Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
প্রবন্ধ ২

অন্তত মেয়েগুলোর পাশে থাকাটা শিখি

ধর্ষণের মামলা কোনও ভাবে ‘মিটমাট’ করে নেওয়া যাবে না, বলেছে সর্বোচ্চ আদালত। ঠিক কথা। কিন্তু অন্য কিছু প্রশ্ন তবু থেকেই গেল।সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ধর্ষণ মামলায় সালিশি করা যাবে না, ধর্ষক বিয়ের প্রস্তাব বা টাকা দিয়ে মিটিয়ে নেবে বলে আবেদন করলে নিম্ন আদালত যেন সাড়া না দেয়। মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের এক রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই রায়।

শাশ্বতী ঘোষ
শেষ আপডেট: ০৯ জুলাই ২০১৫ ০০:০০
Share: Save:

সুপ্রিম কোর্ট বলেছে, ধর্ষণ মামলায় সালিশি করা যাবে না, ধর্ষক বিয়ের প্রস্তাব বা টাকা দিয়ে মিটিয়ে নেবে বলে আবেদন করলে নিম্ন আদালত যেন সাড়া না দেয়। মধ্যপ্রদেশ হাইকোর্টের এক রায়ের বিরুদ্ধে রাজ্য সরকারের আবেদনের প্রেক্ষিতে এই রায়। হাইকোর্ট এক সাত বছরের মেয়েকে ধর্ষণের অভিযোগ থেকে এক ব্যক্তিকে রেহাই দিলেও শ্লীলতাহানির অভিযোগটি রেখেছিল। অভিযুক্ত এ অবধি যেটুকু কারাবাস করেছে, তা-ই যথেষ্ট— এই বলে নিম্ন আদালতের ধর্ষণের শাস্তির রায়কে উল্টে দিয়েছিল, সুপ্রিম কোর্ট তাকে আবার গ্রেফতার করে পুরো সময় সাজা খাটতে হবে বলেছে। এই রায় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন নিম্নতর আদালত, এমনকী হাইকোর্টগুলির ধর্ষণের মামলাকে লঘু করে দেওয়ার প্রবণতার বিরুদ্ধে কঠোর মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি দীপক মিশ্রের নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ। এ মন্তব্য অতি সম্প্রতি মাদ্রাজ হাইকোর্টের রায়ের প্রেক্ষিতেও গুরুত্বপূর্ণ, বিচারপতি পি দেবদাস যেখানে ধর্ষণের মামলাটিকে হাইকোর্টের ‘নিজস্ব সালিশির ক্ষেত্র’-এ পাঠিয়ে দেন এবং অভিযুক্তকে জামিন দিয়ে দেন, যাতে সে সেই প্রক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে।

মাদ্রাজ হাইকোর্টের রায়টি অনেক উত্তাপ ও বেশ কিছু প্রশ্ন তুলেছে, যা এই রায়টির প্রসঙ্গেও আসবে। কুড্ডালোরের এই চতুর্দশীটিকে ২০০৮ সালে ধর্ষণ করায় সে মেয়ে গর্ভবতী হয়ে পড়লে মেয়েটির পরিবার বিয়ের জন্য বলে, কারণ এই মেয়ে এবং অভিযুক্ত ভি মোহন এক গ্রামের, একই জাতের। ছেলের পরিবার অস্বীকার করলে মেয়েটির পরিবার ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের করে, ছেলেটির সাত বছরের সাজা হয়। ২২ বছরের মেয়েটি দ্বিতীয় শ্রেণিতে পাঠরত সাত বছরের মেয়েকে নিয়ে মায়ের সঙ্গে থাকে আর তিরুপুরের এক কাপড়কলে কাজ করে খরচ চালায়। আমাদের দণ্ড সংহিতা সংশোধন করে ২০০৫ সালে ২১এ (XXI-A) ধারা সংযোজন হয়, সেটি ২০০৬ সালের জুলাই মাস থেকে কার্যকর হয়, যেখানে বলা হয়, ক্ষেত্রবিশেষে মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য সালিশি সম্ভব। এই ব্যবস্থায় কেউ অপরাধ স্বীকার করে নিলে শাস্তি কম হয়ে যাবে (plea bargaining)। তবে এমন কোনও মামলা এই বিকল্প বিচার প্রক্রিয়ায় আসতে পারবে না, যেখানে প্রাণদণ্ড, যাবজ্জীবন এমনকী সাত বছরের বেশি কারাবাসের শাস্তি হতে পারে। আমেরিকায় সব ধরনের অপরাধের ক্ষেত্রেই এ ব্যবস্থা প্রযোজ্য, এ দেশে আর্থ-সামাজিক অপরাধ আর নারী ও শিশুর বিরুদ্ধে অপরাধকে এর আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। তাই এ মামলা সালিশিতে পাঠানোর নির্দেশের বিরুদ্ধে সরব হয়ে মাদ্রাজ হাইকোর্টের কিছু আইনজীবী ও অল্টারনেটিভ ডিসপিউট রেজলিউশন কেন্দ্রের কাউন্সেলরা মাদ্রাজ হাইকোর্টের মুখ্য বিচারপতির কাছে রায় পুনর্বিবেচনা আর কোন কোন ধরনের মামলা বিকল্প বিতর্ক নিরসন কেন্দ্রে আসতে পারে, তার জন্য বিশদ নির্দেশিকা দিতে আবেদন জানিয়েছেন।

মন্দির?

ধর্ষণ মামলা সালিশিতে সমাধান করা যাবে না বা ক্ষতিপূরণ বা বিয়ে, কোনও কিছুর বিনিময়ে মিটিয়ে নিতে দেওয়া যাবে না— এই রায়ের যুক্তি হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি দীপক মিশ্র ও পি সি পন্থ বলেছেন, একটি মেয়ের সম্মানই সবচেয়ে বড় সম্পদ, সেই সম্পদে কেউ কাদা লেপলে সালিশি সম্ভব নয়। সমস্যা হল, এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্ট বলেছে: ‘এই অপরাধ হল মেয়েটির শরীরের বিরুদ্ধে, যা তার মন্দির’। প্রশ্ন ওঠে, তা হলে কোনও পুরুষের শরীর তার মন্দির নয়? পুরুষরা শুধুই পূজাির মেয়েরা তো মন্দির হিসেবে পূজা চান না, তাঁরা চান তাঁদের অধিকারের স্বীকৃতি: ‘না’ বললে না-টাকে মানতে হবে। এই রায়ে সেই অধিকারের স্বীকৃতি কোথায়? অধিকারের ভাষায় বরং কথা বলেছিল ২০১৩ অগস্টে শিম্ভু ও অন্যান্য বনাম হরিয়ানা সরকারের মামলায় তৎকালীন মুখ্য বিচারপতি পি সতাশিবমের রায়। তিনি বলেছিলেন, বিয়ে করে নিলেও তা সাজা কমানোর ভিত্তি হতে পারে না, কারণ এটি কোনও ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, সমাজের বিরুদ্ধে অপরাধ। তাই ধর্ষণে অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে নরম মনোভাব নিলে তা শুধু ধর্ষিতা নয়, হবে সমাজের প্রতিও চূড়ান্ত অসংবেদনশীলতা। আরও বলেছিলেন, মিটমাটের অনুমতিতে সাজা কমে গেলে সব সময় অভিযুক্ত মিটমাটের জন্য সব রকম চাপ দেবে। অনেক দিন ধরে মামলা চলেছে, ধর্ষিতা জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে— এ সব সাজা কমানোর কারণ হতে পারে না। যেমন ধর্ম, জাত বা অভিযুক্তের সামাজিক অবস্থান, এ রকম কোনও কারণই শাস্তিদানের ক্ষেত্রে বিচার্য হবে না।

২০১৪ জুলাইয়ে একই ধরনের রায় দিলেন বিচারপতি রঞ্জনা দেশাই আর এন ভি রমনের এক ডিভিশন বেঞ্চ। পণের জন্য বধূ নিগ্রহ (৪৯৮এ) আর ধর্ষণ (৩৭৬), দু’টি ধারাই আদালতের বাইরে মিটমাট করা যায় না, এই নির্দেশ থাকলেও দু’টি ধারাকে এক ভাবে দেখা যায় না। বধূ নিগ্রহের ঘটনায় ক্ষেত্রবিশেষে মিটমাটের অবকাশ থাকলেও থাকতে পারে। কিন্তু খুন বা ধর্ষণের মতো অপরাধ, যার প্রতিক্রিয়া সমাজের ওপরেই পড়বে, সে সমস্ত ক্ষেত্রে কোনও ভাবেই মিটমাটের কথা ভাবা উচিত নয়। গত দু’বছরেই অন্তত তিন বার সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন মামলায় জোর দিয়ে মিটমাট-সালিশি, বিকল্প সমাধানের পথে হাঁটতে নিষেধ করেছে। তথ্য ঘাঁটলে হয়তো দেখা যাবে, আরও বহু বার বলেছে। তার পরেও নানা নিম্ন আদালত বা বিভিন্ন রাজ্যের উচ্চ ন্যায়ালয় বিয়ের বা ক্ষতিপূরণের নিদানে সাজা কমিয়ে দিচ্ছে, মামলা খারিজ করে দিচ্ছে, জামিন দিয়ে দিচ্ছে। তা হলে আমরা পাড়ার দাদা, পার্টি অফিস, মাঝি হাড়াম, গ্রাম পঞ্চায়েত, পুলিশ, দারুল-উলুম বা খাপ পঞ্চায়েতদের দোষ দেব কেন? বরং সুপ্রিম কোর্ট রাজ্যে রাজ্যে আদালতবন্ধু নিয়োগ করুক, যারা দেখবে, যে মেয়েগুলির এ ভাবে বিয়ে হল, তারা মরল না বাঁচল? আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এর পর অত্যাচার আরও বাড়ে, যে সম্পর্কের ভিত্তিতেই আছে ঘৃণা আর আক্রমণ, তা সুখের হয় না।

আর গতি কী

আমাদের আইনি ব্যবস্থায় আদালতের দরজা পর্যন্ত পৌঁছতে পারেন ক’জন? অভিযোগ জানানোয় নিরুৎসাহ করতে পুলিশ এমনকী সরকারি ডাক্তাররাও যেখানে নিরক্ষর মায়েদের বলেন যে, নিগৃহীতা মেয়ের ডাক্তারি পরীক্ষা করতে গেলে তার প্রাণসংশয় হতে পারে, পরিবারের হাতে সালিশি ছাড়া সেখানে আর গতি কী? বহু ক্ষেত্রে সালিশি ব্যর্থ হলে তবেই মেয়েরা থানা-পুলিশ করার কথা ভাবেন। তাঁদের জীবনে সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের কী অর্থ রয়েছে? কিন্তু অর্থ তৈরির দায় কি বিচারব্যবস্থার নেই? ২০১৪ ডিসেম্বরে উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জের যে ধর্ষিতা স্কুলছাত্রী অভিযুক্তের শাস্তি চেয়েছিল, গ্রামের সালিশিতে ৯০,০০০ টাকার পরিবর্তে মামলা তুলে নেওয়ার ব্যবস্থা সে মেনে নিতে পারেনি, কিন্তু দারিদ্রের জন্য প্রতিবাদ করতেও পারেনি। শেষে গত মে মাসে সাক্ষ্য দিয়ে অভিযুক্ত ও তার পরিবারের হেনস্থায় বাড়ি ফিরে নিজের দুপাট্টা দিয়ে গলায় দড়ি দেয়। বিচারব্যবস্থা-প্রশাসন কী ভাবে তাদের পাশে থাকবে? সুপ্রিম কোর্ট কী ভাবে তাদের জোর গলায় সালিশিতে ‘না’ বলতে শেখাবে? আমরা কী ভাবে তাদের পাশে থাকব?

নিগ্রহ থামাতে পারছি না, অন্তত মেয়েগুলির পাশে থাকাটা শিখি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE