Advertisement
E-Paper

নয়ানজুলি নিরুদ্দেশ

হয়তো আর ক’দিন পরে গ্রামগঞ্জের ছেলেমেয়েরা বলবে, ‘নয়ানজুলি মানে কী বাবা?’ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ নয়ানজুলির অর্থ: ‘মাটি কাটায় রাস্তার পার্শ্বস্থ খাত।’

গৌরব বিশ্বাস

শেষ আপডেট: ০৯ অগস্ট ২০১৭ ০৬:০০

পশ্চিমে বাঁশ, পুবে হাঁস... খনার বচন মেনে নদিয়া-মুর্শিদাবাদের গ্রামে তৈরি হত ঘর। পশ্চিমে বাঁশবাগান ঝড় আটকাবে। আর পুবে থাকবে জল, যেখানে হাঁস চরবে। নিজের পুকুর যাদের নেই, তাদের থাকত নয়ানজুলি। বর্ষায় তাতে ভরা জল। কালভার্টের এক দিকে জাল পেতে সকাল-বিকেল টাটকা পুঁটি, খয়রা, খলসে, ট্যাংরা, শোল। বর্ষার নয়ানজুলি ছোটদের সাঁতার শেখার আদর্শ স্থান। কেউ নেমে পড়ছে প্লাস্টিকের জারিকেন নিয়ে, কেউ পাটের জাঁক দু’হাতে ধরে পা চালাচ্ছে। বর্ষা শেষেও জেগে থাকত নয়ানজুলি। তার পাড়ে কাশের ঝালর মনে পড়িয়ে দিত— দুয়ারে দুগ্গা! পাশের আনাজ খেতের সেচের জল আসত নয়ানজুলি থেকে। জল আরও একটু কমে গেলে তার বুকেই বোনা হত বীজতলা। তার পর নয়ানজুলিতে বেড়ে উঠত লকলকে ঘাস। গৃহস্থ বলতেন, ‘‘গরুগুলোকে এক বার নয়ানজুলি ঘুরিয়ে আনিস।’’

ফের বর্ষা হাজির, বৃষ্টিও হচ্ছে ভালই। কিন্তু জল ধরে রাখার সেই আধার কই! রাস্তার দু’ধার থেকে তারা উধাও। মুর্শিদাবাদের জেমো এন এন হাইস্কুলের শিক্ষক তথা মাছ, জল, মৎস্যজীবী গ্রন্থের লেখক সূর্য্যেন্দু দে বলছেন, ‘‘মুর্শিদাবাদের প্রায় ৬০ শতাংশেরও বেশি নয়ানজুলি ভরাট হয়ে গিয়েছে।’’ তাঁর আক্ষেপ, ‘‘নদী কিংবা পুকুর ভরাট নিয়ে যতটা হইচই হয়, তার সিকি ভাগও যদি নয়ানজুলি নিয়ে হত!’ শ্যাম বেনেগালের ‘ওয়েল ডান আব্বা’ ছবিতে সরকারি অনুদানে তৈরি কুয়ো গায়েব হয়ে গিয়েছিল, ‘কুয়োচুরি’-র মামলা করেছিল পুলিশ। নদিয়া-মুর্শিদাবাদেও চাইলে কেউ মামলা করতে পারে নয়ানজুলি উদ্ধার করতে। ভূমি ও ভূমি সংস্কার দফতরের নথিপত্রে যে সব নয়ানজুলি জ্বলজ্বল করছে, গ্রামে গিয়ে দাঁড়ালে দেখা যাচ্ছে তারা ‘মিসিং।’ কী করে এমন হল?

উত্তর অজানা নয়। যেখানে বড় বড় নদী মরে যাচ্ছে, তার বুকে চলছে চাষ-আবাদ, নদীখাত দখল করে তৈরি হচ্ছে রাস্তা, বাড়ি, সেখানে আটপৌরে নয়ানজুলি বাঁচবে কী করে? ২০০০ সালে বানভাসি হয়েছিল মুর্শিদাবাদের বহু গ্রাম। গঙ্গার বাঁধ, রেল লাইন ভেঙে জল ঢুকেছিল নদীর পশ্চিম পাড়েও। বানের জল নেমে গেলে দেখা গেল, খেতের উপর উঁচু হয়ে জমে রয়েছে বালি। তা ফেলা হবে কোথায়? মজুর দিয়ে তা ফেলা হল নয়ানজুলিতে। তার উপর প্রথমে ইতিউতি দু’একটি গুমটি, তার পর একে একে বাড়ি, গুদাম। এখন সে সব জায়গায় জমজমাট দোকানপাট। মসৃণ পিচ-রাস্তার পাশে সে সব দেখে কারও বোঝার সাধ্যি নেই, দেড় দশক আগে সেখানে ছিল ছ’হাত-সাত হাত চওড়া নয়ানজুলি।

হয়তো আর ক’দিন পরে গ্রামগঞ্জের ছেলেমেয়েরা বলবে, ‘নয়ানজুলি মানে কী বাবা?’ হরিচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘বঙ্গীয় শব্দকোষ’-এ নয়ানজুলির অর্থ: ‘মাটি কাটায় রাস্তার পার্শ্বস্থ খাত।’ ‘চলন্তিকা’য় রাজশেখর বসু বলছেন: ‘জলনিকাশের নরদমা’। গ্রামের অনেকে কিঞ্চিৎ কল্পনা মিশিয়ে ব্যাখ্যা করেন, রাস্তা হল নাকের মতো, আর তার দু’পাশ দিয়ে বয়ে চলা জলের ধারা নয়ানজুলি। জল থেকে ‘জুলি’ কি না, তার উত্তর দিচ্ছে না অভিধান। কিন্তু জল সংরক্ষণে, জল জোগান দিতে নয়ানজুলির গুরুত্ব নিয়ে সংশয় নেই। ‘জল ধরো, জল ভরো’ প্রকল্পের অনেক আগে থেকেই এই কাজটি নিজ দায়িত্বে পালন করত নয়ানজুলি। নিকাশি, সেচের জন্য যেমন তার প্রয়োজন, তেমনই পাট পচাতেও। ডোবা-পুকুরের পানা-ভরা জলে পচানোর চাইতে নয়ানজুলির পরিষ্কার জলে পচানো পাটের রঙের বাহার বেশি, দামও বেশি ওঠে। এখন পাট পচানোর জল খুঁজে নাকাল চাষি। যাঁদের সামর্থ্য আছে, তাঁরা নিজেদের জায়গায় জল ধরে পাট জাঁক দিচ্ছেন। যাঁদের সে সামর্থ্য নেই তাঁরা খুঁজে বেড়াচ্ছেন এক টুকরো নাবাল খাস-জমি। সেখানে জমা জলটুকুই এখন ভরসা। এক জনের পাট পড়তে না-পড়তেই আর এক জন এসে বলছেন, ‘‘হয়ে গেলে বোলো কর্তা। আমার পাটগুলো পচাতে দেব।’’

কলকাতার ভিআইপি রোডের দু’পাশে নয়ানজুলি ভরাট করা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। জল গড়িয়েছে আদালত পর্যন্ত। আদালত রায় দিয়েছে, নয়ানজুলি আবার ফিরিয়ে দিতে হবে আগের অবস্থায়। কিন্তু দেবে কে? প্রকাশ্যে দিনের পর দিন নয়ানজুলি ভরাট করা হচ্ছে। গ্রামে একটা কথা প্রায়ই শোনা যায়— জমি কারও বাপের নয়, জমি দাপের। সেই দাপটে গোটা রাজ্য জুড়েই একের পর এক জেলাতে নদী, পুকুর, নয়ানজুলি সব হয়ে যাচ্ছে বাস্তুজমি। নিয়মের তোয়াক্কা না করে, জমির শ্রেণি না বদলে, খেত-পুকুর-ভিটে সব এখন একাকার হয়ে যাচ্ছে।

এখন নয়ানজুলি হল গ্রাম-শহরের ‘ডাম্পিং গ্রাউন্ড।’ একশো দিনের কাজের প্রকল্পে পুকুর খুঁড়ে তার মাটি ফেলা হচ্ছে নয়ানজুলিতে, এ তো চোখের সামনে দেখা। ব্যক্তিগত পুকুরের সংস্কারও একশো দিনের কাজের প্রকল্পের অধীনে করা হয়, কিন্তু অন্তত নদিয়া-মুর্শিদাবাদে নয়ানজুলির সংস্কার কোনও প্রকল্পে ঠাঁই পায়নি। জল বয়ে যাওয়ার জায়গা নেই, নয়ানজুলির জল জমছে জমির বুকে।

drainage Monsoon Garbage
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy