Advertisement
০৮ ডিসেম্বর ২০২৪
প্রবন্ধ ১

গ্রামের জন্য যেমন ব্যাঙ্ক চাই, ঠিক তেমন

এত দিন অবধি গ্রামাঞ্চলেও ব্যাঙ্ক চলেছে শহরের যুক্তি মেনেই। তার ফলে, সেই পরিষেবা কখনও গভীরে যেতে পারেনি। ‘বন্ধন’ গ্রামীণ অর্থনীতির চলন চেনে। তার হাত ধরে কি ব্যাঙ্কিং পরিষেবা বদলাবে?এ বার পুজোয় বাঙালির জন্য সেরা উপহার কি, এই প্রশ্নের উত্তর: ‘বন্ধন ব্যাঙ্ক’। স্বাধীন ভারতে এই প্রথম কোনও বাঙালি একটি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন, এই কারণে নয়। বরং, ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থা থেকে গরিব মানুষকে মুক্তি দেওয়ার একটা পথ পাওয়া গেল বলেই।

সূচনা। বন্ধন ব্যাঙ্কের উদ্বোধনে অরুণ জেটলি, চন্দ্রশেখর ঘোষ ও অমিত মিত্র।  ছবি: কিশোর রায়চৌধুরী

সূচনা। বন্ধন ব্যাঙ্কের উদ্বোধনে অরুণ জেটলি, চন্দ্রশেখর ঘোষ ও অমিত মিত্র। ছবি: কিশোর রায়চৌধুরী

সন্দীপ মিত্র
শেষ আপডেট: ১৩ অক্টোবর ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

এ বার পুজোয় বাঙালির জন্য সেরা উপহার কি, এই প্রশ্নের উত্তর: ‘বন্ধন ব্যাঙ্ক’। স্বাধীন ভারতে এই প্রথম কোনও বাঙালি একটি বাণিজ্যিক ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করতে পারলেন, এই কারণে নয়। বরং, ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থা থেকে গরিব মানুষকে মুক্তি দেওয়ার একটা পথ পাওয়া গেল বলেই। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক যে ৪.৯ লক্ষ গ্রামে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা পৌঁছে দেওয়ার কথা বলেছে, সেটা কি এ বার বাস্তবায়িত হবে?

ভুঁইফোঁড় আর্থিক সংস্থাগুলি কেন এত মানুষকে বোকা বানাতে সক্ষম হয়, প্রশ্নটি যথেষ্ট আলোচিত। যথেষ্ট নজরদারির ব্যবস্থা না থাকা অথবা মানুষের দ্রুত বড়লোক হওয়ার লোভের চেয়েও বড় কারণ, অর্জিত টাকা জমা রাখার মতো মাধ্যম সাধারণ, গরিব মানুষের নেই। গ্রামাঞ্চলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কের শাখা আছে, গ্রামীণ ব্যাঙ্কও আছে, কিন্তু সেগুলি চলে মূলত শহরের প্রথাগত যুক্তিতে। সাধারণ মানুষ থেকে গিয়েছেন ব্যাঙ্কিং পরিষেবার বাইরেই।

শহরের যুক্তি বলতে ঠিক কী বোঝায়? সহজ ভাষায়, মানুষ তাঁর প্রয়োজনে ব্যাঙ্কের কাছে আসবেন, এবং নির্দিষ্ট নথিপত্র তৈরির মাধ্যমে টাকা জমা দেবেন অথবা ঋণ নেবেন। ঋণ নেওয়ার জন্য যে বন্ধক প্রয়োজন, তা তাঁদের কাছে থাকবে। অভিজ্ঞতা বলছে, এখানেই ঠেকে যান গ্রামের গরিব, প্রান্তিক মানুষ। তাঁদের হাতে টাকা থাকলেও হয় সে টাকা তাঁরা নিজেদের ঘরেই জমিয়ে রাখেন, অথবা খরচ করে ফেলেন। টাকা জমা রাখার জন্য নির্দিষ্ট মূল্য আদায় করছে কোনও এক সংস্থা, এমন ঘটনাও একাধিক বার খবরে এসেছে। আর, ভুঁইফোঁড় সংস্থা তো আছেই। সবক’টা জিনিসই একটা দিকে নির্দেশ করছে— গ্রামের মানুষের সঞ্চয়কে প্রতিষ্ঠানের আওতায় নিয়ে আসতে হলে তাঁদের ঘরের দরজায় পৌঁছে যেতে হবে।

ঋণের ক্ষেত্রেও ব্যাঙ্ককে যেহেতু লাভযোগ্যতার কথা মাথায় রেখে চলতে হয়, তাই উপযুক্ত বন্ধক ছাড়া ব্যাঙ্ক বেশির ভাগ সময় ঋণ দিতে পারে না। বেশির ভাগ গরিব মানুষের পক্ষেই এই বন্ধকের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয় না। তাঁরা বাধ্য হন স্থানীয় মহাজনদের থেকে চড়া সুদে ঋণ নিতে।

ব্যাঙ্ক থেকে সব রকম প্রয়োজনে ঋণ পাওয়াও যায় না। ভূমিহীন কৃষক ছেলেকে হাসপাতালে ভর্তি করার জন্য ব্যাঙ্কের ঋণ পাবেন না। অথবা, ফসলের দাম পড়ে গেলে ব্যাঙ্ক ঋণের কিস্তি কমাবে না।

ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলি এই গোত্রের সুবিধা দেয়। ফলে, ঋণের ক্ষেত্রে মহাজন-নির্ভরতার চক্রটিকে ভাঙতে পেরেছে তারা। কী ভাবে গ্রামীণ মহিলাদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী তৈরি করে, গোষ্ঠীর সদস্যদের পরস্পরের আচরণের দায়িত্ব নেওয়ার ব্যবস্থা করে বন্ধক ছাড়াই ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলি সফল ভাবে ঋণ দিতে পেরেছে এবং টাকা ফেরতও পেয়েছে, সেই মডেলটি যথেষ্ট আলোচিত। ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলি যে কাজটা পেরেছে, সেটা তাৎপর্যপূর্ণ— প্রথাগত আর্থিক সম্পর্কের ছক ভেঙে বেরিয়ে এসে তারা গ্রামীণ সমাজের সামাজিক সম্পর্ককে ঋণ প্রদানের কাজে ব্যবহার করতে পেরেছে। সামাজিক সম্পর্ককে একটি অর্থনৈতিক সম্পদ হিসেবে দেখা সম্ভব হয়েছে এই ক্ষুদ্র ঋণের মডেলে। এবং, ক্ষুদ্র ঋণ প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে ‘বন্ধন’ এই ক্ষেত্রে অগ্রণী।

প্রথাগত ব্যাঙ্ক, তা সে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কই হোক বা গ্রামীণ ব্যাঙ্ক, তা গ্রামের সমাজের ভিতরে ঢুকতে পারেনি। বন্ধন পেরেছে। এই ঢুকতে পারাটা জরুরি। গ্রামীণ ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পৃথক মডেল তৈরিই হত না, যদি না গ্রামীণ সমাজের চরিত্রটা ধরা যেত। এখন একটা সম্পূর্ণ ব্যাঙ্কে পরিণত হওয়ায়, আশা করা যায়, গ্রামীণ সমাজ সম্বন্ধে বন্ধনেরা পুরনো বোঝাপ়়ড়া সংযুক্ত হবে ব্যাঙ্কিং-এর নতুন দুনিয়ায়। গ্রামীণ ব্যাঙ্কিং-এরও ভোলবদল হতে পারে। যে ভাবে ঋণ পৌঁছে যায় মানুষের দোরগো়ড়ায়, আশা করা চলে, মানুষের ক্ষুদ্র সঞ্চয়কেও ব্যাঙ্কের আওতায় নিয়ে আসার জন্য ব্যাঙ্ক একই ভাবে মানুষের কাছে যাবে।

কথাটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক অথবা গ্রামীণ ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষ বোঝেন না, হতে পারে? তা হলে তাঁরা গ্রামে ব্যাঙ্কিং পরিষেবার কথা ভাবলেই কেন লাভযোগ্যতা কমানোর কথা ভাবেন, মানুষের কাছে পৌঁছে যাওয়ার কথা ভাবেন না কেন? গ্রামে ব্যাঙ্কিং পরিষেবা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য যে ব্যাঙ্কিং-এর মডেল পাল্টাতে হবে, সেটা কর্তারা হয়তো ভাবেন। কিন্তু, ভাবা এক জিনিস, আর একটা বড় প্রতিষ্ঠানকে সে পথে চালনা করা আর এক জিনিস। তার জন্য প্রতিষ্ঠানের খোলনলচে পাল্টাতে হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান মানেই যে অজস্র লালফিতের ফাঁদ, তাতে আটকে পড়ার আশঙ্কাই পরিবর্তনের পথে একটা মস্ত বাধা। ফলে, প্রথাগত ব্যাঙ্কগুলি বদলায় না। অন্য সমস্যাও আছে। কৃষিক্ষেত্রে ব্যাঙ্কের অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ বর্তমানে আট লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। এই চাপে ব্যাঙ্কগুলি নতুন পথে হাঁটার সাহসও করতে পারে না।

বন্ধনের ব্যবসার ধরনটাই গ্রামীণ অর্থনীতি-কেন্দ্রিক। তার কর্মীদের প্রশিক্ষণ এবং মানসিকতাও সেই তারেই বাঁধা। ফলে, তাদের ব্যাঙ্কও গোড়া থেকেই চলতে পারে এই নতুন পথে। বস্তুত, নতুন প্রতিযোগিতার ফলে যদি গ্রামীণ ব্যাঙ্কিং-এ একটা বিপ্লব আসে, অবাক হওয়ার কারণ নেই। এক মাসে কয়েক কোটি ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খুলে দিয়েই ছাপ্পান্ন ইঞ্চি ছাতি বাজিয়ে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিকরণের সাফল্য ঘোষণা করলেই হয় না, সত্যিই মানুষ সেই ব্যাঙ্কিং পরিষেবার সুবিধা পাচ্ছে কি না, সেটা দেখা প্রয়োজন। আর্থিক সংযুক্তিকরণ তখনই সম্ভব, যখন গরিব মানুষ দৈনন্দিন ব্যাঙ্কিং পরিষেবার সাবলীল ভাবে যুক্ত হতে পারে।

ব্যাঙ্ক হওয়ায় বন্ধনের পক্ষে বাজার থেকে টাকা তোলা অনেক সহজ এবং কম ব্যয়সাপেক্ষ হল। চন্দ্রশেখর ঘোষ ব্যাঙ্কের উদ্বোধনের দিনই জানিয়েছিলেন, তাঁরা ক্ষুদ্র ঋণে সুদের হার কমাচ্ছেন। আশা করা যায়, প্রতিযোগিতার ফলে অন্যান্য ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাও বাধ্য হবে সুদের হার কমানোর পথের কথা ভাবতে। অর্থাৎ, ক্ষুদ্র ঋণের বিরুদ্ধে যে প্রধান অভিযোগটি ছিল, তার খানিক হলেও সুরাহা হবে।

ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিকাল ইনস্টিটিউটে অর্থনীতির শিক্ষক

অন্য বিষয়গুলি:

sandip mitra abp latest post editorial bandhan bank ideal model rural bank gramin bank bandhan indian statistical institute
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy