Advertisement
E-Paper

‘ন্যায়’-এর টাকা কিন্তু আছে

প্রায় ৫০ বছর আগে অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান ঋণাত্মক করের (নেগেটিভ ট্যাক্স) কথা বলেছিলেন।

শুভাশিস দে

শেষ আপডেট: ০৩ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০৪
রাহুল গাঁধী। —ফাইল চিত্র।

রাহুল গাঁধী। —ফাইল চিত্র।

ইদানীং টিভি বা খবরের কাগজ খুললেই আওয়াজ শোনা যাচ্ছে ‘চৌকিদার চোর’ বা ‘আমিও চৌকিদার’, আর আমরা তাতেই মেতে আছি। ভারতের মতো সমস্যাসঙ্কুল দেশে নির্বাচনের কি কোনও প্রকৃত আজেন্ডা নেই? অবশেষে ২৫ মার্চ কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গাঁধী ঘোষণা করলেন, ২০১৯ নির্বাচনের পর, কংগ্রেস সরকার তৈরি করলে ২০ শতাংশ দরিদ্রতম পরিবারকে (যাদের মাসিক আয় ১২০০০ টাকার কম) মাসে ৬০০০ টাকা করে, বছরে ৭২০০০ টাকার সরাসরি অর্থ সাহায্য করা হবে। প্রস্তাবিত ‘ন্যূনতম আয় যোজনা’ প্রকল্পটির নামকরণ করা হয়েছে ‘ন্যায়’, ইংরেজি অক্ষরমালা অনুসারে। নির্বাচনকে আবার ‘রোটি–কপড়া-মকান’-এর মূল আজেন্ডায় ফিরিয়ে আনার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে।

প্রায় ৫০ বছর আগে অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান ঋণাত্মক করের (নেগেটিভ ট্যাক্স) কথা বলেছিলেন। যার অর্থ, ধনীদরিদ্রনির্বিশেষে ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেবে এবং তার ভিত্তিতে চিহ্নিত ধনী ব্যক্তি রাষ্ট্রকে কর দেবে আর চিহ্নিত গরিব ব্যক্তি ন্যূনতম জীবনধারণের জন্য ‘নেগেটিভ ট্যাক্স’ দেবে অর্থাৎ রাষ্ট্রের থেকে সরাসরি টাকা পাবে। পৃথিবীর নানা দেশে গরিবি সামলানোর জন্য নানা ভাবে নেগেটিভ ট্যাক্স প্রয়োগ করা হয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার বেশ কিছু দেশে, ইরানে, এবং পরীক্ষামূলক ভাবে ফিনল্যান্ডে, নেদারল্যান্ডসে, কানাডার ওন্টারিয়ো প্রদেশে চালু আছে সরাসরি টাকা বণ্টনের প্রকল্প। ২০১৬’র ৫ জুন সুইৎজ়ারল্যান্ডে সকলের জন্য টাকা বিলির কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে কি না সেই প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন হয়, ভোটে কর্মসূচিটি নাকচ হয়ে যায়।

তৎকালীন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যমের নেতৃত্বে তৈরি অর্থনৈতিক সমীক্ষায় (২০১৬-১৭) ইউনিভার্সাল বেসিক ইনকাম-এর (ইউবিআই) কথা ছিল। হিসেব কষে দেখা গিয়েছে, ভারতের সব মানুষের ন্যূনতম আয়ের সংস্থান করতে বার্ষিক খরচ দাঁড়াবে জিডিপির প্রায় ১০ শতাংশ। দেশ ও বিদেশের প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদরা করের বোঝা না বাড়িয়ে এই অর্থ সংস্থানের পথ বাতলেছিলেন। কিন্তু সরকার এ বিষয়ে এগোয়নি। ইতিমধ্যে ‘ন্যায়’-এর প্রতিশ্রুতি এল।

প্রস্তাবিত ইউবিআইয়ের সঙ্গে ‘ন্যায়’-এর মৌলিক ফারাক হল, প্রথমটি সর্বজনীন কর্মসূচি, দ্বিতীয়টি বাছাই করা গরিবের জন্য। দেখে নেওয়া যাক, প্রথমত, এই বাছাই করা দরিদ্রতমদের জন্য ন্যূনতম আয়ের প্রকল্পে কী কী প্রস্তাব করা হয়েছে। দ্বিতীয়ত, ‘ন্যায়’-এর আর্থিক বোঝা কত, কী ভাবে এর সংস্থান সম্ভব। তৃতীয়ত, কী ভাবে এই প্রকল্পের জন্য যোগ্য গরিব খুঁজে বার করা হবে। চতুর্থত, এই প্রকল্পের সার্থক হওয়ার সম্ভাবনাই বা কতটা।

‘ন্যায়’-এর সফল রূপায়ণ হলে প্রায় ৫ কোটি পরিবারের ২৫ কোটি মানুষ এর আওতায় আসবেন। এখনকার হিসেবে মোটামুটি ভাবে ধরে নেওয়া হচ্ছে ভারতের ২০ শতাংশ দরিদ্রতম পরিবারের মাসিক আয় গড়ে ৬০০০ টাকার মতো। সুতরাং ন্যায় প্রকল্প সর্বোচ্চ আরও ৬০০০ টাকার আর্থিক সংস্থান করে, ন্যূনতম মাসিক আয় ১২০০০ টাকা সুনিশ্চিত করবে। বলা দরকার, যে পরিবারের আয় ৬০০০ টাকার বেশি (কিন্তু ১২০০০-এর নীচে), ধরা যাক ৮০০০ টাকা, তাকে মাসিক ৪০০০ টাকা দিলেও সে ১২০০০-এ পৌঁছে যাবে। অর্থাৎ, এ ভাবে দেখলে, ‘ন্যায়’ একটি ‘টপ-আপ’ প্রকল্প। সর্বাধিক ৬০০০ টাকাটাই যদি অনুদানের অঙ্ক ধরা হয়, তা হলে বার্ষিক খরচ হবে মোটামুটি ৩ লক্ষ ৬০ হাজার কোটি টাকা, যা ভারতের জাতীয় আয়ের প্রায় ২ শতাংশ।

যে প্রশ্নটা সব থেকে বেশি আলোচিত হচ্ছে তা হল, কী ভাবে এই বিপুল অর্থের সংস্থান হবে। তবে কি ধনী ও মধ্যবিত্তের করের বোঝা বাড়বে? অন্যান্য সামাজিক সুরক্ষার প্রকল্পে কাটছাঁট হবে? নতুন করে টাকা ছাপানো হবে? আমার মতে, এর কোনওটারই প্রয়োজন হবে না। বর্তমান আর্থিক পরিসরেই এর বন্দোবস্ত করা যাবে, যদি কয়েকটি ব্যবস্থা করা যায়।

১) প্রথম যে মৌচাকে ঢিল মারতে হবে তা হল ব্যাঙ্কের খেলাপি ঋণ তথা নন-পারফর্মিং অ্যাসেট। রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের তথ্য বলছে ২০১৭-১৮ আর্থিক বর্ষে না-মেটানো মোট ব্যাঙ্কঋণের পরিমাণ ছিল প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকা। গত পাঁচ বছরে এই খেলাপি ঋণের অঙ্ক জাতীয় আয়ের প্রায় ৩-৫ শতাংশের মধ্যে ছিল, যা কিনা ব্যাঙ্কের মোট প্রদত্ত ঋণের প্রায় ১০ শতাংশ। বিশ্বব্যাঙ্কের তথ্য বলছে, ২০১৭-১৮ সালের খেলাপি ঋণের পুনরুদ্ধার করলেই আগামী তিন বছরের ‘ন্যায়’ প্রকল্পের টাকার সংস্থান সম্ভব।

২) ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব পাবলিক ফিনান্স অ্যান্ড পলিসি-র হিসেব বলছে ভারতে প্রতি বছর গড়ে জিডিপি-র ১৪% খরচ হয় কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারের বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি দিতে। এই ভর্তুকির দুই–তৃতীয়াংশ, মানে জাতীয় আয়ের প্রায় ৯% খরচ হয় অপ্রয়োজনীয় (নন-মেরিট) ভর্তুকির খাতে, প্রধানত সচ্ছলতর মানুষের কল্যাণে। যেমন, কৃষি সহায়ক মূল্যের উপর ভর্তুকির একটা বিরাট অংশ পায় সম্পন্ন কৃষক। তা ছাড়া, কিছু কিছু কোম্পানিকে ট্যাক্স হলিডের সুযোগ দিতেই গড়ে জাতীয় আয়ের ৬% হারে কেন্দ্রীয় রাজস্বের ক্ষতি হয়। যেমন কিছু রফতানিকারক কোম্পানিকে আমদানি-করা কাঁচামালের উপর বহিঃশুল্ক হ্রাস বা সম্পূর্ণ ভাবে ছাড় দেওয়া। অর্থনীতিবিদ প্রণব বর্ধন কেন্দ্রের ইচ্ছাকৃত রাজস্ব ত্যাগের (রেভিনিউ ফোরগন) হিসেব দেখিয়েছেন প্রায় জাতীয় আয়ের ৩ শতাংশ।

৩) মোদী–জেটলির মতে, তাঁদের যুগলবন্দিতে রাজস্ব ঘাটতি স্বস্তিকর জায়গায় আছে, যদিও রঘুরাম রাজনের মতো বিশেষজ্ঞ এ বিষয়ে সংশয়ী। কিন্তু সরকারি দাবি মেনে নিলেও, বার্ষিক হারে জাতীয় আয় বৃদ্ধির ৭% ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ১.২% মাথায় রেখে বলা যায়, ভবিষ্যতে মাথাপিছু জাতীয় আয় বৃদ্ধির অঙ্ক ৫.৮ শতাংশের কাছাকাছি থাকবে। অর্থাৎ অতিরিক্ত প্রায় ১০ লক্ষ কোটি টাকার (২০১১-১২’র স্থির মূল্যের নিরিখে) সংস্থান হবে। সুতরাং ‘ন্যায়’ প্রকল্পের টাকা জোগাড় করতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়।

ব্রিটেনে ওয়ারিক ইউনিভার্সিটিতে অর্থনীতির শিক্ষক

Nyay Congress BJP Rahul Gandhi
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy