Advertisement
০২ মে ২০২৪

পশুপতিপ্রসাদ মাহাতো (১৯৪৩-২০১৯)

তাঁর মতে, অতীত ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই হল জাতপাত অভিজাত-অনঅভিজাত উঁচু-নিচু ব্যবস্থার হিন্দুয়ানি। যার অনিবার্য ফল হিসাবে এসেছে দলিত শ্রেণির সাংস্কৃতিক নৈশব্দ, ‘কালচারাল সাইলেন্স’। লিখলেন নচিকেতা বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সংস্কৃতায়ন’ এর মৌলিক তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন এম এন শ্রীনিবাস। পশুপতিপ্রসাদ তাঁর উত্তরসূরি।

পশুপতিপ্রসাদ মাহাতো। ছবি: লেখক

পশুপতিপ্রসাদ মাহাতো। ছবি: লেখক

শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০১৯ ০২:৫৬
Share: Save:

পশুপতিপ্রসাদ মাহাতো। নৃতত্ত্ববিদ ও সমাজ ঐতিহাসিক। জীবনব্যাপী তাঁর কর্মজীবন। আমৃত্যু তিনি এই ছোটনাগপুর মালভূমি আর পশ্চিমবঙ্গের আদিবাসী জীবনের নৃতত্ত্ব বিষয়ে গবেষণা করেছেন। গত ২৯ অক্টোবর ছিল তাঁর জন্মদিন।

নৃতত্ত্ব মানে মানুষের দৈহিক, মানসিক, বৌদ্ধিক বিবর্তন প্রভৃতির পূর্ণাঙ্গ অধ্যয়ন। এই নৃতত্ত্বের গবেষক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন অগ্রণী সমাজতত্ত্ববিদও ছিলে পশুপতিবাবু। ছিলেন ‘নির্বাকায়ন’ তত্ত্বের প্রবক্তা। ‘নির্বাকায়ন’ কী? তাঁর ভাষায়, ব্রাহ্মণ্যবাদের সন্ত্রাস থেকে বিভিন্ন ঘামঝিঁটা, অর্থাৎ, পরিশ্রমুখী, উৎপাদনমুখী, সমাজমুখী মানুষেরা জাতপাতের শিকলে পড়ে গত তিন হাজার বছর ধরে এক পলায়ন প্রবৃত্তির আস্তরণ নিয়ে, কখনও সেবাদাস, অন্নদাস, ক্রীতদাস, উদারদাস হয়ে ভক্তদাসে পরিণত হয়েছে। যার অনিবার্য ফল সাংস্কৃতিক নৈশব্দ, ‘কালচারাল সাইলেন্স’। তাঁর মতে, অতীত ভারতের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যই হল জাতপাত অভিজাত-অনঅভিজাত উঁচু-নিচু ব্যবস্থার হিন্দুয়ানি। চৈতন্য উত্তরকালে ভক্তি আন্দোলনের প্রভাবে সম্পন্ন কৃষক ও উদ্বৃত্ত-নিয়ন্ত্রণকারী বড় চাষি (কিছু অব্রাহ্মণ সম্প্রদায়) ‘সুসংস্কৃত’ (sanskritization) হতে চেয়ে ব্রাহ্মণ্য প্রথা, জীবনবোধ ও লোকাচারের অনুশীলন করে সামাজিক অবস্থান বদল করে নিয়েছে। অন্য দিকে, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের প্রভাবে ইংরেজ শাসকগোষ্ঠীর তল্পিবাহক হয়ে উচ্চবর্ণের মানুষজনের সঙ্গে অনেক ধনী অন্ত্যজ গোষ্ঠী সামাজিক স্তরে অভিজাত হয়ে উঠলেন। এই উভয়শ্রেণিই কিন্তু নিজ নিজ সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট হারিয়ে মুনাফা সর্বস্ব চেতনায় দরিদ্র সাধারণের উপরে নির্যাতন ও শোষণ চালিয়ে গেছেন। স্বাধীনতা আন্দোলনেও উচ্চবর্ণের নেতাদের ও নব্য শেকড় হারানো শুদ্র কতিপয়ের প্রচারের পাদপ্রদীপে অবস্থান। সাধারণ অনগ্রসরশ্রেণির অবদান অবহেলিতও অনুচ্চারিত। দীর্ঘকালের শাসিত, শোষিত, বঞ্চিত, দলিত আদিবাসী সংখ্যালঘু শ্রেণি সংখ্যাগরিষ্ঠের লাঞ্ছনার অতিষ্ঠ ও অভ্যস্ত ও ব্যবহৃত হয়ে হীনমন্যতার সীমাহীন অতলে ডুবে যায়। হিন্দু উচ্চবর্ণের সাংস্কৃতিক হানাদারিতেও আদি জনগোষ্ঠীর আত্মগরিমার স্মৃতিহরণ। এটাই তার ‘নির্বাকায়ন’ তত্ত্ব।

‘সংস্কৃতায়ন’ এর মৌলিক তত্ত্বের প্রবক্তা ছিলেন এম এন শ্রীনিবাস। পশুপতিপ্রসাদ তাঁর উত্তরসূরি। নির্বাকায়ন সেই তত্ত্বের উল্টোপিঠ নয়। সংস্কৃতকরণের সঙ্গে তিনি যুক্ত করেছেন সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, ভাষাসন্ত্রাস এবং স্মৃতিহরণ প্রসঙ্গ। তিনি দেখিয়েছেন, উচ্চবর্ণের সেসব আগ্রাসন সক্রিয় ছিল আদিবাসী জীবনের ভিতরে ও বাইরে। মূলধারার সমাজবিজ্ঞানীরা এ যাবৎ তাঁদের গবেষণা থেকে এ সব কথা উহ্য রেখেছিলেন। এই আগ্রাসন এখনও অব্যাহত, শুধু প্রক্রিয়াটি পাল্টে গিয়েছে।

পশুপতিবাবু ছিলেন চাষির ছেলে। জন্ম ১৯৪৩, ২৯ অক্টোবর। পুরুলিয়া জেলার ডাবরগ্রামে। ডাবর কাঁসাই উপকূলে। পিতা রবীন্দ্রনাথ মাহাতো। মা অঞ্জনা দেবী। প্রাথমিক পাঠ নিজ গ্রামে। পুরুলিয়া জিলা স্কুলে ম্যাট্রিক। জে কে কলেজের স্নাতক। এখানেই তাঁর সঙ্গে সুধীর করণের সান্নিধ্য। ১৯৬৬ সালে রাঁচী বিশ্ববিদ্যালয়ে নৃতত্ত্ব বিদ্যার প্রথম শ্রেণিতে প্রথম। একই বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ডি লিট পাওয়া ১৯৯৫ সালে। প্রয়াত এবি সারন ছিলেন তাঁর ‘গাইড’। এর পর ভারতীয় সর্বেক্ষণে (অ্যানথ্রোপোলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া) সিনিয়র রিসার্চ ফেলো হিসাবে গবেষণা করেন। এই পর্বে তাঁর তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন সুরজিৎ চন্দ্র সিন্‌হা (ভূতপূর্ব নৃতত্ত্ববিদ ও উপাচার্য, বিশ্বভারতী)। বীরসা মুণ্ডা ও তাঁর আন্দোলনের সন্দর্ভকার কুমারে সুরেশ সিংহ এক পর্যায়ে তাঁর গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ভারতীয় সর্বেক্ষণ (কলকাতা) এ দীর্ঘকাল নৃতত্ত্ববিদের চাকরি করেছিলেন পশুপতিবাবু। অবসর নিয়েছিলেন ২০০৩ সালে।

এশিয়াটিক সোসাইটির আজীবন সদস্য পশুপতিবাবু ছিলেন ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব সোশ্যাল সায়েন্সের (ইলাহাবাদ) লাইফ ফেলো। ফোকলোর অ্যাকাডেমি অব ইন্ডিজেনাস পিপ্‌ল-এর প্রতিষ্ঠাতা ডিরেক্টরও ছিলেন তিনি। দলিত সাহিত্য অ্যাকাডেমিক ‘অম্বেদকর ফেলোশিপ’ও তিনি পেয়েছেন। সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক ছিলেন এক সময়। বক্তৃতা দিয়েছেন ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব অস্ট্রেলিয়া ও ব্রিটেন ফেস্টিভালে। বঙ্গে ও ঝাড়খণ্ডে সরকারি ও বেসরকারি স্তরে প্রচুর সম্মাননাও পেয়েছেন। সাগর বিশ্ববিদ্যালয় ও ভুবনেশ্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন। জীবনভর সক্রিয় কর্মী ছিলেন আদিবাসী উন্নয়নে। তাঁদের কথা লিখেছেন উপজীব্য করে। অসাধারণ বাগ্মী ছিলেন। ভালবাসতেন ঝুমুর। গাইতেনও। ঝুমুর রচয়িতা বিনন্দিয়া সিংহকে নিয়ে তাঁর বই ‘‘মহাকবি বিনন্দিয়া সিংহের পদাবলী রামায়ণ ও রাধাকৃষ্ণ’। গবেষণা করেছেন সুন্দরবনে। লিখেছেন, ‘সুন্দরবনে আদিবাসীদের আগমন ও তাঁদের অর্থনীতি এবং সংস্কৃতি প্রসঙ্গে’ ও ‘ভারতের আদিবাসী ও দলিত সমাজ’। তবে শ্রেষ্ঠ গবেষণা গ্রন্থ অবশ্য ‘স্যান্সক্রিটাইজ়েশন ভারসেস নির্বাকাইজেশন; এ স্টাডি অন কালচারাল সাইলেন্স অ্যান্ড এথনিক মেমসাইড ইন ঝাড়খণ্ড’।

‘ঝাড়খণ্ডের বিদ্রোহ ও জীবন’ বা ‘জঙ্গলমহল’-রাঢ়ভূমি ও ঝড়খণ্ডের ভূমিব্যবস্থা, সংস্কৃতি ও সংগ্রামী ইতিহাসের রূপরেখা’ প্রভৃতি গ্রন্থে লিখেছেন– আদিবাসী সংস্কৃতির গঠন ও রূপান্তর, বহিরাগত সমাজ, সংস্কৃতি ও রাষ্ট্রীয় গঠনের সঙ্গে সম্পর্ক ও সংঘাত বিষয়ে। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ চলে গেলেন পশুপতি প্রসাদ মহাতো। আমার মনে পড়ছে তাঁর গাওয়া ঝুমুর আখরের সঞ্চারী– ‘দুধিলতায় বাঁধব্য তুমাকে’।

লেখক সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE