শতকরা একশত ভাগ নম্বর পাইয়া কেহ প্রথম হইতেছে, ইহা আশ্চর্য, একাধিক জন ওই নম্বর পাইতেছে, ইহা অত্যাশ্চর্য। আর আশ্চর্য ঘটনা একের পর এক বৎসরের পর বৎসর ঘটিয়া আসিতেছে, ইহা উদ্বেগের কারণ। ইদানীং বিভিন্ন বোর্ডের ফলাফল প্রকাশিত হইতেছে আর দেখা যাইতেছে, দলে দলে ছাত্রছাত্রী প্রায় পূর্ণ নম্বর পাইতেছে বহু বিষয়েই, কেহ ৯৬% পাইলে কপালে করাঘাত করিতেছে, কেহ ৯৪% পাইয়া নিরুদ্দেশ হইবার জোগাড় দেখিতেছে। প্রাগৈতিহাসিক কালে, ফার্স্ট ডিভিশন পাইলেই ছাত্রছাত্রীকে বাহবা দেওয়া হইত, ৭৫% অর্থাৎ স্টার পাইলে, তাহাকে তারকার ন্যায়ই মর্যাদা দেওয়া হইত। ইদানীং কেহ ৮০% পাইলে তাহা গভীর দুশ্চিন্তার কারণ বলিয়া সাব্যস্ত হয়। যে ছাত্রছাত্রীগণ অসামান্য নিষ্ঠা মনোযোগ পরিশ্রম মেধা দ্বারা দুরন্ত ফল করিতেছে, প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় হইতেছে, তাহারা অবশ্যই প্রশংসার্হ ও সমীহযোগ্য। সঙ্গত কারণেই সমাজ তাহাদের সম্পর্কে কৌতূহলী, তাহাদের প্রতি সপ্রশংস। এই সম্মান তাহারা অর্জন করিয়াছে। কিন্তু পরীক্ষার নম্বরে এই বিস্ফোরণ দেখিয়া প্রশ্ন জাগে: তবে কি সত্যই এই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ভোল পাল্টাইয়া গিয়াছে এবং সামগ্রিক ধীশক্তি লম্ফ দিয়া তুঙ্গে আরোহণ করিয়াছে? ভারতীয় তরুণ প্রজন্মের মস্তিষ্ক প্রবল সতেজ সচল সপ্রাণ হইয়া উঠিয়াছে?
বরং নিন্দুকে বলে, এমন বহু ছাত্রছাত্রী পরীক্ষায় ভাল নম্বর পাইতেছে, একটি অনুচ্ছেদ গুছাইয়া লিখিতে বলিলে যাহারা বিপদে পড়িবে। আশঙ্কা হয়, শিক্ষা বদলায় নাই, বদলাইয়াছে প্রশ্নপত্রের ধরন ও মূল্যায়নের নীতি। যেমন, ইদানীং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রশ্ন হয় ‘অবজেক্টিভ’, অর্থাৎ কেবল দুই-এক কথায় সংক্ষিপ্ত উত্তরটি দিতে পারিলেই পূর্ণ নম্বর মিলিবে। পূর্বে দেখিবার চেষ্টা হইত, ছাত্রটি প্রশ্নের উত্তরে উপনীত হইবার প্রক্রিয়াটি সম্যক জানেন কি না, তাহা সম্পর্কে তাহার বিচার ও বিশ্লেষণই বা কী। তাহার চিন্তাস্রোতটির উপর নজর দেওয়া হইত। ভাবনা-নিরপেক্ষ ভাবে, কেবল তথ্যটি জানে কি না, সেইটিকে বিদ্যার সূচক হিসাবে দেখা হইত না। কিন্তু ইদানীং, প্রায় দৈনন্দিন জীবনের দ্রুতির সহিত মিলাইয়াই যেন, বিদ্যার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গিও হইয়া পড়িয়াছে চটজলদি মূল্যায়ন-নির্ভর। তথ্য ও জ্ঞানের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। কেহ নির্ভুল জানিতেই পারে, কোন দেশ কবে কোথায় পারমাণবিক বোমা ফেলিয়াছিল, কিন্তু সেই ঘটনার বীভৎসতা ও অমানবিকতা দরদ দিয়া অনুধাবন না করিলে, ওই মুখস্থ বিদ্যা জ্ঞানের স্তরে উন্নীত হয় না, তথ্যই থাকিয়া যায়। হইতে পারে, প্রণিপাত ও পরিপ্রশ্নের দ্বারা নহে, ছাত্রেরা ইদানীং প্রতিষ্ঠানসিদ্ধ জ্ঞান সংগ্রহ করিয়া ফেলিতেছে সংক্ষিপ্ত সমাচার জানিয়াই। অবশ্যই, যে ছাত্রটি তথ্য চমৎকার মুখস্থ করিতেছে, তাহার জ্ঞান ও ভাবনার সারবত্তাও অভাবনীয় হইতেই পারে, সে একাধারে নম্বরের অাধিক্যে ও চিন্তার গভীরতায় শ্রেষ্ঠ হইতেই পারে। কিন্তু এমন বিরল ব্যতিক্রমী মননশক্তি প্রায় নিয়ম হইয়া দাঁড়াইয়াছে— তেমন কোনও লক্ষণ ভারতের সমাজজীবনে, গবেষণাক্ষেত্রে, সংস্কৃতিপ্রাঙ্গণে আদৌ দেখা যাইতেছে কি?
সর্বোপরি, যদি এমন কেহ কেহ থাকেও, তবে অন্য আরও বহু ছাত্রছাত্রীকে প্রায় তাহাদেরই সমান হিসাবে প্রতিভাত করিলে, মাত্র এক-দুই নম্বর কম দেওয়া হইলে, ব্যতিক্রমীদের প্রতি কি তাহা প্রবল অবিচার নহে? একশত যে পাইতেছে, তাহার গৌরব কী করিয়া বাড়িবে ও প্রকৃত প্রতিষ্ঠা পাইবে, যদি এক দল নিরানব্বই ও তাহার অধিক আটানব্বই নিকটেই উল্লাস করিতে থাকে? সব দিক ভাবিয়া মনে হয়, ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থা ও মূল্যায়ন-প্রক্রিয়ার তন্নিষ্ঠ আত্মসমীক্ষণ প্রয়োজন। নহিলে দীর্ঘ মেয়াদে, মিষ্টান্ন বিতরণের আবরণ ভেদ করিয়া, পল্লবগ্রাহিতা ও আস্তরণ-ওস্তাদির তিক্ত সত্য লাল দাগে দগদগ করিতে পারে!
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy