Advertisement
০৮ মে ২০২৪
পার্থ চট্টোপাধ্যায়: নির্বাচনী কৌশল দিয়ে হিন্দুত্ববাদের স্থায়ী প্রতিরোধ অসম্ভব

পথ আছে দৈনন্দিন সংস্কৃতির মধ্যে

মধ্যবিত্তের সমাজ থেকে রাষ্ট্র সরে যাচ্ছে। অন্য দিকে গরিব মানুষের জীবনে আরও বেশি করে প্রবেশ করেছে।

পার্থ চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২২ মে ২০১৯ ০০:০৫
Share: Save:

প্র: রাষ্ট্র ও সমাজ বিষয়ে আপনার বিশ্লেষণের (‘রাষ্ট্র কাকে বলে...’, ২১-৫) সূত্র ধরে একটা প্রশ্ন। আমরা বলি, হাল আমলে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব-কর্তব্য ভুলে, মানুষকে ভুলে, সব কিছু বাজারের হাতে তুলে দিয়ে জনজীবন থেকে অপসৃত হচ্ছে। আপনি বলেন, ঠিক উল্টোটাই হয়েছে।

উ: মধ্যবিত্তের সমাজ থেকে রাষ্ট্র সরে যাচ্ছে। অন্য দিকে গরিব মানুষের জীবনে আরও বেশি করে প্রবেশ করেছে।

প্র: গণতন্ত্রের যে পরীক্ষানিরীক্ষার কথা আপনি বলেন তাতে সবার জন্যে সমান নীতি মেনে শাসনের সুযোগ নেই। এ নিয়ে মানুষের, বিশেষ করে মধ্যবিত্তের, অভিযোগ বিস্তর। আপনি ব্যাপারটা অন্য ভাবে দেখেন। আপনার মতে, যাদের কিছুই নেই তারা এই অবস্থায় নতুন সব সুযোগ জোগাড় করে নিচ্ছে, সেটা লক্ষ করা উচিত। একটি বইয়ের ভূমিকায় এও বলেছেন যে, গড়পড়তার হাতেই ভুবনের ভার বর্তাবে, তাতে মুখ ভার করার কিছু নেই। আপাতত পশ্চিমবঙ্গেও পপুলিস্ট রাজনীতি তথা গড়পড়তার আধিপত্য, দুটোই জমে উঠেছে। এ-বিষয়ে আপনার কী মত?

উ: যারা গড়পড়তা নয়, তাদের মানসিক বা নান্দনিক চাহিদা পপুলেশনকে নিয়ে যে-রাজনীতির কথা বলছিলাম, তার দ্বারা পূরণ হবে না। যেটা বাজারে চলে, সেই সংস্কৃতি তাদের জন্যে নয় এটা মেনে নিয়ে নিজেদের মতো করে চাহিদা পূরণ করে নিতে হবে।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

প্র: কেউ তো বলতে পারে, এ হল বাজারের কারবার, এ ঠিক গণতন্ত্রের ব্যাপার নয়।

উ: গণতন্ত্রের ব্যাপার নয় বলি কী করে? ধরো, সংবাদপত্রের রাজনৈতিক আলোচনা। অনেকে বলবেন, ত্রিশ-চল্লিশ বছর আগের তুলনায় তার মান অনেকটা পড়ে গিয়েছে। আসলে কাগজের পাঠক অন্য রকম হয়ে গিয়েছে, তাদের প্রসার ও বৃদ্ধিও ঘটেছে। গণতন্ত্রীকরণের সঙ্গে এই বদল আসবে। তোমার নিজস্ব গণ্ডিতে তুমি অন্য ভাষায় বিচরণ করতে পারো, কিন্তু আজ যদি ব্যাপক রাজনীতিতে প্রবেশ করতে চাও, সাধারণ মানুষের স্তরে গিয়ে তাদের ভাষা আয়ত্ত করে নিতে হবে। এ তো হবেই।

প্র: ঠিক। কিন্তু আরও একটা রাজনৈতিক অনুশীলনের কথা তো আমরা জানতাম। সেখানে আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সাধারণ মানুষও নিজেকে শিক্ষিত করে তোলে, তার রুচির বদল ঘটে। সেই প্রকল্প কি পুরোটা মুলতুবি রাখতে হবে?

উ: এটাই ছিল রাজনীতির শিক্ষামূলক দিক। এক সময় ধরে নেওয়া হত যে নেতারা হবেন সমাজের অগ্রগামী অংশ, যাঁরা বাকিদের এগিয়ে নিয়ে যাবেন। জাতীয়তাবাদী বা বামপন্থী রাজনীতিতে এ জিনিসটা ছিল। গণতান্ত্রিক রাজনীতি যত ব্যাপক হয়েছে, সম্পর্কটা উল্টে গিয়েছে। এখন জনগণের নেতা তিনিই হবেন যিনি জনতারই মতো। তাদের চেয়ে সেরা বা আলাদা কাউকে জনগণ নেতা বলে মানতে রাজি হবে না। তিনি নেতা কারণ তাঁর ক্ষমতা বেশি; কিন্তু তাঁকে মান্য করব কারণ তিনি আমাদেরই মতো। তাঁকে প্রায় সার্বভৌম ক্ষমতা, রাজার মতো ক্ষমতা দেওয়া হচ্ছে, কারণ, ভাবা হচ্ছে তিনি যা করবেন সাধারণের ভালর জন্যেই করবেন। ভারতের নানা প্রদেশের মতো এই রাজ্যেও এমন পপুলিস্ট নেতাদের দেখছি। এঁরা নিয়মকানুন মানা নিয়ে ভাবিত নন। লিবারাল রাজনীতির সঙ্কট থেকে এর সৃষ্টি। লিবারাল রাজনীতির কাছে বড় কথা হল, নিয়ম মেনে, নিরপেক্ষ প্রক্রিয়ায় সব সমাধা হল কি না; ফলটা ভাল হল কি হল না, তা গৌণ। এর বিরুদ্ধে পপুলিস্ট রাজনীতির আপত্তি এই যে, ওই নিরপেক্ষ বিচার আর আইনের মারপ্যাঁচে আমজনতার ক্ষতি হয়, লাভ হয় বড়লোকদের, যারা আইনকে নিজের স্বার্থে ব্যবহার করতে জানে। এখন এই ভাবে যখন নেতা স্থির হয়, তখন কে কাকে শিক্ষা দেবে? তুমি বলছ, অন্য প্রকল্পটা কি তা হলে ছেড়ে দেব? উত্তরে বলব, এই পপুলিস্ট রাজনীতির কিছু সাময়িক সুফল সাধারণ মানুষ পায়, কিন্তু এর মাধ্যমে কোনও বৃহত্তর সমাজ পরিবর্তন সম্ভব নয়। কারণ, এই রাজনীতি তেমন কোনও ধারণার উপর, কোনও আদর্শ ভবিষ্যৎ-কল্পনার উপর নির্ভরশীল নয়। তা হলে ওই শেখার বা এগোবার প্রকল্প আসবে কোথা থেকে? এখানে গোড়ায় যে কথাটা হচ্ছিল সেখানেই ফিরতে হয়। ওই যে বিভিন্ন ভাষার মধ্যে দিয়ে কল্পনা করার অভ্যাস, যেটা রাজনীতির ব্যাপার নয়, বরং দৈনন্দিন সংস্কৃতির ব্যাপার, ওই জায়গায় কিন্তু মানুষের কল্পনার পরিবর্তন ঘটে যাচ্ছে। জনপ্রিয় সংস্কৃতিতেও রুচির পরিবর্তন হচ্ছে। কথা হল, এই জায়গাটায় কী ভাবে হস্তক্ষেপ করা যায়। এইখানে একটা কাম্য ভবিষ্যৎ কী ভাবে কল্পনার মধ্যে আনা যায়।

প্র: প্রশাসনিকতার কথা শুনলে, মিশেল ফুকো-র কথা শুনলে, মনে হয় ক্ষমতার এই তন্তুজাল থেকে যেন কারও মুক্তি নেই। আপনি আন্তোনিয়ো গ্রামশি চর্চা করে আসছেন অনেক দিন ধরে। এই ‘উত্তর-রাজনৈতিক’ খণ্ড-রাজনীতির বাইরে গিয়ে কোনও সামগ্রিক, সমন্বয়-সাধক রাজনীতি কি সম্ভব?

উ: সমন্বয়-সাধনের রাজনীতি গ্রামশির হেজিমনি-র ধারণার কাছাকাছি। ফুকো এটা মানেন না। ইউরোপের জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রের যে-পর্যায়ে ফুকো লিখছিলেন, তাতে উনি ভাবার চেষ্টা করছিলেন, এমন অবস্থা এল কী করে যাতে হেজিমনির রাজনীতি আর সম্ভব হচ্ছে না। কিন্তু এটা ভারতের ক্ষেত্রে পুরোটা প্রযোজ্য নয়। কারণ ভারত কখনওই সামগ্রিক জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্রে পরিণত হয়নি। অথচ সেখানেও প্রশাসনিকতা এসেছে। মানুষের একটা বিশাল অংশ এখানে রাষ্ট্রব্যবস্থার সংলগ্ন ছিল না। তাদের ওই ব্যবস্থার ভিতরে টেনে আনতে গেলে, এত মানুষকে শাসন করতে গেলে, খণ্ড খণ্ড রাজনীতির টেকনিক বা প্রশাসনিকতা কাজে লাগে। কাজেই সামগ্রিক রাজনীতি নয়, পপুলিজ়মই এখানে একমাত্র সম্ভাব্য রাজনীতি। কিন্তু যে-কথা বলছিলাম— সমাজ পরিবর্তনের কোনও সামগ্রিক কল্পনা এখানে নেই। অথচ, এক রকম হেজিমনির রাজনীতি কিন্তু এই অবস্থাতেও আছে— সেটা হল হিন্দুত্ববাদ। হিন্দুত্ববাদের একটা দিক মোদী বা বিজেপি ইত্যাদিকে দিয়ে চিনতে পারি; সেটা নির্বাচন-কেন্দ্রিক। কিন্তু নির্বাচন হোক বা না হোক, এদের অন্য একটা সামগ্রিক প্রকল্প আছে। সেটা দীর্ঘমেয়াদি, সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন সংস্কৃতির মধ্যে ঢুকে আছে। আরএসএস-এর মতো সংগঠনের কর্মীরা এক একটা অঞ্চলে গিয়ে দিনের পর দিন থাকে, সাধারণ মানুষের মধ্যে কাজ করে। হিন্দুত্বের ভিত্তিতে জাতি-রাষ্ট্রের একটা আদর্শ মানুষের মধ্যে চারিয়ে দেওয়া এদের কাজ। এটা হেজিমনিক অবস্থান। সমস্যা হচ্ছে, অন্য সব রাজনীতি, এমনকি বামপন্থী রাজনীতিও, নির্বাচন-কেন্দ্রিক হয়ে গিয়েছে, এবং সেখানে পপুলিস্ট রাজনীতিই প্রধান। অতএব যদি জিগ্যেস করো, আজ ভারতে হেজিমনিক প্রকল্প আছে কি? আমি বলব, ওই একটাই আছে: হিন্দুত্ববাদ। কাজেই সেই কথাটায় ফিরে যাই, নির্বাচনী কৌশল করে কিন্তু হিন্দুত্ববাদের দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব নয়। কারণ কাল যদি বিজেপি ক্ষমতায় না-ও থাকে, হিন্দুত্ববাদী প্রকল্প থেমে থাকবে না। এখন, ফেডারাল জাতি-রাষ্ট্রের ধারণা, পিপল-এর মধ্যে ফেডারাল ধারণা— এটা কিন্তু হিন্দুত্ববাদ মেনে নিতে পারবে না। সুতরাং এটা তার বিকল্প হতে পারে।

ইতিহাসবিদ, সেন্টার ফর স্টাডিজ় ইন সোশ্যাল সায়েন্সেস, কলকাতা-র প্রাক্তন অধিকর্তা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক

সাক্ষাৎকার: মৈনাক বিশ্বাস

(শেষ)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE