চিনের মহাদুর্ভিক্ষের সহিত পশ্চিমবঙ্গে ডেঙ্গি মহামারির সাদৃশ্য কী? দুই বিপর্যয়েরই অন্যতম কারণ, ভ্রান্ত তথ্য। ছয় দশক পূর্বে চিনে খাদ্যের অভাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ মরিতেছিল, বেজিংয়ে রিপোর্ট প্রেরিত হইতেছিল, শস্য উদ্বৃত্ত। মাওয়ের ‘মহতী অগ্রগতি’ নীতির নির্দেশ মানিয়া কৃষির সর্বনাশ হইয়াছে, তাহা বলিবার সাহস কাহারও হয় নাই। পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্ট দল আর ক্ষমতায় নাই, কিন্তু বর্তমান শাসকদের আচরণেও সত্যের প্রতি অসহিষ্ণুতা প্রকট। কলিকাতার সকল ওয়ার্ড হইতে গত কয়েক মাস ক্রমাগত খবর আসিয়াছে, মশা নাই, মশার কীট নাই, মশার দংশন জনিত রোগও নাই। এমন রিপোর্ট পাইয়া স্বাস্থ্য দফতরের কর্তারা সম্ভবত ডেঙ্গিকে বিদায় সংবর্ধনা জানাইবার তোড়জোড় করিতেছিলেন। কিন্তু হায়, বর্ষা না আসিতেই কামারহাটি পুরসভায় উনিশ জন ডেঙ্গিতে আক্রান্ত, পানিহাটি পুরসভায় বারো জন। পুরসভার সমীক্ষক দল যে সকল স্থানকে নিরাপদ দেখাইয়াছে, স্বাস্থ্য দফতরের বিশেষজ্ঞরা সেখানে ডেঙ্গির মশার কীট পাইতেছেন। চিনা গ্রামে যে ভাবে খাদ্য ‘উদ্বৃত্ত’ হইয়াছিল, পশ্চিমবঙ্গের জেলায় কি সেই ভাবেই মশা ‘নিশ্চিহ্ন’ হইতেছে?
সরকার বাস্তবকে বর্জন করিয়া কল্পিত বয়ান গ্রহণ করিলে মানুষের বিপন্নতা চরমে পৌঁছাইতে পারে। গত বৎসরই ডেঙ্গি প্রায় মহামারির আকার ধারণ করিয়াছিল, সরকারি তথ্যেই শেষ অবধি ছত্রিশ হাজার সংক্রমণের স্বীকারোক্তি মিলিয়াছে। অথচ ডেঙ্গি সংক্রমণ যখন তুঙ্গে, তখন তাহাকে অস্বীকার করিবার প্রবণতা দেখা গিয়াছিল সরকারি তরফে। সরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গি বুঝিয়াও চিকিৎসকেরা ‘অজানা জ্বর’ লিখিতে বাধ্য হন বলিয়া অভিযোগ উঠিয়াছিল। রক্ত পরীক্ষার রিপোর্টেও ‘ডেঙ্গি’ কথাটি না লিখিবার প্রবণতা দেখা দিয়াছে। এমনকি কেন্দ্রীয় সরকারের কাছে গত বৎসরের ডেঙ্গি সংক্রমণের পরিসংখ্যানও পাঠায় নাই। সত্যকে অস্বীকার করিবার এই ঝোঁকের ফলে গত বৎসর ডেঙ্গি মোকাবিলার নির্দেশিকা চিকিৎসকদের নিকট পৌঁছায় নাই। জ্বর কমিলেই রোগীদের ছাড়িয়া দেওয়া হইয়াছে, তাহাতে বিপদ বাড়িয়াছে। ডেঙ্গির জন্য কত মৃত্যু হইয়াছে, তাহার প্রকৃত পরিসংখ্যান মেলে নাই, হয়তো কখনওই তাহা আর মিলিবে না। প্রবল সমালোচনার মুখে পড়িয়াই রাজ্য সরকার ডেঙ্গি প্রতিরোধের কার্যক্রম গ্রহণ করে। যাহার প্রধান অঙ্গ, মশা প্রতিরোধে সংবৎসর নিয়মিত সমীক্ষা।
কিন্তু এই কার্যক্রমও যে মুখোশনৃত্য, রোগবাহী পতঙ্গের সহিত প্রকৃত যুদ্ধ নয়, তাহার ইঙ্গিত গোড়াতেই মিলিয়াছিল। যথেষ্ট পতঙ্গবিদ নাই, কর্মীদের যথেষ্ট প্রশিক্ষণ নাই, তাহাদের কাজের উপর যথেষ্ট নজরদারি নাই। সমস্যা চিহ্নিত হইলেও তাহার নিরসনের উপায় নাই স্থানীয় পুরকর্তা বা আধিকারিকদের। নিকাশি খাল বন্ধ, জঞ্জাল অপসারণের ব্যবস্থা নাই, উন্মুক্ত নর্দমা, সর্বত্র প্লাস্টিক ও থার্মোকল। রাজ্য সরকার কঠোর নীতি প্রণয়ন না করিলে এবং যথেষ্ট অর্থ বরাদ্দ না করিলে ইহার কোনওটির প্রতিকার সম্ভব নহে। তৎসত্ত্বেও স্থানীয় তৎপরতায় মশা নিয়ন্ত্রণের কাজ কতক হইতে পারিত, যদি যথাযথ সমীক্ষা হইত। তাহা হয় নাই। সত্য বলিয়া কোপে পড়িবে কে? সমীক্ষক চাকরি বাঁচাইয়াছেন। মানুষের প্রাণ বাঁচিবে কি না, বুঝিবে সরকার।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy