E-Paper

কাপড় কোথায়

স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই ব্যাধি নতুন নয়: প্রবীর পুরকায়স্থ অতীতেও এক বার কারাবাস করেছেন— জরুরি অবস্থার সময়ে!

শেষ আপডেট: ২০ মে ২০২৪ ০৭:৫২
Prabir Purkayastha

—ফাইল চিত্র।

কেন্দ্রীয় শাসকদের বশংবদ নয়, বরং তাঁদের বিবিধ অপকর্মের সত্য-উদ্‌ঘাটনে তৎপর একটি সংবাদ পোর্টাল-এর প্রতিষ্ঠাতা ও প্রধান সম্পাদক প্রবীর পুরকায়স্থকে গ্রেফতার করে তাঁর বিরুদ্ধে ইউএপিএ নামক চণ্ডনীতি প্রয়োগ করে যে ভাবে তাঁকে বন্দি রাখা হয়েছিল, তার প্রক্রিয়াটিকে সরাসরি অবৈধ বলে ঘোষণা করে দেশের সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছে, তার একটি বাক্য তর্জমা করলে দাঁড়ায়: “পুরো ব্যাপারটাই যেমন চোরাগোপ্তা ভাবে সারা হয়েছিল, সেটা আইনি প্রক্রিয়াকে ধোঁকা দেওয়ার খোলাখুলি প্রয়াস ছাড়া কিছু নয়।” এই তীব্র তিরস্কারের লক্ষ্য, অবশ্যই, দিল্লি পুলিশ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন— আপাদমস্তক অধীন— দিল্লি পুলিশ। এই বাহিনীর কীর্তিকলাপ গত কয়েক বছরে যে ভয়ঙ্কর মাত্রায় পৌঁছেছে, তার পরে তার কর্তা এবং নেপথ্য-নায়কদের কাছে সুশাসন, রাজধর্ম, নৈতিকতা ইত্যাদি আশা করাও বাতুলতা। কিন্তু সামান্যতম আত্মমর্যাদার বোধ? যদি সেই সব বস্তুর ছিটেফোঁটাও এই মন্ত্রী-সান্ত্রি-কোটালদের থাকত, তা হলে সর্বোচ্চ আদালতের এমন কঠোর ভর্ৎসনার পরে তাঁরা অন্তত নতজানু হয়ে মার্জনা ভিক্ষা করতেন এবং প্রতিশ্রুতি দিতেন— রাষ্ট্রক্ষমতা এবং আইনের ছক কাজে লাগিয়ে এই বেআইনি অত্যাচার তাঁরা আর কখনও করবেন না।

কিন্তু মার্জনাভিক্ষা দূরস্থান, ন্যূনতম চক্ষুলজ্জার বোধটুকুরও কোনও চিহ্নমাত্র এই শাসককুলের আচরণে দেখা যায়নি। দেখা যায়ও না কখনও। লজ্জা নিজেও বোধ করি এমন নির্লজ্জ দুঃশাসনের সামনে মুখ লুকোতে ব্যস্ত। বস্তুত, এই একটি রায়ের মধ্য দিয়ে সারা বিশ্বের সামনে ভারতের বর্তমান রাষ্ট্রশক্তির দর্পিত অসহিষ্ণুতার বিকট মূর্তিটি আরও এক বার সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে পড়ল। সুপ্রিম কোর্ট প্রশ্ন তুলেছে, অভিযুক্তকে আদালতে পেশ করার (এবং হাজতে নেওয়ার ব্যবস্থা সম্পন্ন করার) ক্ষেত্রে এত তাড়াহুড়ো করা হল কেন? যাঁকে আটক করা হচ্ছে তাঁকে সেই গ্রেফতারির কারণটুকু অবধি না জানানোর— প্রকৃতপক্ষে চেপে রাখার— ‘কৌশল’ এতটাই ঘৃণ্য এবং কদর্য যে তার পশ্চাদ্‌বর্তী কুমতলবটি অনুমান করতে বিন্দুমাত্র বুদ্ধির দরকার হয় না। যথাযথ ভাবে আইন মেনে চলতে গেলে যদি সমালোচক বা প্রতিবাদীকে মাসের পর মাস অন্যায় ভাবে বন্দি করে রাখা না যায়, তা হলে— চুলোয় যাক আইন প্রয়োগের যথাযথ পদ্ধতি, গোল্লায় যাক নৈতিকতা, শিকেয় উঠুক গণতন্ত্র— রক্ষকরা অনায়াসে ভক্ষকের রূপ ধরবেন। এই তবে রামরাজ্যের নয়া মডেল।

সমালোচক, সত্যান্বেষী, প্রতিবাদী সংবাদমাধ্যম গণতন্ত্রের আবশ্যিক শর্ত। এবং সেই কারণেই এমন সংবাদমাধ্যমের প্রতি আধিপত্যবাদী শাসকদের মজ্জাগত বিরূপতা, বিরাগ ও বিদ্বেষ। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে এই ব্যাধি নতুন নয়: প্রবীর পুরকায়স্থ অতীতেও এক বার কারাবাস করেছেন— জরুরি অবস্থার সময়ে! আবার, দেশের নানা রাজ্যে শাসকের অসহিষ্ণুতা সাম্প্রতিক কালেও বারংবার প্রকট হয়েছে, কঠোর এবং অনৈতিক আইনের (অপ)ব্যবহার করে প্রতিবাদী সাংবাদিকের পিছনে পেয়াদা লেলিয়ে দেওয়ার অপকর্ম বর্তমান পশ্চিমবঙ্গেও মোটেই বিরল নয়। কিন্তু গত এক দশকে কেন্দ্রীয় সরকার এবং তার অধীন পুলিশ প্রশাসন যে পদ্ধতিতে এই দুরাচারকে চরমে নিয়ে গিয়েছে, তা এ দেশের ইতিহাসে অভূতপূর্ব। বিচারবিভাগ এই ব্যাধিকে যতটুকু দমন করতে পারে, ততটুকুই কি ভারতীয় গণতন্ত্রের আশা? কিন্তু কেবলমাত্র সর্বোচ্চ আদালতের উপর ভর করে একটি দেশের গণতন্ত্র সুস্থ ও সবল থাকতে পারে না। যে সমালোচক আজ আদালতের রায়ে ‘পদ্ধতিগত কারণ’-এ মুক্তি পেয়েছেন, অসহিষ্ণু শাসকরা নিজেদের অপকৌশলগুলিকে আরও উন্নত এবং আরও নিখুঁত করে কাল তাঁকে আটক করার নতুন ফন্দি আঁটবেন না, তার ভরসা কোথায়?

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Prabir Purkayastha Supreme Court of India media

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy