Advertisement
২০ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

সিন্ডিকেট অনৈতিক, অহেতুক নয়

একটা লম্বা লাইন, ডক শ্রমিকদের। লাইনের শেষে একটা ছোট টুলের ওপর রাখা টিনে মজুরির থেকে দু’টাকা দিয়ে যাচ্ছে ডক শ্রমিকরা। তোলাবাজির এই দৃশ্য ‘দিওয়ার’ ছবির। সেই ছবিতে এর কিছু পরেই এক রাগী যুবকের আবির্ভাব ঘটবে, যিনি শাসন করবেন সত্তর দশকের বলিউড মানচিত্র।

অনির্বাণ মুখোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ২৩ অগস্ট ২০১৬ ০০:০০
Share: Save:

একটা লম্বা লাইন, ডক শ্রমিকদের। লাইনের শেষে একটা ছোট টুলের ওপর রাখা টিনে মজুরির থেকে দু’টাকা দিয়ে যাচ্ছে ডক শ্রমিকরা। তোলাবাজির এই দৃশ্য ‘দিওয়ার’ ছবির। সেই ছবিতে এর কিছু পরেই এক রাগী যুবকের আবির্ভাব ঘটবে, যিনি শাসন করবেন সত্তর দশকের বলিউড মানচিত্র। সত্তরের দশকের ছবিতে ছড়ানো ছিটনো রয়েছে কোনও না কোনও না ভাবে তোলাবাজি এবং তার সক্রিয় প্রতিরোধের গল্প, ‘শোলে’ও তার ব্যতিক্রম নয়। খেয়াল করলে দেখা যাবে, বলিউডে তোলাবাজি মানেই ভাল বা খারাপ নয়। যে তোলাবাজ গরিবের টাকা লুটে বড়লোক হয় (যেমন ‘দিওয়ার’) সে খারাপ, কিন্তু যে বড়লোককে লুটে গরিবকে টাকা দেয় (যেমন ’ভেলু নায়কন’) সে ভাল।

তোলাবাজি সম্পর্কে সমাজের একটা সরলীকৃত ভাষ্য আছে, কিন্তু একটু নাড়াচাড়াতেই সে ভাষ্যেরও নিটোলতায় ভাঁজ পড়ে, ফাঁক দিয়ে নানান দ্বন্দ্ব, আর জটিলতা বেরিয়ে আসে। কোন সমাজ তোলাবাজিকে কী ভাবে দেখবে, তা অনেকাংশে সেই সমাজ সম্পত্তির অধিকার এবং সেই অধিকার রক্ষার্থে রাষ্ট্রের ভূমিকাকে কী ভাবে দেখে, তার ওপর নির্ভর করে। সাধারণ ভাবে তোলাবাজি তুলে দিতে না পারার যে ব্যর্থতা, তা শুধু রাজনৈতিক নেতাদের কায়েমি স্বার্থের কারণেই নয়, সম্পত্তির অধিকারের প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং রাষ্ট্র ও নাগরিকের সম্পর্কও এ ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ।

সিন্ডিকেট আর ডেভিড রিকার্ডো

অর্থনীতির তত্ত্বের ইতিহাসে ডেভিড রিকার্ডোর অবদান বহুধাব্যাপ্ত। রেন্ট বা খাজনা সম্পর্কিত তত্ত্বের প্রাথমিক আলোচনাও তাঁর অবদান। এর মোদ্দা কথাটা সরল: জমির জোগান সীমিত, সেটাই খাজনার উৎস, জমির জোগান সীমাহীন হলে জমির মালিক খাজনা পেতেন না। ডেভিড রিকার্ডো খাজনাকে জমির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভেবেছেন। কিন্তু আসলে তো খাজনা আসে জমির উর্বরতা এবং তার জোগানের সীমাবদ্ধতা থেকে। সুতরাং যে কোনও পণ্যের জোগানের সীমাবদ্ধতাজনিত যে আয়, তা চরিত্রে খাজনাই— অর্থনীতিতে তার নাম অর্থনৈতিক খাজনা। একচেটিয়া পুঁজির মুনাফা থেকে পেটেন্টের রয়্যালটি— সবই অর্থনৈতিক খাজনার উদাহরণ। জোগানের সীমাবদ্ধতা কখনও প্রাকৃতিক কারণে (যেমন জমি), কখনও সরকারি ফরমানের কারণে (যেমন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি), কখনও বা সুরক্ষিত মেধাস্বত্বের কারণে (যেমন মাইক্রোসফট)।

তোলার ধান ভানতে গিয়ে খাজনার গীত গাওয়ার একটাই কারণ— তোলাবাজির অর্থনীতি বুঝতে গেলে খাজনার অর্থনীতি বোঝা দরকার। একটু ভেবে দেখলেই বুঝতে পারি, তোলা-র নৈতিক বা আইনি সংজ্ঞা যা-ই হোক না কেন, তোলা বস্তুটি আসলে খাজনারই রকমফের। এবং এটাও মনে রাখা দরকার যে, খাজনার নৈতিকতা বলতে সচরাচর যা বোঝায়, সেটা খাজনা কে নিচ্ছে তার ওপর নির্ভরশীল। অত্যাচারী জমিদারের নেওয়া খাজনা অনৈতিক, মধ্যবিত্ত বাড়িওয়ালার নেওয়া বাড়িভাড়া নৈতিক। কিন্তু নীতির হিসেব সব সময় এত সরল নয়। গাড়ি-চড়া মাফিয়া আর রবিনহুডের তফাত কী, বা আদৌ কোনও তফাত আছে কি না, এই ধরনের প্রশ্নের বিচার করতে গেলে তাই খাজনার চরিত্র বোঝা প্রয়োজন।

সিন্ডিকেট আর প্রায়-রাষ্ট্র

সংবাদমাধ্যমে আজকাল তোলাবাজি কথাটা নানা ধরনের ঘটনাকে বোঝাতে ব্যবহার করা হয়, যদিও মোটের ওপর সেই সব ঘটনার অন্তর্নিহিত সূত্র একই। তোলাবাজির সবচেয়ে প্রচলিত উদাহরণ হল সুরক্ষা-মূল্য (প্রোটেকশন মানি)। আবার সিনেমার উদাহরণে ফিরি। হলিউডের ‘গডফাদার’ থেকে বলিউডের ‘সত্য’— মাফিয়াদের মূল যে কাজ সিনেমায় দেখানো হয়, তা আসলে সুরক্ষা-মূল্য উপার্জন। কিন্তু তোলা যদি হয় খাজনার প্রকারভেদ আর খাজনা যদি আসে কোনও পণ্যের জোগানের সীমাবদ্ধতা থেকে তা হলে সুরক্ষা-মূল্যের ক্ষেত্রে ‘পণ্য’টি কী? এখানে পণ্যটি হল প্রতিশ্রুতি— ক্ষতি না করার প্রতিশ্রুতি, যাকে অন্য ভাবে সুরক্ষা বা নিরাপত্তা দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও বলা যায়।

এখানে জোগানের সীমাবদ্ধতার ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। লক্ষণীয়, মাফিয়ারা সাধারণত একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে এবং সেই নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার জন্য রক্ত ঝরাতে পিছপা হয় না। এটা আসলে ওই এলাকায় সুরক্ষার জোগান সীমাবদ্ধ রাখার উপায়। কোনও এলাকায় অনেক মাফিয়া ঢুকে পড়লে কেউই খুব বেশি তোলা পাবে না— আমি যদি জানি খ বা গ মাফিয়া আমাকে মেরে দিতে পারে, তা হলে ক মাফিয়া-র দেওয়া সুরক্ষার বাজারদর কমে যাবে। এই সুরক্ষা-দেওয়া মাফিয়াদের সরাসরি সংঘাত রাষ্ট্রের সঙ্গে। কারণ আইনত সুরক্ষা প্রদান একমাত্র রাষ্ট্রের কাজ। বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে সুরক্ষা দেওয়ার কাজ একচেটিয়া ভাবে রাষ্ট্রই করে থাকে। তবে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার পরিষেবা দেওয়ায় অ-রাষ্ট্রীয় ব্যক্তি বা সংস্থা অনেক ক্ষেত্রেই রাষ্ট্রের পরিপূরক হিসেবে কাজ করে। ফলে সুরক্ষার একটা বাজার তৈরি হয়। কখনও সেটা আইনসম্মত (যেমন সরকার অনুমোদিত নানা সিকিয়োরিটি এজেন্সি), কখনও নয় (যেমন মাফিয়া)।

রাষ্ট্রের অনুমোদন ছাড়াই রাষ্ট্রের (সুরক্ষা জোগান দেওয়ার) ভূমিকা শুধু সাধারণ মাফিয়ারাই পালন করে না। এটা অনুন্নত অর্থনীতির দেশগুলির এক সাধারণ বৈশিষ্ট্য। এই ধরনের প্রতিষ্ঠানকে নাম দেওয়া যায় ‘প্রায়-রাষ্ট্র’ (quasi state)। প্রায়-রাষ্ট্রের অন্য দৃষ্টান্ত একটু পরে। তার আগে তোলাবাজির অন্য সুপরিচিত উদাহরণটিতে আসি।

সিন্ডিকেট শব্দটি এখন বহুল-আলোচিত, বিশেষত নির্মাণ শিল্পের প্রসঙ্গে। সিন্ডিকেট প্রধানত জমি-বাড়ির প্রোমোটারদের বাধ্য করে তাদের কাছে বাজারের চেয়ে বেশি দামে বাড়ি তৈরির মালমশলা কিনতে। এখন, এই যে অন্য কোনও দোকান থেকে কিনতে বাধা দেওয়া, তা আসলে কাঁচামালের জোগান সীমাবদ্ধ রেখে দেওয়ার নামান্তর। সুতরাং সিন্ডিকেটও আসলে অর্থনৈতিক খাজনাই আদায় করে। কিন্তু সুরক্ষা-মূল্য উপার্জনকারী মাফিয়া আর সিন্ডিকেটের খাজনা তৈরি করার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। মাফিয়ারা নিজেদের মধ্যে এলাকা ভাগ করে নিয়ে জোগানের অভাব তৈরি করে, সিন্ডিকেট সেটা তৈরি করে বাজারে থেকে কেনার সুযোগ সংকুচিত করে দিয়ে। শ্রমের বাজারেও এই ধরনের সিন্ডিকেট কাজ করে। কারখানায় স্থানীয় ছেলেদের কাজ দিতে হবে আর বাড়ি বানানোর মালমশলা স্থানীয় দোকান থেকে কিনতে হবে, এ দুটো দাবির মূলগত কোনও পার্থক্য নেই। সেই কারণে কিছু দিন আগে একটা সংবাদপত্রে দেখলাম এই রকম চাকরির দাবি জানানো যুবকদের সিন্ডিকেট বলেই উল্লেখ করেছে। পরিভাষাটি তাৎপর্যপূর্ণ।

খেয়াল করা যাক, সিন্ডিকেট আসলে কী করছে। কারখানা তৈরি বা বাড়ি বানানোর ফলে যে আয় তৈরি হচ্ছে তার একটা অংশ স্থানীয় ভাবে রেখে দিচ্ছে। এবং সেটা তারা করছে বাজারকে সঙ্কুচিত করে। এই যে বাজারকে সঙ্কুচিত করে (এবং উৎপাদন ব্যয় বাড়িয়ে) উৎপাদনজনিত আয়কে একটি ভৌগোলিক এলাকার মধ্যে আটকে রাখা— এই কাজটিও সাধারণ ভাবে রাষ্ট্র করে থাকে আমদানি নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে। রাষ্ট্র যখন সস্তার কাঁচামাল বিদেশ থেকে আনতে না দিয়ে দেশ থেকে কিনতে বলে, তখনও কিন্তু সে বাজারের গতিকে নিয়ন্ত্রণ করে।

রাষ্ট্র বনাম প্রায়-রাষ্ট্র

শুধু সিন্ডিকেট নয়, চার পাশে এ রকম অনেক প্রায়-রাষ্ট্র ছড়িয়ে আছে। অটো ইউনিয়ন থেকে শুরু করে চণ্ডীমণ্ডপের সালিশি সভা বা খাপ পঞ্চায়েত, এরা সবাই প্রায়-রাষ্ট্রের উদাহরণ। প্রায়-রাষ্ট্র রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয়, কিন্তু রাষ্ট্র আবার তার সঙ্গে এক ধরনের সম্পর্কে জড়িয়ে থাকে। সিন্ডিকেটের সমস্যা নিছক আইনশৃঙ্খলার সমস্যা নয়, শুধুই কায়েমি স্বার্থ নয়। সিন্ডিকেট বা সিন্ডিকেটের মতো নানা প্রায়-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান এক ভাবে আয়ের পুনর্বণ্টন করে, যে কারণে এর পেছনে ভোটারদের একটা বড় অংশের নৈতিক সমর্থন আছে। ঠিক একই কারণে বাম ডান কারও পক্ষেই প্রায়-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানের উচ্ছেদ সম্ভব নয়। সব প্রায়-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানের যে একই রকম ভাবে অবলুপ্তি হবে তাও বলা যায় না। কিন্তু সিন্ডিকেটের সীমাবদ্ধতা দেশের অর্থনৈতিক বৃদ্ধির কাঠামোর মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে। সেটা বোঝার জন্য আমরা আর এক বার রিকার্ডোর দিকে ফিরে তাকাব।

রিকার্ডোর কাছে খাজনা উপার্জনকারী শ্রেণি দুটি কারণে আপত্তিজনক। প্রথমত, খাজনা হল অনুপার্জিত আয়, সুতরাং অনৈতিক। দ্বিতীয়ত, খাজনা পুঁজিপতির মুনাফা কমিয়ে দেবে, ফলে বিনিয়োগ এবং অর্থনৈতিক বৃদ্ধি বাধা পাবে। সিন্ডিকেটের ক্ষেত্রে নৈতিকতার প্রশ্নটির একটি ভিন্ন দিক আছে, যা রিকার্ডিয়ান জমিদারদের থেকে আলাদা, কারণ এখানে খাজনার অংশ ভূমিপুত্রদের কাছে ফিরে যাচ্ছে। কিন্তু সিন্ডিকেটের প্রতিপত্তি নিয়ন্ত্রণে দ্বিতীয় প্রশ্নটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। খাজনা (বা সিন্ডিকেটের দাবিদাওয়া) বেশি বেড়ে গেলে মুনাফা কমে যাবে, ব্যবসা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। তা হলে কিন্তু সিন্ডিকেটের উপর যারা নির্ভরশীল তাদেরও ক্ষতি। তাই একটা সময়ের পরে রাষ্ট্রকে সিন্ডিকেটের মতো প্রায়-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে উদ্যোগী হতেই হয়। সিন্ডিকেটের আরও একটা বিপদ আছে, যা উনিশ শতকের পৃথিবীতে বসে রিকার্ডোর পক্ষে বোঝা সম্ভব ছিল না। বিশ্বায়নের যুগে পুঁজি অনেক বেশি গতিশীল। সিন্ডিকেটের খাজনার দাবি বেশি চড়ে গেলে পুঁজি অন্যত্র পাড়ি জমাতে পারে। সে ক্ষেত্রে আখেরে ক্ষতি সিন্ডিকেটের সংশ্লিষ্ট লোকেদেরই, এবং অবশ্যই অন্যদেরও।

তার মানে সিন্ডিকেটের মতো প্রায়-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানের আসল চ্যালেঞ্জ আসে, রাষ্ট্র নয়, পুঁজির গতিশীলতার কাছ থেকে। এই গতিশীলতা শিল্পের ধরনের ওপর নির্ভরশীল, ফলে সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যও সব শিল্পের ক্ষেত্রে সমান নয়। একটু সরলীকরণ করে বললে, যে শিল্পে পরিবহণ ব্যয় যত বেশি, সেখানে সিন্ডিকেটের দর কষাকষির ক্ষমতা তত বেশি। কারণ পরিবহণ ব্যয় যত বেশি, উৎপাদন স্থানকে সম্ভাব্য ক্রেতার কাছে নিয়ে আসা তত জরুরি। কোনও শিল্পজাত পণ্যের পরিবহণ ব্যয় বেশি হলে পুরুলিয়াতে উৎপাদন করে কলকাতায় নিয়ে আসা কঠিন, তাই কলকাতার আশেপাশেই সেই শিল্পের জমি খুঁজতে হবে। ফলে কোনও একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের, এ ক্ষেত্রে কলকাতার গুরুত্ব বেশি হবে, সেটা ওই অঞ্চলের সিন্ডিকেটের দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়িয়ে দেবে। যেমন, নির্মাণ শিল্পে উৎপাদনের স্থান আর সেই উৎপাদন ভোগের স্থান একই, অর্থাৎ বাড়িটি যেখানে তৈরি হচ্ছে সেখানেই ভোগ করতে হবে, অর্থাৎ পরিবহণ ব্যয় অসীম। এ ক্ষেত্রে সিন্ডিকেটের ক্ষমতাও বেশি হবে। অন্য দিকে, সফটওয়্যার শিল্পে পরিবহণ ব্যয় নামমাত্র, কারণ উৎপন্ন সামগ্রীকে পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে ফেলা যায় বিদ্যুৎগতিতে, প্রায় নিখরচায়। সুতরাং সিন্ডিকেটের দাপাদাপি সেখানে অনেক কম হবে। পশ্চিমবঙ্গের বড় সমস্যা হল, এখানে শিল্প বলতে নির্মাণ শিল্প। অতএব সিন্ডিকেটের প্রবল দাপট।

পুঁজি, অসাম্য, প্রায়-রাষ্ট্র

সিন্ডিকেটের মতো প্রায়-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানের উদ্ভবের পিছনে আছে পুঁজি পরিচালিত অসাম্য এবং তা দূর করতে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। আগেই বলেছি, সিন্ডিকেট এক ভাবে আয়ের পুনর্বণ্টন করে, যা রাষ্ট্র পেরে ওঠে না। কিন্তু পুনর্বণ্টনের যে কোনও পথই যে নৈতিক, তা নয়। বড়লোককে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ও আয়ের পুনর্বণ্টন, কিন্তু তা অনৈতিক। সাম্প্রতিক ঘটনাবলিও এই ধরনের প্রায়-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানের মধ্যেকার লুম্পেন প্রবণতার সাক্ষ্যবাহী, যা প্রায়শই নৈতিকতার ধার ধারে না। যখন সেই প্রবণতা বেড়ে গিয়ে শহুরে নাগরিক সমাজের কাছে অস্বস্তির বিষয় হয়ে ওঠে, রাষ্ট্র তাকে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে দেখে পুলিশ দিয়ে দমন করতে যায়। কিন্তু প্রায়-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠানের উত্থানের গভীরে আছে সামাজিক অসাম্যের সুদূরপ্রসারী অসুখ। সেটাকে সম্পূর্ণ পাশ কাটিয়ে গেলে মূল অসুখ সারানো সম্ভব হবে না। সফটওয়্যারের মতো শিল্পের প্রসার হলে এক ভাবে সিন্ডিকেট সমস্যা কমতে পারে। কিন্তু সেই শিল্প তুলনায় উচ্চশিক্ষিত কর্মী নিয়োগ করে, যা সমাজে অসাম্য বাড়িয়ে দিতে পারে। তা হলে কিন্তু প্রায়-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠান অন্য আকারে ফিরে এসে আবার সামাজিক অস্থিরতা তৈরি করবে।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE