) অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয় রূপ পরিগ্রহ করার একটা অদম্য বাসনা রবীন্দ্রনাথের মনকে কী ভাবে আচ্ছন্ন করে তুলছে— তা বুঝতে অসুবিধে হয় না।

ওই বছরই মে মাসে অজিতকুমার চক্রবর্তীর সঙ্গে কবির শান্তিনিকেতন নিয়ে নিয়মিত কথাবার্তা হচ্ছে। রবীন্দ্রনাথের নিরন্তর ধ্যান-ধারণায় কত পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়! দৃষ্টি যতই বৃহতের দিকে ধাবিত হচ্ছে, তাঁর মন ততই অখণ্ড আকাশে বিস্তৃতি লাভ করছে। সকলকে আহ্বান করছেন ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। বলছেন, বাইরে উন্মুক্ত নির্মল আকাশে নিজেকে ছড়িয়ে দিতে হবে। সঙ্কীর্ণতাকে পরিহার করে একযোগে যাত্রা করার পালাগানে, শান্তিনিকেতনের আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠছে। কবি আনন্দ ধরে রাখতে পারছেন না। অজিতকুমারকে বললেন, ‘... তোমরা যে এখন বিশ্বের সামনে বেরিয়ে এসেছ এই কথাটি মনের মধ্যে ভালো করে জাগিয়ে তোলো এখন থেকে নিতান্ত ঘোরোভাবে কুনোভাবে তোমাদের বিদ্যালয়ের ব্যবস্থা করা চলবে না। এক বার সকলে মিলে বড় রাস্তায় বেরিয়ে এস।’ (৮)

ধারণার বিকাশ আরও পরিপূর্ণতা লাভ করেছিল ১৯১৬ সালে। পুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তাঁর মনের গহনের কথা তুলে ধরেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে সূর্যোদয়ের পূর্বে ভোরের আলোর মতোই সেই চিঠি আমাদের কাছে একটি ঐতিহাসিক দলিল হয়ে রইল। ‘...শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়কে বিশ্বের সঙ্গে ভারতের যোগের সূত্র করে তুলতে হবে— ঐখানে সার্ব্বজাতিক মনুষ্যত্ব চর্চ্চার কেন্দ্র স্থাপন করতে হবে— ... ভবিষ্যতের জন্যে যে বিশ্বজাতিক মহামিলন যজ্ঞের প্রতিষ্ঠা হচ্চে তার প্রথম আয়োজন ঐ বোলপুরের প্রান্তরেই হবে। ঐ জায়গাটিকে সমস্ত জাতিগত ভূগোল বৃত্তান্তের অতীত করে তুলব এই আমার মনে আছে— সর্ব্বমানবের প্রথম জয়ধ্বজা ঐখানে রোপণ হবে। পৃথিবী থেকে স্বাদেশিক অভিমানের নাগপাশ বন্ধন ছিন্ন করাই আমার শেষ বয়সের কাজ।’ (৯)

এখান থেকে আমরা অন্য রবীন্দ্রনাথকে পাই— যিনি কেবল কবি বা সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ নন। যিনি এক অনন্য কর্মযোগী সাধকও। পরিপূর্ণ শিক্ষার অভিলাষী নিরন্তর পরীক্ষা-নিরীক্ষা তাঁকে এভাবেই একটি বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে প্রাণিত করেছিল। অন্য কিছুকে ছাপিয়ে সেই কাজ ছিল এক মানুষ রবীন্দ্রনাথের। জীবনদর্শনের নানা দিক আলোকিত করে তিনি বিশ্বমানবের ধারণা দিলেন। অপরাপর তৈরি হবে সেই বিশ্বমানবের মহামিলনের জন্য এক বিশ্বযজ্ঞ— যার বাণী হবে ‘যত্র বিশ্বং ভবত্যেকনীড়ম’, আর নাম হবে বিশ্বভারতী!

প্রশ্ন জাগে, তিনি কি তখন ভেবেছিলেন একদিন ওই বিশ্বভারতী যুগে যুগে কালে কালে তাঁরই কীর্তি আর সাধনার ধারাকে বয়ে নিয়ে যাবে এক ঘাট থেকে অন্য ঘাটে, পূর্ব থেকে পশ্চিমে, দিক থেকে দিগন্তে— প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে? হয়তো না। কিন্তু সেই বিশ্ববাণীর মধ্যে একটি আনন্দগানের অনুরণন তাঁর শিরা উপশিরায় ধ্বনিত হয়েছিল। কারণ সেদিনের সেই রবীন্দ্রনাথ ছিলেন না কোনও আত্মমুক্তি অভিলাষী, ছিলেন না কোনও যোগগুরু ধর্মগুরু তাপস। একটা ‘আইডিয়া’ বা ধারণাকে প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ব্যক্ত করে, লক্ষ লক্ষ মানুষের জন্য প্রাত্যহিক নির্মাণ সাধনায় মগ্ন এক স্থপতি রবীন্দ্রনাথ!

এই সুবিশাল স্থাপনার প্রসঙ্গে তিনি নিজের সম্বন্ধে এক অকপট মনঃসমীক্ষণের কথা বলতে পেরেছিলেন কালিদাস বসুকে। এই আত্মসমীক্ষাই ছিল বিশ্বভারতীর ইন্ধন আর অনুপ্রেরণা! ‘আমার মধ্যে যে মানুষটি সাধক সে আমার সংসারী মানুষের ভাষা অতিক্রম করে কথা কয়— কিন্তু তার কথা যদি আমি চাপা দিয়ে ফেলি তাহলে আমার এই সংসারী মানুষের আর পরিত্রাণ নেই। ... আমার অন্তরতর যে প্রকৃতি আমার চেয়ে এগিয়ে গিয়েছে তার বাকরোধ করলে সেটা আমার পক্ষে ব্যাঘাতস্বরূপ হয়। ... আমি যে পথ চলতি মানুষ যখন হঠাৎ বাঁক ফিরি তখন নতুন দিগন্তে নতুন দৃশ্য হঠাৎ চোখে পড়ে তখন সেটা আমার সঙ্গে সমস্ত চিত্তকে উদবোধিত করে তোলে— তখন আমি সেই দৃশ্যে পৌঁছবার পূর্ব্বেই আনন্দগান জূড়ে দিই। কেননা এই গানে পথ চলবার বল দেয় ক্লান্তি দূর করে।’(১০)

রবীন্দ্রনাথের এই আনন্দগান, বিশ্ববোধে অনুরণিত সেই বিশ্বভারতীর কথাই কি বলতে চায় না?

প্রায় আশি বছর হল রবীন্দ্রনাথের তিরোধান ঘটেছে। শতবর্ষে পা ফেলল বিশ্বভারতী রূপ সেই আনন্দগান। এত বছর ধরে কত কত জ্ঞানতপস্বীদের আনা-গোনা! তাঁরাও পথের বাঁক দেখেছেন। হয়তো বা দৃশ্যেও পৌঁছেছেন। আবার একাত্ম হয়ে সেই আনন্দগানও আস্বাদন করেছেন। কালের ব্যবধানকে স্বীকার করে আজ কর্মকাণ্ডে নিয়ত পরিবর্ধন বা পরিমার্জন ঘটবে— তা বিচিত্র কিছু নয়। তবু বিশ্বভারতী তারই পথে নিজস্ব গতিতে অবিচল থাকবে। শান্তিনিকেতনের আকাশ বাতাস মাটি আর প্রকৃতিকে ভরিয়ে রাখতে সে গান বেজে চলবে অনন্তকাল ধরে।

লেখক গবেষক এবং বিশ্বভারতীর রবীন্দ্র ভবন গ্রন্থাগার কর্মী (বন্ধনীতে উদ্ধৃতি ও তার বানান অপরিবর্তিত, মতামত নিজস্ব)

তথ্যসূত্র: ৭। গৌরচন্দ্র সাহা সং, চিঠিপত্রে বিদ্যালয় প্রসঙ্গ, বিশ্বভারতী, রবীন্দ্রভবন, ১৪০৭, পৃ. ৯৪।

৮। রুদ্রপ্রসাদ চক্রবর্তী সম্পা., ভক্ত ও কবি : অজিতকুমার চক্রবর্তী— রবীন্দ্রনাথ পত্রবিনিময়, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ২০০৭, পৃ. ১৬১।

৯। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, চিঠিপত্র ২, বিশ্বভারতী, কলকাতা, ১৩৪৯, পৃ. ৫৪-৫৬।

১০। বিশ্বভারতী পত্রিকা : ১ম বর্ষ, দ্বাদশ সংখ্যা, আষাঢ় ১৩৫০, পৃ. ৭৭৭-৭৭৯।

Rabindranath Tagore Literature
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy