Advertisement
০২ মে ২০২৪
এমন বন্ধু আর কে আছে...

কাঁটার মুকুটে পেরেক!

ইতিহাস বলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে, ভারতের স্বাধীনতা যখন সময়ের অপেক্ষা, ব্রিটিশ দূত স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস তখন ‘সন্ধি’ প্রস্তাব নিয়ে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর কাছে গিয়েছিলেন। গাঁধীর জবাব ছিল: ‘‘আ পোস্টডেটেড চেক অন আ ক্রাশিং ব্যাঙ্ক!’’ যে ব্যাঙ্ক নিজেই ডুবতে বসেছে, তার উপর আগামী দিনের চেক কেটে লাভ কী!

দেবাশিস ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ০৫ অক্টোবর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

সোমেন মিত্রের কাঁটার মুকুটে রাহুল গাঁধী কি আরও কয়েকটি পেরেক পুঁতে দিলেন? দিল্লিতে নবগঠিত প্রদেশ কংগ্রেস নেতৃত্বের সঙ্গে দলের সর্বাধিনায়ক রাহুলের বৈঠকের নির্যাস থেকে এমন ধারণা করা হয়তো সর্বাংশে অমূলক হবে না। কারণ রাজ্য কংগ্রেস নেতাদের কাছে তাঁদের সর্বভারতীয় সভাপতি যা বলেছেন, এক কথায় তা মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা! রাজ্যে কংগ্রেসের নির্বাচনী কৌশল সম্পর্কে রাহুলের স্পষ্ট দিঙ্‌নির্দেশ হল, কংগ্রেসকে আগে নিজের পায়ে দাঁড়াতে হবে।

ইতিহাস বলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অন্তিম লগ্নে, ভারতের স্বাধীনতা যখন সময়ের অপেক্ষা, ব্রিটিশ দূত স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস তখন ‘সন্ধি’ প্রস্তাব নিয়ে মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর কাছে গিয়েছিলেন। গাঁধীর জবাব ছিল: ‘‘আ পোস্টডেটেড চেক অন আ ক্রাশিং ব্যাঙ্ক!’’ যে ব্যাঙ্ক নিজেই ডুবতে বসেছে, তার উপর আগামী দিনের চেক কেটে লাভ কী!

এই রাজ্যে কংগ্রেসের হাল এখন যা, তাতে তুলনাটি প্রাসঙ্গিক। দীর্ঘ কাল ধরে কংগ্রেসের দৈনন্দিন রাজনীতির বাইরে থাকা পঁচাত্তর বছরের সোমেন মিত্রকে হঠাৎ প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতির চেয়ারে বসিয়ে দেওয়ার মধ্যে চমক এবং ধাক্কা দু’টিই আছে। সোমেনবাবুর অভিজ্ঞতা, সাংগঠনিক দক্ষতা, নিজস্ব টিম গড়ে তোলার ক্ষমতা এবং সেই টিমকে বুক দিয়ে আগলে রাখার দায়বদ্ধতা, সবই অনস্বীকার্য। তবে এ সবই তো তাঁর ক্ষেত্রে অতীত হয়ে গিয়েছে। আজকের কংগ্রেসে সোমেনের ‘দাপট’ কার্যত এক বিস্মৃত অধ্যায়। তিনি নিজেও এটা বিলক্ষণ বোঝেন। তাই নতুন করে প্রদেশ কংগ্রেসের ভার পেয়েই তিনি কবুল করেছেন, এটা তাঁর কাঁটার মুকুট।

আসলে বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ বছর আগের দোর্দণ্ডপ্রতাপ সোমেন মিত্রের সঙ্গে এখনকার সোমেন মিত্রের মিল খোঁজাও অনুচিত। মাঝখানের এতগুলো বছরে তাঁর রাজনীতি গতিপথ বদলেছে। এক সময় যে সোমেনবাবু ছিলেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, এবং লোকচক্ষুতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে কংগ্রেস থেকে ‘তাড়ানোর’ অন্যতম ‘কারিগর’, তিনিই তৃণমূলে গিয়ে সাংসদ হয়েছেন। তাঁর স্ত্রী হয়েছেন তৃণমূলের বিধায়ক। আবার পাঁচ বছর সাংসদ-জীবন কাটিয়ে ফিরেছেন কংগ্রেসে। ফের হয়েছেন তীব্র মমতা-বিরোধী।

কিন্তু ফিরলেন যখন, প্রদেশ কংগ্রেসের অবয়ব তখন বদলে গিয়েছে। তিনি কংগ্রেসে না থাকার ফলে স্বাভাবিক ভাবেই তাঁর প্রভাবও কমে গিয়েছিল। এক কালের চেনা ‘সোমেন-বাহিনী’ আর তত সক্রিয় ছিল না। বরং সেই জায়গার দখল চলে যায় অধীর চৌধুরী ও তাঁর দলবলের কব্জায়। হয়তো তাই ফিরে আসার পরেও আর তেমন গুরুত্ব পাননি সোমেন মিত্র। বরং অধীর চৌধুরীর নেতৃত্বে কিছুটা ঢাকা পড়ে যান। নিজেও সরে ছিলেন অনেকটা।

সেই সোমেন মিত্রকে আচমকা কেন আবার বড় দায়িত্বে ফিরিয়ে আনা হল, কী ভেবে রাহুল লোকসভা ভোটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে এমন একটি সিদ্ধান্ত নিলেন— তার ঠিক উত্তরটা তিনি না দিলে জানা কঠিন। সিদ্ধান্তটি জনসমক্ষে এসেছে আচমকা। অধীর নিজেও জানতেন না, তাঁকে সরানো হচ্ছে। নতুন পদপ্রাপ্তির আগাম খবর ছিল না সোমেনবাবুর কাছেও। কিন্তু কংগ্রেস হাইকম্যান্ড সকালে ঘুম ভেঙে উঠে এটা করে ফেললেন, তা তো নয়। মেনে নিতেই হবে, এমন একটি ভাবনা ভিতরে ভিতরে চলছিল।

যদি ধরে নিতে হয়, তৃণমূলের বিরোধিতা এবং সিপিএমের সঙ্গে জোট বাঁধার লক্ষ্যে এই বদল, তা হলে সেখানে অধীর এবং সোমেনের পাল্লা সমান। কারণ এ ক্ষেত্রে দু’জনের মূল ভাবনায় তো কোনও ফারাক নেই। আবার যদি ধরে নিতে হয়, অধীরের রাজনৈতিক গতিবিধি সম্পর্কে দলের অন্দরে কোথাও কোনও প্রশ্ন দানা বাঁধছিল, তা হলে এখনও পর্যন্ত কাগজে-কলমে কংগ্রেস না-ছাড়া অধীরের সঙ্গে তৃণমূলে গিয়ে পাঁচ বছর সাংসদগিরি করে ফিরে আসা সোমেনের ‘বিশ্বস্ততার’ তুলনা হয়তো একটু অসম হয়ে যায়।

তবে রাজনীতি বড় বিচিত্র। তার হিসাব সর্বদা চেনা অঙ্কে মেলে না। তাই অনুমানের স্বাধীনতাটুকু ছাড়া সোমেন মিত্রকে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি বেছে নেওয়ার নির্দিষ্ট যুক্তি এখনও সামনে আসেনি। বরং বেশি করে প্রমাণিত হয়েছে রাজ্য কংগ্রেসে তরুণ নেতৃত্বের আকাল। নইলে দেশের অন্যত্র যখন রাহুল কমবয়সি নেতাদের তুলে আনতে চান, তখন এ রাজ্যে তাঁর ভরসা পঁচাত্তর বছরের ‘তরুণ’ সোমেন মিত্র!

এ বার প্রশ্ন, সোমেন মিত্র যে কংগ্রেসের ভার নিলেন, তার হাল কেমন? এক কথায় বললে, ক্ষয়িষ্ণু। তুলনায় কমবয়স্ক এবং জনভিত্তিতে পোক্ত বলে অভিহিত অধীর চৌধুরী তাঁর সভাপতিত্বে দলকে বাড়ানো দূরস্থান, ধরে রাখতেও পারেননি। কংগ্রেস ভেঙে ভেঙে তৃণমূল আরও স্ফীত হয়েছে। নাচতে না-জানার দায় উঠোনের উপর চাপানোর মতো, দলের ভাঙন রুখতে না পারার জন্য অধীর ও তাঁর সম্প্রদায় আঙুল তুলেছেন তৃণমূলের দিকে। যে ক্ষোভ আদতে নিজেদের ব্যর্থতাকেই বড় করে দেখায়। কংগ্রেস তার সংগঠন ধরে রাখতে পারছে না কেন— তার উত্তর তো খুঁজতে হবে কংগ্রেসকেই।

এই অবস্থায় রাহুলের নির্দেশ মোতাবেক সোমেনবাবুর প্রধান দায়িত্ব এখন নড়বড়ে রাজ্য কংগ্রেসকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো।

সোমেনদা, ভুল বুঝবেন না। অপরাধ নেবেন না। একটি পুরনো মজার কথা মনে পড়ে গেল। কোনও তুলনার জন্য বলছি না, কটাক্ষ তো নয়ই। ঘটনাটি প্রবী‌ণ ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা প্রয়াত নলিনী গুহকে নিয়ে। তিনি সেই সময় শ্যামপুকুরে ভোটে দাঁড়িয়েছিলেন। কংগ্রেসের প্রচার ছিল, নলিনীবাবু তো দাঁড়াতেই পারেন না! সাংবাদিকদের কাছে সে কথা শুনে রেগে তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি দাঁড়াতে পারি না? দেখিয়ে দিচ্ছি। কে আছিস, আমাকে ধরে তোল তো!’’

কংগ্রেসকে নিজের পায়ে দাঁড় করানোর চ্যালেঞ্জটা এর চেয়ে কোনও অংশে কম নয়। কারণ কংগ্রেসে সোমেনবাবু তাঁর পুরনো টিম সে ভাবে পাবেন না। সময় ও বয়স তাঁদের পক্ষে নেই। সেই সঙ্গে তাঁকে পিছু টেনে ধরার কংগ্রেসি ব্যাধি তো আছেই। ফলে অভিজ্ঞতার আলোয় তিনি যা করতে চাইবেন, বাস্তবের নির্মমতায় তার অনেক কিছুই হয়তো তিনি করে উঠতে পারবেন না। পরিস্থিতি তাঁকে তা করতে দেবে না। এটা তাঁর বড় লড়াই।

লোকসভা ভোটের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে রাতারাতি ভোলবদলের ম্যাজিক দেখানো যে কত কঠিন, সোমেন মিত্র সেটা বোঝেন বলেই এই সভাপতিত্বকে অকপটে ‘কাঁটার মুকুট’ বলতে পেরেছেন। রাহুলের নির্দেশ সেই মুকুটে বাড়তি পেরেক! তবু বলতেই হবে, সোমেন মিত্র পিছিয়ে আসেননি। পোড়খাওয়া লড়াকু নেতা স্বধর্ম বজায় রেখে কঠিন দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। সেই প্রশংসা তাঁর একশো বার প্রাপ্য।

রাহুল অবশ্য বলে দিয়েছেন, কংগ্রেস নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে কি না দেখে তার পরে ঠিক হবে মমতার রাজ্যে তাঁরা একা লড়বেন, অথবা তৃণমূলের সঙ্গে জোট করবেন, না কি সিপিএমের সঙ্গে হাত মেলাবেন। এটাও এক সূক্ষ্ম কৌশল। বুঝ লোক, যে জান সন্ধান! কারণ মমতা যে একাই লড়বেন, সেই সিদ্ধান্তে তিনি অনড়। অতএব বাকি রইল দুই। তার কোনওটিতেই মমতার উদ্বেগের সঙ্গত কারণ আছে বলে এখনও পর্যন্ত মনে হয় না। আর এই রাজ্যে ৪২টি লোকসভার সিংহভাগ যদি তৃণমূলের ঝুলিতে থাকে, তা হলে ভোটের পরে রাহুলের কাছে মমতার গুরুত্ব বাড়বে না, কে বলতে পারে!

এই রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে যেতে না চাইলেও তাঁর স্নেহাস্পদ রাহুল গাঁধীর উদ্দেশে তৃণমূল নেত্রী তাই মনে মনে বলতেই পারেন, ‘এমন বন্ধু আর কে আছে...!’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE