Advertisement
০২ মে ২০২৪
রাহুল গাঁধী আশা জাগিয়েছেন, ধর্মযুদ্ধের আশা

সংখ্যার লড়াই ছাড়িয়ে

২০১৭ সালের শেষ লগ্নে আবার এক গাঁধী একশো বত্রিশ বছরের কংগ্রেসের নতুন সভাপতি হয়েছেন। নেহরু-গাঁধী পরিবারের ষষ্ঠ প্রতিনিধি। গুজরাত থেকেই তিনি কংগ্রেসের পুনর্জন্মের ডাক দিয়েছেন।

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ২৭ ডিসেম্বর ২০১৭ ০০:৫২
Share: Save:

এপর্যন্ত ঠিক কত বার গুজরাত গেছি মনে নেই। যখনই গুজরাত থেকে দিল্লি ফিরতাম, বিমানবন্দর যাওয়ার পথে সময় থাকলেই সাবরমতী আশ্রমে একবার যেতাম। আশ্রমে গাঁধীর স্মৃতিবিজড়িত ছবির প্রদর্শনী দেখে যেতাম বইয়ের দোকানে। সেখানে গাঁধী-নেহেরু-পটেলের কথোপকথনের নথি আজও লোকে এসে কিনছে, পড়ছে। তার পর সাবরমতীর তীরে বসে ভাবতাম, ১৯৩০ সালে এই গুজরাতের ডান্ডি থেকেই গাঁধী কিছু সত্যাগ্রহীকে সঙ্গে নিয়ে অভিযান শুরু করেছিলেন। সেই সত্যাগ্রহীরা ছিলেন প্রধানত তফসিলি ও নিম্নবর্গের প্রতিনিধি। ১২ মার্চ এই আশ্রম থেকেই তিনি প্রথমে ডান্ডি যান। তার পর শুরু অহিংস সত্যাগ্রহ। ২৪০ মাইলের সেই অভিযানেই ঘোষণা হয়েছিল স্বরাজের।

২০১৭ সালের শেষ লগ্নে আবার এক গাঁধী একশো বত্রিশ বছরের কংগ্রেসের নতুন সভাপতি হয়েছেন। নেহরু-গাঁধী পরিবারের ষষ্ঠ প্রতিনিধি। গুজরাত থেকেই তিনি কংগ্রেসের পুনর্জন্মের ডাক দিয়েছেন। শুধু তা-ই নয়, গোটা দেশের হিংসার আবহ, অসহিষ্ণুতার প্রবলপরাক্রান্ত আলেখ্যকে বদলানোর ডাক দিয়েছেন তিনি। ভোট প্রচারে শুধু নয়, ভোট মিটে যাওয়ার পরেও তিনি গুজরাত যাচ্ছেন, সোমনাথ মন্দিরে গিয়ে মহাদেবের পুজো দিচ্ছেন। এ আর এক গাঁধীর নতুন ধর্মযুদ্ধ।

মার্ক টালি লিখেছেন উত্তরপ্রদেশের এক স্কুলে তাঁর সফরের অভিজ্ঞতা। ক্লাসে শিক্ষক জিজ্ঞাসা করছেন, ভারতের প্রধানমন্ত্রী কে? ছাত্ররা এখনও বলছে ইন্দিরা গাঁধী, এবং তারা বলছে— তিনি মহাত্মা গাঁধীর মেয়ে। আজও দেশের হিন্দি বলয়ের প্রত্যন্ত গ্রামে বহু মানুষ মনে করেন রাজীব থেকে রাহুল, সবাই মহাত্মা গাঁধীর পরিবার। হতে পারে বাস্তবে গাঁধী নেহরু দুই পৃথক বৃক্ষ। কিন্তু মতাদর্শগত ভাবে মহাত্মার ভাবাদর্শকেই নবীনতম রাহুল বহন করে এগোচ্ছেন। তিনি গাঁধীর ঘনিষ্ঠতম আত্মীয় তো বটেই।

নরেন্দ্র মোদী যখন মুখ্যমন্ত্রী তখন গোধরা কলঙ্ক মুছে ভাইব্রান্ট গুজরাত নামক এক বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু করেন। ভাইব্রান্ট গুজরাতের কর্মযজ্ঞের স্থানটির নামও দেওয়া হয় মহাত্মার নামে। প্রেক্ষাগৃহে ঢুকতেই বিশাল গাঁধীমূর্তি। তখন আমার মনে হয়েছিল, হয়তো মোদী নিজেকেও ভাঙতে চাইছেন। নতুন করে গড়তে চাইছেন, তিনি বুঝি এক বিশাল কর্মযজ্ঞের ঋত্বিক। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও তিনি আমাকে বার বার বলেছিলেন, দেশের উন্নয়নই হবে তাঁর প্রধান অগ্রাধিকার। পাখির চোখ।

গত তিন বছরে বিজেপি যে পথে হাঁটল! বিশেষত কফিনের শেষ পেরেকটা ঠোকা হল গুজরাত ভোটে। ভোটের সময় মোদী নিজেই যে ভাবে সাম্প্রদায়িকতাকে রঙের গোলাম হিসাবে ব্যবহার করলেন তাতে এটা স্পষ্ট যে, অমিত শাহ আর নরেন্দ্র মোদীতে কোনও ভেদ নেই। আডবাণী একদা বাজপেয়ী হতে চেয়েছিলেন। পাকিস্তান সফরে জিন্নাকে ধর্মনিরপেক্ষ বলার বিতর্কের পর যখন সংঘ পরিবারের সঙ্গে তাঁর বিবাদ শুরু হয়, তখন ‘আডবাণীর রূপান্তর’ বলে একটি প্রবন্ধ লিখেছিলাম। এক প্রবীণ সাংবাদিক প্রশ্ন তুলেছিলেন, তোমার মনে হচ্ছে, লিখেছ, কিন্তু বিড়াল যদি মাছ খাব না বলে, তা কতখানি বিশ্বাসযোগ্য? আজ বুঝতে পারি আডবাণীর মতাদর্শের শিকড়েই মেরুকরণ নিহিত ছিল। রাম মন্দির আন্দোলনই তো আজকের এই সাম্প্রদায়িক আলেখ্যের জননী। তবে মোদীর আলেখ্য ধর্মনিরপেক্ষতার নামাবলিতে ঢাকা আরও অসম্ভব। সে তো তার সমস্ত নখদাঁতের ভয়ংকর প্রকাশ ঘটিয়েই বলছে, এটাই ভারত। তিন বছর ধরে মেক ইন ইন্ডিয়া-র নামে ভারত নামক ধারণাটিকেই আছাড় মেরে ভেঙে টুকরো টুকরো করার ধ্বংস-রাজনীতি দেখছি আর ভাবছি, এই প্রেক্ষিতে এই গুজরাত থেকেই রাহুল-উদয় ধ্বংসের হতাশা কাটিয়ে আবার নব ভারত নির্মানের স্বপ্ন দেখাচ্ছে।

এ-ও এক গুজরাত মডেল। মোদীর গুজরাত মডেলের কল্পনাবিলাসে ২০১৪ সালে ভারতবাসী তাঁকে বিপুল ভোট দিয়েছিল, এক সুপারম্যানের মহিমায় অভিষেক হয়েছিল তাঁর। এখন গুজরাতের আর্থসামাজিক পরিস্থিতির সরকারি পরিসংখ্যানেই বোঝা যাচ্ছে মোহ আর বাস্তবতার মধ্যে সহস্র যোজন দূরত্ব। গ্রাম-শহরের সংঘাত। ধনী-দরিদ্রের আর্থিক অসাম্যে প্রবল বৃদ্ধি। আর এই নেতিবাচক আবহের জন্যই জন্ম নিয়েছে ত্রয়ী: হার্দিক পটেল, জিগ্নেশ মেবাণী আর অল্পেশ ঠাকোর।

কিছু নিন্দুক অবশ্য বলছেন, এই ত্রয়ী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অসন্তোষের নেতৃত্ব দিয়েছেন, রাহুল তার রাজনৈতিক মুনাফা পেয়েছেন। আমি এই মতের পক্ষে নই। যদি ত্রয়ীই অসন্তোষকে মূলধন করে নেতৃত্ব দিতে পারতেন তা হলে তাঁরা রাহুল গাঁধীকে এ ভাবে ভোটের সময় আঁকড়ে ধরতেন না। আসলে ভুলে গেলে চলবে না ঐতিহাসিক ভাবে গুজরাত রাজ্যে কংগ্রেসেরও শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস ছিল। সর্বভারতীয় নেতা হিসেবেও রাহুলই আজ নরেন্দ্র মোদীর প্রধান চ্যালেঞ্জার। আজও কংগ্রেসই প্রধান বিরোধী দল। মূল লড়াই তো রাজ্যে রাজ্যে মোদী বনাম রাহুল গাঁধী। শুধু সংখ্যার লড়াই নয়, এ এক ধর্মযুদ্ধ। আজ এ লড়াই সত্য বনাম অসত্যের। সহিষ্ণুতা বনাম অসহিষ্ণুতার। হিংসা বনাম অহিংসার। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে ২৬ জানুয়ারি ট্যাবলো করতে চাইছেন, এখনও সে ট্যাবলো মোদী সরকারের ছাড়পত্র পায়নি! কোথায় পৌঁছেছি আমরা!

২০১৪ সালের ভোটের সময় রাহুল আমায় যা বলেছিলেন আজও তিনি সে কথাই বার বার বলছেন। ওঁর প্রধান বক্তব্য ছিল, অপটিকস বা সাজানো ধারণা বনাম বাস্তবতা নিয়ে। সত্য বনাম অসত্য নিয়ে। রাহুল বলছিলেন, ধরুন, আমি আমজনতার এক সাধারণ প্রতিনিধির সঙ্গে করমর্দন করছি হেসে হেসে কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে নয়। ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে। এর অর্থ কী? আমি সেই নাগরিকের সঙ্গে হৃদয়ের কোনও বন্ধনে যুক্ত হচ্ছি না। সবটাই লোক দেখানো সাজানো ঘটনা। এর চেয়ে কি আন্তরিক ভাবে সেই মানুষটার সঙ্গে যুক্ত হওয়া উচিত কাজ নয়? মোদীর ওই অসত্য নাটকটা সাধারণ মানুষের কাছে ধরা পড়ে গিয়েছে। মোদী ধরা পড়ে গিয়েছেন।

একের পর এক রাজ্যে বিধানসভা নির্বাচন আসছে। ত্রিপুরা-মেঘালয়-নাগাল্যান্ড-কর্নাটক। তার পর রাজস্থান-মধ্যপ্রদেশ-ছত্তীসগঢ়। তার পর তো ২০১৯। যেন ভোটের মিছিল। রাহুল তাঁর সম্পর্কে অতীতের প্রচারকে নস্যাৎ করে বুঝিয়েছেন ৪৭ বছর বয়সে তিনি লম্বি রেস কি ঘোড়া। সাংগঠনিক দুর্বলতা থেকে দল কতটা বেরতে পারবে, শরিক দলগুলির ঐক্য-বাক্য-মাণিক্য কতটা রচিত হবে এ সব প্রশ্ন এখনও অমীমাংসিত। কিন্তু মতাদর্শগত ভাবে দেশটাকে ধ্বংসের পথ থেকে সরিয়ে আবার সেই চিরায়ত ভারত নির্মাণের পথে নিয়ে যেতে চাইছেন রাহুল। এ কথা মানুষ বিশ্বাস করছেন। ১৯২৯ সালে লাহৌরে ইরাবতী নদীর তীরে কংগ্রেসের অধিবেশনে মোতিলাল নেহরু জওহরলালের হাতে কংগ্রেস সভাপতির মশাল তুলে দিয়েছিলেন। আজ এত বছর পর রাহুল সেই দায়িত্ব পেয়ে হিন্দুত্বের অসহিষ্ণু ভারতের আলেখ্য বদলে ফিরিয়ে দিতে চাইছেন সেই অমরাবতী। উদ্দেশ্য মহৎ। নেহরু এক বার আমলাদের সঙ্গে ঘরোয়া বৈঠকে বলেছিলেন, ভবিষ্যতে ভারতে কমিউনিস্টরা কোনও দিন ক্ষমতায় আসবে না, কেননা ওদের মতাদর্শের মূল উপাদান কংগ্রেসেই আছে, কিন্তু হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাকে মূলধন করে ভবিষ্যতে কখনও জনসংঘ ক্ষমতায় আসতে পারে, কেননা ভারতীয় জনসমাজের মধ্যে সেই গোঁড়ামি আছে, যেটার শিকড় আমি উপড়াতে চাই। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে করা ওই উক্তি নেহরুর প্রাক্তন বিদেশসচিব ওয়াই ডি গুন্ডেভিয়া রেকর্ড করে গিয়েছিলেন। নেহরুর আশঙ্কা সত্য প্রমাণিত হয়েছে। এখন এই হতাশার মধ্যে রাহুলের কথা শুনে নতুন আশায় বুক বাঁধছি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Rahul Gandhi Congress Gujarat
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE