স্বাভাবিক: গোলমাল থামার পর সশস্ত্র বাহিনীর উপস্থিতিতে পথে বেরিয়েছেন কয়েক জন। বসিরহাট, ৭ জুলাই। ছবি: বিশ্বনাথ বণিক
অ বশেষে কিছুটা স্বস্তির সংবাদ। কিছুটা, কেননা, বসিরহাটে জনজীবন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে ঠিকই, কিন্তু ইতিমধ্যে ক্ষত গভীরতর, সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষতি ক্রমবর্ধমান। স্বস্তির সংবাদগুলোর সঙ্গে সঙ্গে ভয়াল ভবিষ্যতের আগাম খবরগুলোও আছড়ে পড়ছে দোরগোড়ায়: বেথুয়াডহরিতে উত্তেজনা, বীরভূমে হিংসার প্রস্তুতি, মালদা উত্তপ্ত, ইত্যাদি, ইত্যাদি। কোন খবরটা সত্য, কোনটা গুজব, বুঝে ওঠা কঠিন। তার চেয়েও দুশ্চিন্তার, গুজবের কারণে চলমান বাস্তবতাটি অধিকতর বিপদসংকুল হয়ে উঠেছে। সংবিধান, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা এতটাই বিপন্ন যে, মুসলমানদের এখন জনপরিসরে নিজেদের ধর্মীয় পরিচয়-চিহ্নগুলি গোপন রাখতে হচ্ছে। এই বিপন্নতা নিয়ে ভারতীয় গণকন্ঠে যে ক্ষীণ প্রতিবাদটুকুও ধ্বনিত হচ্ছে, তাকে স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য গুজবের বিজয়গর্বিত ব্যবহার— পশ্চিমবঙ্গে হিন্দুরা আক্রান্ত! অতএব, দিল্লিতে, ঝাড়খণ্ডে, হরিয়ানা বা উত্তরপ্রদেশে মুসলমানদের উপর একের পর এক আক্রমণগুলো নিয়ে যে সামান্যতম ক্ষোভও জাহির হচ্ছিল, তা বসিরহাটের গুজবে আচ্ছাদিত, আবার ‘হিন্দুদের উপর আক্রমণের বদলা নিতে’ মুসলমানবিরোধী ঘৃণা ও হিংসার সমাবেশে উদ্যমের নতুন রসদও জোগাড় করে নেওয়া হল।
অথচ, সামান্য রাজনৈতিক কাণ্ডজ্ঞান এবং দেশ ও প্রজাকুলের প্রতি দায়বদ্ধতা দেখাতে পারলেই এই বিভীষিকার সম্ভাবনাটাকে এড়ানো যেত। তার প্রমাণ, বসিরহাটে সফল প্রশাসনিক উদ্যোগের মধ্যে দিয়ে পরিস্থিতির স্বাভাবিক হয়ে ওঠার সূচনা। শান্তি ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে স্থানীয় জনসাধারণ, অবশ্যই, খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। জনপ্রতিনিধি কাজী আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে বাদুড়িয়া এলাকায় যার শুরু, সেই বৃহত্তর লোকচেতনা অন্যত্র, অন্যান্যদের সাহায্যে ব্যাপ্ত হয়েছে। কিন্তু, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও, এই লোক-উদ্যম এককভাবে হিংসা প্রতিহত করতে পারে না। তার প্রধান কারণ, সাম্প্রদায়িক হিংসার চরিত্রটি শুধু সশস্ত্রই নয়, বরং তাকে সশস্ত্র করেছে যুক্তি-বুদ্ধি-বিবেক-মনুষ্যত্ব বহির্ভূত এক উন্মত্ততা। অন্য পক্ষে, নিরস্ত্র লোক-উদ্যোগ এক অমানুষিকতার বিরুদ্ধে অন্য এক নারকীয়তার আশ্রয় নিতে পারে না। সুতরাং, সাম্প্রদায়িক উন্মাদনার কালে কেবল শান্তির বাণী, সম্প্রীতির মহত্ত্ব প্রচার সশস্ত্র দাঙ্গাবাজদের নিরস্ত করতে অপারগ, নিষ্পক্ষ প্রশাসনিক তৎপরতাই এখানে প্রধান ব্যাপার। বলা দরকার, শান্তি কমিটি নামে যে বস্তুটির কথা বলা হচ্ছে, সেটা সোনার পাথরবাটি: হয় সেটার অস্তিত্ব কাগজে কলমে, অথবা সেটা হয়ে উঠবে সালবা জুডুম-এর মতো একটা অত্যাচারীদের সংগঠন।
দেশে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার কুৎসিত ইতিহাসটি বলবান; সে তুলনায় দাঙ্গা দমনের ইতিহাস কিছুটা ক্ষীণ। কিন্তু, সেই সীমিত ইতিহাসের শিক্ষা থেকেও প্রশাসনিক তৎপরতার এই মৌলিক ভূমিকাটার কথা আমাদের জানা। পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় হাওড়ায় যখন সাম্প্রদায়িক হিংসা শত শত প্রাণ নিচ্ছে, তখন, মুখ্যমন্ত্রী বিধান রায়, আইসিএস অফিসার অশোক মিত্রকে সেখানে পাঠালেন জেলাশাসক করে। বিবেকবান সেই আধিকারিক তখন সচিব পদমর্যাদায় আসীন, কিন্তু তাঁর কাছে বিচার্য ছিল পরিস্থিতির ভয়াবহতা, পদমর্যাদা নয়। তিনি সম্মত হলেন, কিন্তু একটি শর্ত রাখলেন, মুখ্যমন্ত্রী তাঁর কাজে হস্তক্ষেপ করবেন না। ডা. রায় সে শর্ত গ্রহণ করলেন। মিত্রমশাই কাজে যোগ দেওয়া মাত্র তৎকালীন শাসক দল কংগ্রেসের মদতে পুষ্ট গুন্ডাদের গ্রেফতার করালেন। মৌচাকে ঢিল; অশোকবাবুর কাছে ডা. রায়ের ফোন, তুমি তো আমার দলের সবাইকে ধরে নিয়েছ! প্রত্যুত্তরে প্রশ্ন, আপনি কোনটা চান? দাঙ্গা, না আপনার দলের লোকেদের বাইরে থাকা? দাঙ্গা থেমেছিল।
প্রশাসনিক তৎপরতার আর একটি উদাহরণ তৈরি করেছিলেন লালুপ্রসাদ যাদব। অবিভক্ত বিহারের (বর্তমান ঝাড়খণ্ডের) রামগড়ে রামনবমীর দিন দাঙ্গা— কার্যত মুসলমান নিধন— নিয়মে পরিণত হয়েছিল। লালুপ্রসাদ ক্ষমতায় আসার প্রথম বছরই রামনবমীর আগে হাজারিবাগের জেলাশাসককে জানালেন, রামনবমী পর্যন্ত আপনিই হাজারিবাগের মুখ্যমন্ত্রী, যা খুশি করুন, কিন্তু দাঙ্গা যেন না হয়। জেলাশাসক মুখ্যমন্ত্রীর আস্থার মর্যাদা রেখেছিলেন। বস্তুত, রামগড়ে দাঙ্গা না হওয়ার সেই ধারা বহু দিন অক্ষুণ্ণ ছিল— বর্তমান ঝাড়খণ্ডে বিজেপির রাজত্বে তা আবার ফিরে এসেছে। লালুপ্রসাদের একটি কথা তো প্রবাদ হয়ে উঠেছে, ‘সরকার ন চাহিঁ তো দঙ্গা ন হোই’, অর্থাৎ, সরকার না চাইলে দাঙ্গা হয় না।
কারা দাঙ্গার প্রণেতা, কারা আয়োজক, আর কারাই বা তার সংঘটক, তা সরকারের অজানা নয়। বস্তুত, বহু ক্ষেত্রেই নানবিধ অপরাধের কথা-কাহিনি বিষয়ে সরকার পূর্বাহ্ণেই অবহিত থাকে, কিন্তু সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থে অথবা বাধ্যবাধকতায় যথার্থ ব্যবস্থা নেওয়া থেকে নিজেকে বিরত রাখে। বর্তমান রাজ্য সরকার যদি এই রকম সংকীর্ণতা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখতে পারত, তা হলে জোর দিয়ে বলা যায়, বসিরহাট ঘটত না। রাজ্য সরকার বিজেপি ও সংঘ পরিবারের আচরণের বিরুদ্ধে ঠিক ভাবেই সরব, কিন্তু কথার সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাগ্রস্ত ও শিথিল। গণ আন্দোলন দমনের ব্যাপারে সরকার অত্যন্ত ‘দৃঢ়’, কথায় কথায় গণ আন্দোলনকর্মীদের গ্রেফতার, তাঁদের বিরুদ্ধে কঠোর ইউএপিএ আইনে অভিযোগ আনতেও তার বিবেকের বিচলন নেই, অথচ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে ঈষৎ রাজনৈতিক ঝুঁকি নিতেও তার এত দোনামনা। এই দোনামনাই তো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ এবং গুজবকে হাতিয়ার করে পশ্চিমবঙ্গের শাসনক্ষমতায় আসার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে প্রতিপক্ষের সামনে, ক্ষমতায় আসতে পারার মতো কোনও রাজনৈতিক দাবি তো তার হাতে নেই। কিন্তু, এগুলো জানা থাকা সত্ত্বেও রাজ্য সরকার হিংসা উন্মূলনে নিষ্পক্ষ প্রশাসনিক পদক্ষেপ নিতে অপারগ থাকল কেন?
কারণটা সম্ভবত এই যে, সাম্প্রতিক দাঙ্গার চরিত্র কিছুটা আলাদা: এখানে হিন্দু বনাম মুসলমান, এবং বিজেপি বনাম তৃণমূল সমীকরণটি পরিস্থিতিকে জটিল করে তুলেছে। কিঞ্চিৎ সৌভাগ্য, এমন দুর্ভাগ্যজনক বাস্তবতা থেকে উদ্ধার পাওয়ার জন্য যে যুক্তিশীলতার দরকার, রাজনীতির বাইরে লোকসমাজে তার কিছু দৃষ্টান্ত দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গে ধর্ম-সাম্প্রদায়িক হিংসা ও বিদ্বেষের প্রলোভন পরিহার করার অনন্য ঐতিহ্যে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে রাজ্যবাসীর বড় অংশটিই সম্প্রীতির পক্ষে। কিন্তু শুধু সম্প্রীতির বার্তায় কাজ হবে না। ধর্মভাবনার বাইরে সাধারণ মানুষের বহু দুর্ভাবনা আছে: শিক্ষার অবস্থা শোচনীয়, স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও নানা অন্যায্যতা; কর্মনিয়োজন ও দৈনন্দিন জীবিকা নির্বাহের অনিশ্চয় মানুষকে অসহায় জীবে পরিণত করেছে। মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা তো আরও খারাপ— তাঁদের প্রায় ৮০ শতাংশই দিন আনা দিন খাওয়া; সাক্ষরতার হারে তাঁরা দলিতদের চেয়েও পিছিয়ে; সরকারি চাকরিতে, সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, তাঁরা মাত্র পাঁচ শতাংশ, যদিও মোট জনসংখ্যায় তাঁরা ২৭ শতাংশ। সাম্প্রদায়িকতার কারবারিরা এ জাতীয় দুর্ভাবনাগুলো থেকে মানুষের চোখ সরিয়ে নেওয়ার জন্যই ধর্মীয় আচ্ছন্নতার শরণ নেয়। তাদের এই ঘৃণ্য বিভাজনের রাজনীতিকে প্রতিহত করতে হলে তাদের পথে হাঁটার অর্থ তাদেরই পাতা ফাঁদে পা দেওয়া। একে প্রতিহত করা সম্ভব, কিন্তু তা কেবলমাত্র ভিন্ন ধারার রাজনীতির মধ্যে দিয়েই— রাজনীতির সঙ্গে ধর্মীয় সংযোগকে সম্পূর্ণ বাইরে রেখে। শাসক দল ও অ-বিজেপি বিরোধী পক্ষ, এবং নানা রূপে বিদ্যমান লোকসমাজ, সকলেই এ ব্যাপারে সারা দেশের কাছে উদাহরণ রাখতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy