অতীত: ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের দলীয় সমাবেশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও সোমেন মিত্র। কলকাতা, ১৯৯২
ধর্মের ঘণ্টাটি বড় মোক্ষম সময়ে বাজালেন সোমেন মিত্র। দৈনন্দিন রাজনীতি থেকে ইদানীং একটু দূরে দূরে থাকেন তিনি। শরীরও বিশেষ ভাল যাচ্ছে না তাঁর। কিছু দিন আগে গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালেও থাকতে হয়েছিল। কিন্তু এখন হঠাৎ ‘সক্রিয়’ হয়ে উঠে যা করলেন, তা এক কথায় বললে ‘সেমসাইড গোল’! বিশ্বকাপের বাজারে ‘কংগ্রেস কাপ’-এর খেলায় তাঁর এই কাণ্ড বড়ই মর্মান্তিক!
তবে সে প্রসঙ্গ আলোচনার আগে প্রেক্ষাপট বুঝে নেওয়া জরুরি। মূল বিষয় হল, কংগ্রেসের সঙ্গে তৃণমূলের ভোট-বোঝাপড়া হবে কি না। এখনও এটা লাখ টাকার প্রশ্ন। চট করে তার কোনও উত্তর মিলবে বলেও মনে হয় না। কারণ এর সঙ্গে জাতীয় রাজনীতির অন্য নানা সমীকরণ যুক্ত। এমনকি একা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বা রাহুল গাঁধীর চাওয়া-না-চাওয়ার উপরেও এর নিষ্পত্তি পুরোপুরি নির্ভর করবে না। নির্ভর করবে বিজেপি-বিরোধী জোট কী ভাবে কোন সূত্রের ভিত্তিতে কতটা দানা বাঁধবে, তার উপর। যদি পরিস্থিতি তৈরি হয়, এই জোট হবেই।
এ কথা অবশ্যই সত্যি যে, রাহুলের সঙ্গে মমতার সম্পর্কের রসায়ন এখনও খুব জমাট বাঁধেনি। আনুষ্ঠানিক সৌজন্যের বাইরে দু’জনের পারস্পরিক বোঝাপড়ার ক্ষেত্র আগের চেয়ে একটু উন্নত হলেও প্রধানমন্ত্রীর দৌড়ে রাহুলকে এগিয়ে রাখার বাসনা মমতা পোষণ করেন না। এখন পর্যন্ত করার কারণও নেই।
বস্তুত মমতার ফেডারাল ফ্রন্টের ভাবনার সঙ্গেই তো এটা মেলে না। তিনি রাজ্যে রাজ্যে আঞ্চলিক দলগুলির আসন বাড়িয়ে এমন অবস্থান তৈরি করতে চান, যাতে কংগ্রেসকেই ওই দলগুলির সম্মিলিত শক্তির উপর নির্ভর করতে হয় এবং পরবর্তী সময়ে নেতা নির্বাচনের ক্ষেত্রে রাহুল অনিবার্য পছন্দ হয়ে না ওঠেন। তাঁর এই চেষ্টা বা আশা কত দূর সফল হতে পারে, সেটা ভিন্ন প্রশ্ন। কিন্তু তাঁর মতো এক জন প্রতিষ্ঠিত রাজনীতিকের আরও ‘বড়’ হওয়ার আশা থাকাটাই স্বাভাবিক। সবটা খোলাখুলি না বললেও সম্প্রতি একটি ইংরেজি পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে মমতা নিজেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি অভিজ্ঞ সাংসদ, একাধিক বার কেন্দ্রে মন্ত্রী, রাজ্যে দ্বিতীয় দফায় সরকার চালাচ্ছেন। তাঁর ‘যোগ্যতা’ নিয়ে তাই সংশয় প্রকাশের জায়গা নেই।
এমন একটি প্রেক্ষাপটে মমতা হঠাৎ আগ বাড়িয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট বাঁধতে উৎসাহী হবেন কেন? নিজের দলের আসনসংখ্যা বাড়ানোই আপাতত হবে তাঁর প্রধান লক্ষ্য। কারণ তিনি জানেন, রাজ্যে তাঁর লড়াই হবে বিজেপির সঙ্গে। কংগ্রেস এবং সিপিএম এখন এতটাই দুর্বল যে তাদের থাকা-না-থাকায় সামগ্রিক ছবিটা আর বিশেষ বদলায় না। একের পর এক ভোটের ফলে তা বার বার প্রমাণিত। উল্টে কংগ্রেস পা রাখার একটু জমি পেয়ে গেলে তাতে তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোটব্যাঙ্কে, বিশেষ করে অবাঙালি সংখ্যালঘু ভোটে কিছুটা হলেও ভাগ বসানোর ‘ঝুঁকি’ থাকতে পারে। কিন্তু বিজেপির মোকাবিলায় মমতাকে ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট আঁকড়ে ধরতেই হবে। তিনি সেই ব্যাপারে যৎপরোনাস্তি সতর্ক। এমনকি জোট গড়ার ক্ষেত্রেও তিনি যাদের প্রাধান্য দিতে চাইছেন এই রাজ্যের রাজনীতিতে তারা অস্তিত্বহীন। অর্থাৎ তৃণমূলের ভোটের ভাগে তাদের থাবা পড়বে না। সব মিলিয়ে তাই রাজ্যে কংগ্রেসের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার সমূহ চিন্তাভাবনা তৃণমূল নেত্রী করবেন না, এটাই হয়তো তাঁর দিক থেকে স্বাভাবিক।
তবু রাজ্য কংগ্রেসের নেতারা প্রায় সকলেই এক সুরে বলতে শুরু করেছেন, তাঁরা রাজ্যে তৃণমূলের সঙ্গে জোট চান না। ভাবখানা এমন যেন, এটা তাঁদের চাওয়ার অপেক্ষায় আছে! অথবা, তাঁদের সঙ্গে জোট করার আকাঙ্ক্ষায় তৃণমূলের রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছে! আর সেটা করতে গিয়ে তাঁদের কেউ কেউ ইতিহাসবিস্মৃত হয়ে এমন কিছু কথাবার্তা বলছেন, যাতে নিজেদের গায়েই কালি লাগে। সোমেন মিত্র তারই এক নির্মম দৃষ্টান্ত।
লোকসভা নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্প্রতি রাজ্যের কংগ্রেস নেতাদের বৈঠকে ডেকেছিলেন রাহুল গাঁধী। কী করণীয়, সে সম্পর্কে প্রদেশ নেতাদের মতামত জানতে চেয়েছিলেন তিনি। সেখানেই অন্য অনেকের সঙ্গে প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি, নানা অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ সোমেনবাবু বুঝিয়ে এসেছেন, কংগ্রেসকে ‘বাঁচাতে’ হলে সিপিএমের সঙ্গে জোটে থাকা দরকার।
বড় মোক্ষম দাওয়াই এটা। আসলে বছরের পর বছর ধরে ঠিক এই কাজটাই তো সোমেনবাবুরা করে এসেছেন। রাজ্য কংগ্রেসকে সিপিএমের ‘বি-টিম’-এ পরিণত করার ‘কৃতিত্ব’ তাঁদের অনেকের ঝুলিতে ঝলমল করছে। কংগ্রেসের মুছে যাওয়ার সূচনা ঠিক এই ভাবেই হয়েছিল বাম আমল থেকে। যাঁরা আজ কংগ্রেসের ‘স্বার্থ’ দেখতে এত তৎপর, তাঁরা বিলক্ষণ জানেন, কী করে কংগ্রেস রাজ্যে এই কঙ্কালসার অবস্থায় পৌঁছেছে। মুছে যাওয়ার দিনগুলিতে এই সব কংগ্রেস নেতা ও তাঁদের অনুচরদের কার কী ভূমিকা ছিল, সেই আত্মসমীক্ষা করার সততা এঁদের ক’জনের আছে?
এটা মানতেই হবে যে, মমতা রাজ্য কংগ্রেসকে ‘গ্রাস’ করেছেন এবং দল ভেঙে তৃণমূলে যাওয়ার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। কিন্তু প্রশ্ন হল, এই পরিস্থিতি তৈরি হল কেন? মমতা তো রাতের অন্ধকারে ঘরে সিঁধ কেটে কংগ্রেসকে চুরি করে নিয়ে আসেননি। তিনি প্রকাশ্যেই দল ভাঙতে চেয়েছিলেন। প্রথমেই আগাম ঘোষণা করে সনিয়া গাঁধীর চোখের সামনে কংগ্রেসের ইনডোর সমাবেশের পাল্টা ‘আউটডোর’ সমাবেশ করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন কংগ্রেসের মূল স্রোত কার সঙ্গে। বলেছিলেন, ‘‘ওই কংগ্রেস ছিন্নমূল। আমরা তৃণমূল।’’ কংগ্রেসের বহু সমর্থক ও কর্মী সেটা বিশ্বাস করেছিলেন। পরবর্তী কালে দল ভেঙে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরির মধ্য দিয়ে সেই সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। বাকি যা, তা ইতিহাস। ভাঙন আরও স্ফীত। কংগ্রেস রাজ্যে আরও কোণঠাসা।
মনে আছে, ১৯৯২-এর নভেম্বরে মমতা কেন্দ্রে নরসিংহ রাও সরকারের মন্ত্রী থাকাকালীন যুব কংগ্রেসের নামে ব্রিগেডে সমাবেশ ডেকে সিপিএমের ‘মৃত্যুঘণ্টা’ বাজিয়েছিলেন। ওই মঞ্চ থেকেই তিনি মন্ত্রিত্ব ছেড়ে রাজ্যে আন্দোলন করার কথাও ঘোষণা করেন। জল্পনা ছিল, সোমেনবাবু যাবেন তো? গিয়েছিলেন এবং ব্রিগেড ভরানো ভিড় দেখে জনান্তিকে স্বীকারও করেছিলেন, মমতার এত জনপ্রিয়তা দেখে সিনিয়র নেতা হিসাবে তাঁর ‘লজ্জা’ হয়।
অথচ কংগ্রেসে মমতার উত্থান আটকাতে এই সোমেন মিত্ররাই এক সময় কত রকম কদর্য খেলা খেলেছেন, সে সব তাঁদের চেয়ে ভাল আর কে জানে! যদি কালের চাকা অন্য দিকে ঘুরত, যদি মমতাকে কংগ্রেস ভেঙে বেরিয়ে যেতে না হত, তা হলে আজ এই রাজ্যে কংগ্রেসের শোকগাথা গাইতে হত কি না, তা-ই বা কে বলতে পারে! ঘটনা যা-ই হোক, মমতা অন্তত মানুষকে এটা বিশ্বাস করাতে পেরেছিলেন যে, ওই কংগ্রেস ছিল ‘সিপিএমের দালাল’।
ভাগ্যের পরিহাস! সেই নেতারাই আজও সিপিএমের ছায়াতেই আশ্রয় খুঁজতে চান। আজ অবশ্য চোরাপথে নয়! খোলা গলায়। ২০১৬-র নির্বাচনে সিপিএমের সঙ্গে জোট বাঁধার ‘শিক্ষা’ও তাঁদের সংবিৎ ফেরায়নি। একই ঘূর্ণিপাকে অধীর চৌধুরীর হাত ধরে ঘুরছে এখনকার প্রদেশ কংগ্রেস।
তবে হ্যাঁ, পোড়-খাওয়া সোমেন মিত্র একটা কথা ঠিকই বলেছেন। ভোটে জিততে চাইলে তৃণমূলের সঙ্গে যাওয়াই বিধেয়। তিনিও তো কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূলে গিয়েই ২০০৯-এর লোকসভা ভোটে জিতেছিলেন এবং পাঁচ বছর সাংসদজীবন কাটিয়ে আবার টিকিট পাবেন না বুঝেই ফিরে যান পূর্বাশ্রমে। অথচ ফিরে গিয়ে সিপিএম-সমর্থিত কংগ্রেসের টিকিটে দাঁড়িয়ে ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে বৈতরণি পেরোতে পারেননি। তাঁর স্ত্রী শিখাদেবীও তৃণমূলে বিধায়ক হয়েছিলেন।
শুধু সোমেনবাবুই নন, রাজ্য কংগ্রেসের এ হেন ‘বিপ্লবী’দের জন্য করুণা ছাড়া আর কিছু অবশিষ্ট থাকে কি?
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy