ইন্দ্রেশ কুমার।ছবি পিটিআই।
ইন্দ্রেশ কুমার অকিঞ্চিৎকর। রাজনাথ সিংহ নহেন। প্রথম জন সঙ্ঘ পরিবারের স্থানীয় নেতা। দ্বিতীয় জন ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। এ হেন দুই জন যখন একই সুরে বাজিয়া উঠেন, তখন বোঝা সম্ভব, সেই সুরের স্বরলিপি কোথায় লেখা হইয়াছে। সুপ্রিম কোর্ট আদেশ করুক বা দেশের নাগরিক সমাজ দাবি পেশ করিয়া যাউক, নাগপুরকে দমাইতে পারে, সাধ্য কাহার! যে দিন রাজনাথ সিংহ তুল্যমূল্য হিসাব পেশ করিয়া বুঝাইতে চাহিলেন যে নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হইবার পূর্বেও দেশে গণপ্রহারে মৃত্যুর ঘটনা ঘটিত, সে দিনই ইন্দ্রেশ কুমার এই হিংস্রতা বন্ধের দাওয়াই বাতলাইয়া দিলেন। জানাইলেন, গোহত্যা হইলে হিন্দুর রক্ত গরম হইবেই। অতএব, (মুসলমানরা) গরু খাওয়া বন্ধ করুন, সন্ত্রাসও বন্ধ হইয়া যাইবে। এই ষড়জ-পঞ্চম মিলাইলে যে সুরটি ফুটিয়া উঠে, তাহা এই প্রকার: প্রথমত, গোসন্ত্রাস যদি হইয়াই থাকে, তাহার দায় মুসলমানদের; দ্বিতীয়ত, কোনও কারণেই এই দায় কেন্দ্রীয় সরকার বা নরেন্দ্র মোদীর নহে। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশের পর প্রায় এক সপ্তাহ পার করিয়া সরকার দুইটি কমিটি গঠন করিতে পারিয়াছে। তাহার পরও গোসন্ত্রাস অব্যাহত। সেই আবহে রাজনাথ সিংহ-ইন্দ্রেশ কুমারের জোড়া বক্তব্য বিশেষ তাৎপর্যবাহী। তাঁহারা কার্যত স্পষ্ট করিয়া দিলেন, যে যাহাই বলুক না কেন, গোসন্ত্রাস বন্ধ করিবার প্রকৃত উদ্যোগ কেন্দ্রীয় সরকারের নিকট আশা করা অনর্থক। নাগপুরের নিকট গরুর দাম মানুষের অধিক। বিশেষত, সেই মানুষ যদি কোনও একটি বিশেষ ধর্মাবলম্বী হয়।
সঙ্ঘ-নেতার বক্তব্যটি তুলনায় সৎ। দেশের প্রতি, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিকতার প্রতি তাঁহার কোনও দায়বদ্ধতা নাই। তিনি সেই ভড়ংয়ের ধারও ধারেন নাই। দেশের আদালত যতই খাদ্য নির্বাচনে মানুষের অধিকারের কথা বলুক, শুধু মুসলমান নহে, দেশের বিপুল সংখ্যক মানুষের নিকট গোমাংস যতই প্রোটিনের সস্তা এবং প্রধানতম উৎস হউক, তাঁহারা যে গোমাংস ভক্ষণের অধিকারটি মানিয়া লইতে নারাজ, ইন্দ্রেশ কুমার স্পষ্ট বলিয়াছেন। এবং, ইহাও জানাইয়াছেন যে আইনের পরোয়াও তাঁহারা করেন না— কাহাকে বা কাহারও কাজকে অপছন্দ হইলে পিটাইয়া মারিয়া ফেলাই তাঁহাদের নিকট ন্যায়বিচার। মৌলবাদীদের নিকট ভিন্নতর অবস্থান কেহ প্রত্যাশাও করেন না। তেলঙ্গানার এক বিজেপি বিধায়ক আরও এক ধাপ আগাইয়া জানাইয়াছেন, গরুকে ‘রাষ্ট্রমাতা’ হিসাবে স্বীকার না করা অবধি সন্ত্রাস বন্ধ হইবে না। নাগপুরের মন বুঝিতে ভারতের সমস্যা হইবার কথা নহে।
কিন্তু, রাজনাথ সিংহ কেবল নাগপুরের প্রতিনিধি নহেন। সংবিধানকে সাক্ষী মানিয়া তিনি দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হইয়াছেন। ফলে, তিনিও যখন গোসন্ত্রাস ঢাকিতে কুযুক্তির অবতারণা করেন, তখন তাহার অন্যায্যতা ভিন্ন মাত্রার। প্রথমত, তিনি অসত্য বলিতেছেন। ২০১০ সাল হইতে আজ অবধি যত গোসন্ত্রাসের ঘটনা ঘটিয়াছে, হিসাব বলিতেছে, তাহার ৯৮ শতাংশই ঘটিয়াছে নরেন্দ্র মোদীর শাসনকালে। অতএব, তুলনামূলক বিচারে দায় লাঘব হইবার কোনও প্রশ্নই নাই। আর, যদি তাহা না-ও ঘটিত, যদি পূর্বসূরির জমানার সহিত নরেন্দ্র মোদীর জমানায় গোসন্ত্রাসের ঘটনার সংখ্যার সাযুজ্য থাকিত, তাহাতেও কি সরকারের দায় ফুরাইয়া যাইত? আগে হইত, অতএব এখনও হইবে— এই যুক্তিতে কি পার পাইতেন রাজনাথরা? গোসন্ত্রাস ভয়ঙ্কর ঘটনা, তাহা মানবাধিকারের পরিপন্থী, দেশের গণতান্ত্রিক পরিবেশের পক্ষে মারাত্মক। এই কারণেই সর্বশক্তিতে তাহা প্রতিরোধ করা সরকারের কর্তব্য। রাজনাথ সিংহের অজুহাতে সন্দেহ হয়, সুপ্রিম কোর্ট তাঁহাদের সেই কর্তব্যের মুখে দাঁড় করাইয়া দেওয়ার পরও তাঁহারা পলায়নের রাস্তা খুঁজিতেছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy