জিমন্যাস্ট প্রণতি নায়েক। ছবি: সংগৃহীত।
সাধারণ সময়েই যে জগৎ উপেক্ষিত, অতিমারির আবহে তাহা যে বাতিলের খাতায় ঠাঁই পাইবে, ইহা অনুমান করা চলে। এ-ক্ষণে বাংলার তিরন্দাজ, কুস্তিগির, সাঁতারু, ভারোত্তোলক, মুষ্টিযোদ্ধা— সকলের ভাগ্যাকাশেই মেঘ জমিয়াছে। কাহারও অনুশীলন করিবার স্থান সঙ্কুলান, কাহারও অর্থাভাবে মহড়াই বন্ধ। পিংলার গ্রামে আটকাইয়া পড়িবার পর দুইটি গাছের মাথায় বাঁশ বাঁধিয়া কোনও মতে প্রশিক্ষণ চালু রাখিয়াছেন বর্তমান ভারতের অন্যতম সেরা জিমন্যাস্ট প্রণতি নায়েক। কোনও ক্রীড়াকর্তা প্রণতি বা অপরাপর খেলোয়াড়দের খোঁজ করেন নাই বলিয়াই অভিযোগ। সহায়তা করিবার কথা বোধ করি ভাবিয়াও দেখেন নাই। অভিযোগ উঠিতেছে যে রাজ্য জিমন্যাস্টিক্স সংস্থা আপাতত কোভিড-১৯’কে ঢাল বানাইতে ব্যস্ত। অনুশীলন কেন্দ্রের অনুমতি কিংবা সরঞ্জাম কিনিবার অনুদান না পাইলে তাহারা কিছু করিতে অপারগ বলিয়া জানা গিয়াছে। যদিও বাস্তব বলিবে যে ইহাই ‘ঐতিহ্য’— এই দেশে, এই রাজ্যে ক্রীড়াক্ষেত্র এই ভাবেই চলে।
বহু কাল যাবৎ ভারতীয় ক্রীড়া কালান্তক লালফিতার ফাঁসে জড়াইয়া আছে। তাহার চলিবার ভঙ্গিটি গয়ংগচ্ছ, দীর্ঘসূত্রতা নিয়মে পর্যবসিত। স্মরণে আসিতে পারে, অলিম্পিক্সের মঞ্চে দীপা কর্মকার যে প্রোদুনোভা ভল্ট দিয়া জগৎসভায় ভারতের নাম উজ্জ্বল করিয়াছিলেন, তাহা অনুশীলন করিবার জন্য বাড়ির স্কুটারের সিট ছিল তাঁহার সম্বল। ভারতের জাতীয় ক্রীড়া হকি, অথচ যত দিন না অ্যাস্ট্রোটার্ফ বাধ্যতামূলক করা হইতেছিল, তত দিন অবধি এক কালের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা ঘাসের মাঠেই খেলিয়া যাইতেন। অর্থাৎ, বিপুল ত্যাগস্বীকার করিতে না শিখিলে ভারতে খেলোয়াড় হিসাবে উন্নতি করা সহজ নহে। অতিমারির কালে তাহা আরও স্পষ্ট হইল। যে সময়ে খেলোয়াড়দের অধিক সাহায্যের প্রয়োজন, সেই সময় তাঁহারা ন্যূনতম সহায়তাটুকুও পাইতেছেন না। ক্রীড়াক্ষেত্রে লালফিতার ফাঁস এই ভাবেই বাধাবিপত্তিকে ক্রমশ আরও ‘স্বাভাবিক’ করিয়া তুলিতেছে। কোনও খেলোয়াড় তাঁহার সমস্যা লইয়া নালিশ জানাইয়াছেন এবং তৎক্ষণাৎ তাহার সুরাহা হইয়াছে, এমন ঘটনা পরিচিত নহে।
অর্থাভাব, অপ্রতুল পরিকাঠামো এবং নিম্নমানের প্রশিক্ষণ সরঞ্জামের মূলে আছে বিবিধ ক্রীড়ার প্রতি সামািজক দৃষ্টিভঙ্গি। ভারতীয় সমাজ ক্রিকেট ব্যতীত অপর কোনও খেলাকে গুরুত্ব দেয় না। ক্রিকেট ব্যতীত অপরাপর খেলায় যথেষ্ট বাণিজ্য হয় না, অধিকাংশই সরকারি অনুদানে পুষ্ট। আলাদা করিয়া কদর করিবার কেহ নাই। প্রচার নাই, অতএব দর্শকও বিরাট কোহালির কেশকর্তন লইয়া যতখানি উত্তেজনা প্রকাশ করে, বহু অ্যাথলিটের অলিম্পিক্স-স্বপ্নের জলাঞ্জলি লইয়া তাহার সিকি ভাগ উদ্বেগও দেখায় না। কোনও জিমন্যাস্ট বৃহৎ মঞ্চে সাফল্য লাভ করিলেও তাহা লইয়া জনতার ভিতর আলোড়ন উঠে না। বস্তুত, ওই সাফল্য পরিমাপ করিবার ইচ্ছা বা ক্ষমতা আমাদের জন্মায় নাই। খেলাগুলি সরকারের নিকট গুরুত্বহীন, ফলে সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলিও খেলোয়াড়দের স্বার্থরক্ষার তুলনায় অন্যান্য দিকে বেশি আগ্রহী হইয়া উঠে। বরং ক্রিকেট স্টেডিয়াম ব্যতীত অপর কোনও খেলার মাঠে কেবল অবহেলাই জুটিবে, ভারতীয় জনতার নিকটও ইহা স্বতঃসিদ্ধ। বিধিলিপির ন্যায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy