Advertisement
২৬ মার্চ ২০২৩
কাশ্মীরে যুদ্ধবিরতি যুদ্ধবিরতি খেলা আবারও শেষ হল

‘শান্তিকামী মানুষ’ মানে কী

যে মাসে শুজাত বুখারি বুলেটে ঝাঁঝরা হলেন, সেটাই নাকি ছিল যুদ্ধবিরতির মাস! অশান্ত, রক্তস্নাত কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ও ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ বিরতির মাস।

তাপস সিংহ
শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০১৮ ০০:১৬
Share: Save:

একটা স্বপ্নের কথা শোনাতেন শুজাত বুখারি। কাশ্মীর উপত্যকায় শান্তির স্বপ্ন। বুলেট আর আর্তনাদ চিরতরে বন্ধ হয়ে যাওয়ার স্বপ্ন। কিন্তু রমজান মাসের শেষ দিনে সেই নির্ভীক সাংবাদিককেই চিরতরে স্তব্ধ করে দিল আততায়ীর বুলেট! শান্ত, নরম স্বরে কথা বলতেন বুখারি, অথচ লেখনী ছিল তীক্ষ্ণ, ঋজু, ধারালো। কাশ্মীর উপত্যকায় শান্তি প্রতিষ্ঠার পক্ষে বরাবর সরব ছিলেন তিনি। মনে করতেন, উন্নয়ন নামধারী ডোল দেওয়ার রাজনীতি নয়, কাশ্মীর সমস্যাকে রাজনৈতিক সমস্যা হিসেবে দেখতে হবে দিল্লিকে। সেনা ও সন্ত্রাসবাদীদের বুলেট কখনওই শেষ কথা বলতে পারে না। রাষ্ট্রের নানা ভূমিকার বিরুদ্ধে সরব হওয়ার পাশাপাশি তাঁর কলম বিদ্ধ করেছে সন্ত্রাসবাদকেও। উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদী কাজকর্মকে সমর্থন করেননি তিনি। মুশকিলটা হল, এই ধরনের সাংবাদিকদের কোনও পক্ষই পছন্দ করে না। তিনি কোনও শিবিরেরই ‘নিজের লোক’ বলে পরিচিতি পান না। মনে রাখা দরকার, কাশ্মীরের মতো বিপজ্জনক জায়গায় শুজাত-ঘরানার সাংবাদিকতা করার ঝুঁকি কতটা, তা নিরাপদ দূরত্বে বসে কল্পনা করাও অসম্ভব। রাষ্ট্রশক্তির প্রকাশ্য ও গোপন নজরদারি, বিচ্ছিন্নতাবাদী ও মৌলবাদী শক্তিগুলির রক্তচক্ষু প্রদর্শন, খবর ‘খাইয়ে দেওয়া’র নানা ষড়যন্ত্র, নানা অজুহাতে হেনস্থা করা— এক কথায় প্রতি নিয়ত সরু সুতোর উপর হাঁটতে হয় শুজাতের মতো সাংবাদিকদের।

Advertisement

যে মাসে শুজাত বুখারি বুলেটে ঝাঁঝরা হলেন, সেটাই নাকি ছিল যুদ্ধবিরতির মাস! অশান্ত, রক্তস্নাত কাশ্মীর উপত্যকায় সন্ত্রাসবাদী সংগঠন ও ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে সংঘর্ষ বিরতির মাস। উপত্যকায় শান্তি ফেরানোর লক্ষ্যে সাময়িক যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবটা প্রথমে দিয়েছিলেন জম্মু-কাশ্মীরের সদ্য-প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতি। সেই প্রস্তাব অবশ্য প্রথমে পত্রপাঠ খারিজ করে দেন বিজেপি নেতৃত্ব। পরে রাজনাথ সিংহের মতো শীর্ষনেতা সংঘর্ষ-বিরতির কথা বলায় তা মান্যতা পায়। শুজাত বুখারি ছিলেন সেই সংঘর্ষ বিরতির প্রস্তাবের বড় পৃষ্ঠপোষক।

এই কারণেই ‘রাইজ়িং কাশ্মীর’-এর প্রধান সম্পাদকের এই হত্যাকাণ্ডের প্রেক্ষাপটটা এ ক্ষেত্রে একটু তলিয়ে দেখা দরকার। ২০১৬-র ৮ জুলাই নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে হিজ়বুল কমান্ডার বুরহান ওয়ানির মৃত্যুর পরে কাশ্মীর উপত্যকা যে ভাবে উত্তাল হয়ে ওঠে, তা বস্তুত ১৯৯০-এর কাশ্মীরের সঙ্গে তুলনীয়। হাজার হাজার মানুষ পথে নামেন। বিক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে উপত্যকা। গুলি-কাঁদানে গ্যাস-জলকামান-ছররা বন্দুক— কী না ব্যবহার করা হয়েছে গণবিদ্রোহ সামাল দিতে। তার পর থেকে কিন্তু যত দিন এগিয়েছে, অসংখ্য যুবক ও কিশোর জঙ্গিদের সমর্থনে রাস্তায় নেমেছে। সেনাবাহিনী কোথাও জঙ্গিদমন অভিযান চালাতে গেলে স্থানীয় মানুষ, এমনকি মহিলারাও দলে দলে বার হয়ে এসে বাহিনীকে বাধা দিচ্ছেন।

২০১৭-র ৩০ মে এই পত্রিকায় প্রকাশিত হয় মেহবুবা মুফতির সাক্ষাৎকার। সেটি নিয়েছিলেন শুজাত বুখারি। তাঁর প্রশ্ন ছিল, ‘‘সন্ত্রাসবাদের কথা বলছিলেন। এ দিকে জঙ্গিদের সমর্থন এখন সমানে বাড়ছে, হাজার হাজার লোক জঙ্গিদের সমাধি অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছে...।’’ মেহবুবার জবাব ছিল, ‘‘মানুষের ভাবনা পাল্টাচ্ছে। এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি মানুষ প্রতিবাদে যোগ দিচ্ছেন, আন্দোলনে শামিল হচ্ছেন। ভয় অনেক কমে গিয়েছে। ভাবুন ২০১০ সালের কথা, যখন আর্মি ক্যাম্পের কাছে যেতেই লোকে ভয় পেত। যে কোনও কারণেই হোক, আর্মিকে এখন আর কেউ ভয় পায় না। হিলিং টাচ নীতি যখন নেওয়া হয়েছিল, তার পর থেকেই ভয় কমেছে, পোটা (প্রিভেনশন অব টেররিজম অ্যাক্ট) তুলে নেওয়ার পর ভয় আরও কমেছে। এখনকার ছেলেমেয়েরা আগেকার সেই দমবন্ধ করা পরিবেশ দেখেনি। এরা অনেক সাহসী। আর একটা কথা। আন্দোলন আয়োজন করাটাও কিন্তু একটা বিরাট কাজ। আয়োজকরা সংখ্যায় বাড়ছে।’’ মুখ্যমন্ত্রী কাশ্মীরের জনমানসের ভাবনাচিন্তা পাল্টে যাওয়ার কথা বলেছিলেন। বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনে আগের থেকে অনেক বেশি মানুষের শামিল হওয়ার কথা বলেছিলেন। কাশ্মীরের জনতার ভয় অনেক কমে যাওয়ার কথাও বলেছিলেন।

Advertisement

কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, কেন এমন পরিস্থিতির উদ্ভব হল? তার মানে কি বিক্ষুব্ধ জনমানস আর বুলেটে ভয় পাচ্ছে না? হিংসাদীর্ণ কাশ্মীরে যে ব্যাপক হারে সামরিকীকরণ হয়েছে, তা কার্যত নজিরবিহীন। সামরিক ও আধা সামরিক বাহিনীর প্রবল উপস্থিতি ও সমরাস্ত্রের প্রদর্শনেও কেন কাশ্মীরি যুবারা পাথর হাতে পাল্টা ধেয়ে যাচ্ছেন? বুলেটের সামনে বুক পেতে দিচ্ছেন? তাঁরা কি জানেন না, উপত্যকার অজস্র তরুণ-তরুণী স্রেফ ছররা বন্দুকের (পেলেট গান) আঘাতে আজ দৃষ্টিশক্তিহীন? তাঁদের ভবিষ্যৎ কাশ্মীরের রাজনৈতিক ও গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের মতোই গভীর অনিশ্চয়তায় ভরা?

এই পরিস্থিতির মধ্যেই দাঁত-নখের প্রদর্শন আবার শুরু হয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকার জানিয়ে দিয়েছে, যুদ্ধবিরতি পর্ব শেষ। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান আবার শুরু হবে। রমজান মাস উপলক্ষে এক মাস যে অভিযান বন্ধ ছিল তা আবার শুরু হতে চলেছে। কেন? কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিংহ জানিয়েছেন, এই সিদ্ধান্তের পিছনে জঙ্গি সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ডই কারণ। অর্থাৎ, কাশ্মীরে মাসখানেক যে যুদ্ধবিরতি-যুদ্ধবিরতি খেলা চলছিল তার অবসান ঘটতে চলেছে।

খুব সঙ্গত কারণেই মেহবুবা মুফতির দল পিডিপি এই সিদ্ধান্তকে ‘দুর্ভাগ্যজনক’ বলে আখ্যা দিয়েছে। আর কংগ্রেস দাবি করেছে, কেন্দ্রীয় সরকারের ব্যর্থতার নজির হল কাশ্মীর। কংগ্রেসের দাবির কথা সবিস্তার আলোচনা অবশ্য নিতান্তই অর্থহীন। কারণ, কংগ্রেস জমানায় গোটা কাশ্মীর উপত্যকা জুড়ে শান্তির ফল্গুধারা বয়ে গিয়েছিল, এমনটাও নয়।

এই প্রসঙ্গে রাজনাথ সিংহের মন্তব্য বরং প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলছেন, কাশ্মীরের শান্তিকামী মানুষ যাতে উপযুক্ত পরিবেশে রমজান পালন করতে পারেন সে কথা ভেবেই গত ১৭ মে থেকে সেনা অভিযান বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল। এই প্রসঙ্গেই তিনি নিরাপত্তা বাহিনীর সংযমেরও ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। এই প্রশংসা হয়তো অসঙ্গতও নয়। কিন্তু, ‘শান্তিকামী’ মানুষ বলতে তিনি ঠিক কাদের কথা বলতে চাইছেন? যাঁরা সরকারকে খুব মান্যি করেন? কার্ফু জারি হলে এক বারও বাড়ির দরজা দিয়ে রাস্তায় উঁকি মারেন না? যাঁরা এক বারও নিরাপত্তা বাহিনীর দিকে পাথর তাক করেননি? না কি তাঁরা, যাঁরা কাশ্মীর নিয়ে দিল্লির রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভুদের নীতির কট্টর সমর্থক?

আর ঠিক এখানেই গণতন্ত্রের পরিসর নিয়ে প্রশ্ন জাগে। প্রশ্ন জাগে ‘আলোচনা’, ‘শান্তিপ্রয়াস’ বা ‘মধ্যস্থতা’র মতো শব্দের ব্যবহার নিয়ে। সেই প্রশ্নগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনও উপায় নেই। সন্ত্রাসবাদীদের বুলেট বা কাজকর্মের সমর্থক আমরা কেউই নই। বরং, আমরা মনে করি, একটা সুস্থ গণতান্ত্রিক কাঠামোয়, গণতান্ত্রিক আবহের মধ্যে প্রতিবাদ আন্দোলন বা বিক্ষোভ হতেই পারে। হ্যাঁ, নিরাপত্তা বাহিনীকে লক্ষ্য করে পাথর ছোড়া বা গাড়ির সামনে ঝাঁপিয়ে পড়াটা নিশ্চয়ই কাম্য নয়। কিন্তু, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মোকাবিলা যেখানে বুলেট আর ছররা বন্দুক দিয়ে হয়, সেখানে পাল্টা আন্দোলনও আগ্রাসী হতে বাধ্য। মুশকিলটা হল, কাশ্মীরি যুবাদের মনস্তত্ত্ব বোঝায় বড় ফাঁক থেকে যাচ্ছে। কাশ্মীরের মানুষের রোজের যন্ত্রণা-চাহিদা-অপমান-স্পৃহা বোঝার মানসিকতা হারিয়ে গিয়েছে! স্রেফ সেনা পাঠিয়ে আর অভিযান শুরু করার হুঙ্কার দিয়ে কি এই আন্দোলন দমন করতে পারবেন দেশের ‘৫৬ ইঞ্চি ছাতিওয়ালা চৌকিদার’?

ঠিক এই কারণেই শুজাত বুখারির মতো সংবেদনশীল ও মানবতায় বিশ্বাসী সাংবাদিক মনে করতেন, স্রেফ আইনশৃঙ্খলার সমস্যা হিসেবে না দেখে কাশ্মীরের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। মজার কথা হল, মধ্যস্থতাকারী মারফত দিল্লির শাসকরা যে কাশ্মীরের কথা শুনতে চেয়েছে, আলোচনায় বসেছে, সেখানে কোথাও কাশ্মীরের সাধারণ মানুষের প্রতিনিধিত্ব ছিল না। থাকেও না। আলোচনা হয় রাজনৈতিক দলগুলির প্রতিনিধিদের সঙ্গে, আমলাদের সঙ্গে, বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতাদের সঙ্গে। কে ঠিক করে দিল যে, এঁরাই কাশ্মীরি জনতার যথার্থ প্রতিনিধি? রাষ্ট্রই কি তা ঠিক করে দেবে?

দিল্লীশ্বর নরেন্দ্র মোদী কাশ্মীরে এসে বলেন, উপত্যকার যুবকদের কাছে দু’টি পথ আছে, হয় টুরিজ়ম নয় টেররিজ়ম। চমৎকার! এই কথা শোনার পরে উপত্যকার মানুষের কাছে দিল্লির প্রভুদের বিশ্বাসযোগ্যতা বলে আরও কিছু অবশিষ্ট থাকে কি? হাজার বার ‘গলে লাগ যা’ বললেও কাশ্মীরের মানুষ তাতে আর সাড়া দিতে পারবেন? প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ঘোষণা মতো ৮০ হাজার কোটি টাকার উন্নয়নের প্যাকেজও কি কাশ্মীরের বুকের ক্ষতে প্রাণের স্পর্শের আরাম দিতে পারে?

এখন অবশ্য আরামের কথাটাই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেল। কাশ্মীরে সরকারই ভেঙে গিয়েছে। ২০১৯ সালকে লক্ষ্য করে বিজেপি তার অভীপ্সিত পথেই এগিয়ে চলেছে। এখন শেষ কথা বলবে বন্দুক। ভারত-পাকিস্তান ট্র্যাক-টু কূটনৈতিক দৌত্য ইত্যাদি এখন ক্রমশই অবান্তর।

রণাঙ্গনে দুই পক্ষের মাঝখানটিতে দাঁড়িয়ে যেন বিবেকের ভূমিকা পালন করতেন শুজাত। শান্তি প্রক্রিয়া জারি থাকলে যাদের বিস্তর অসুবিধা, তাদের বুলেট এই সাংবাদিক ও তাঁর লেখনীকে চুপ করিয়ে দিল।

শুজাত বুখারির রক্তের ঋণ অনেক মূল্য দিয়ে চোকাতে হবে কাশ্মীরকে! দিল্লিকেও!

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ)
Follow us on: Save:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE
Popup Close
Something isn't right! Please refresh.