Advertisement
১১ মে ২০২৪

কলসের কানা

অনেকেই বলিতেছে, আইন ভাঙিয়া, হঠকারিতা করিতে গিয়া এই মৃত্যু, ইহাকে গৌরবান্বিত করিবার কিছু নাই। এই প্রশ্নও উঠিতেছে, জনজাতির সদস্যেরা তাহাদের মতো রহিয়াছে, তাহাদের হয়তো নিজস্ব প্রথা বা সংস্কৃতি রহিয়াছে, অকস্মাৎ বাহির হইতে ধর্ম চাপাইয়া দিয়া তাহাদের অধিক সুখী বা সভ্য করিয়া তুলিবার প্রবণতাটি আদৌ সমর্থনযোগ্য কি?

শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

জন অ্যালেন চাও ধর্ম প্রচার করিতে গিয়াছিলেন অজানা দ্বীপে অচেনা মানুষের নিকট। শরবিদ্ধ হইয়া মারা গিয়াছেন। শেষ নোটে লিখিয়াছিলেন, ঈশ্বর আমি মরিতে চাহি না, কিন্তু ঈশ্বর সেই নোট পড়েন নাই, বা পড়িলেও মর্যাদা রাখেন নাই। যে জনজাতি যুগের পর যুগ বহির্বিশ্বের সহিত কোনও রূপ সংস্রব রাখিতে উৎসাহী নয়, কেহ যাইলেই আক্রমণ করে, যে জনজাতি সম্পর্কে ভারত সরকার আইন করিয়া দিয়াছেন— তাহাদের ঘাঁটাইবার অধিকার কাহারও নাই, তাহাদের সহিত আলাপ করিতে যাওয়ার বাসনা কেন? জন বাঁচিয়া থাকিলে হয়তো বলিতেন, সেই জন্যই। বাধা যত দুস্তর, তাহা অতিক্রম করিতেই ততই তৃপ্তি। বহু দুঃসাহসী অভিযাত্রী এই ভাবেই বিশ্বজয়ে বাহির হইয়াছেন ও জয়ধ্বজা উড়াইয়া চিরস্মরণীয় হইয়া রহিয়াছেন। কিন্তু বর্তমান যুগ কিঞ্চিৎ অধিক নিষ্ঠুর। অনেকেই বলিতেছে, আইন ভাঙিয়া, হঠকারিতা করিতে গিয়া এই মৃত্যু, ইহাকে গৌরবান্বিত করিবার কিছু নাই। এই প্রশ্নও উঠিতেছে, জনজাতির সদস্যেরা তাহাদের মতো রহিয়াছে, তাহাদের হয়তো নিজস্ব প্রথা বা সংস্কৃতি রহিয়াছে, অকস্মাৎ বাহির হইতে ধর্ম চাপাইয়া দিয়া তাহাদের অধিক সুখী বা সভ্য করিয়া তুলিবার প্রবণতাটি আদৌ সমর্থনযোগ্য কি? তাহাদের সহিত এক অন্য ধর্মের আলাপ করাইতে যাইবার মধ্যে এক প্রকার আধিপত্যবাদ প্রকাশিত হয়, তাহাদের মধ্যে নিজের ধর্ম প্রচার করিয়া, তাহাদের নিজ ধর্মের দলে টানিয়া, নিজ ধর্মটিকে শ্রেষ্ঠত্বের বেদিতে উত্তোলন করিবার তাগিদ বিকিরিত হয়। এই অহেতুক উচ্চম্মন্যতা পরিহার্য। কিন্তু তাহা হইলে তো সকল নূতন ধর্মপ্রচারককেই দোষ দিতে হয়, তাঁহারা কোনও না কোনও প্রচলিত ধর্মের তুলনায় নিজ ধর্মকে শ্রেয় মনে করিয়াছেন ও সেই কথা উচ্চৈঃস্বরে বলিয়াছেন। যে মানুষটি আফ্রিকায় চলিয়া যাইলেন নির্ভীকচিত্তে খ্রিস্টান ধর্ম প্রচারার্থে, যে ভদ্রলোক ভারত হইতে তিব্বত চলিয়া যাইলেন বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য, তাঁহারা কি এই পরম বিশ্বাসেই অগ্রসর হন নাই যে এই কর্ম এতই মহৎ যে তাহার জন্য নিজ জীবন উৎসর্গ করা যাইতে পারে? অজানা ও অচেনা সম্পর্কে সকল জড়তা দূর করিয়া তাহাদের মধ্যে ঝাঁপাইয়া পড়িয়াই কি মনুষ্যজাতি সকল উন্নতি লাভ করে নাই? বিশ্ব জুড়িয়া খাদ্যাভ্যাস, সংস্কৃতি, ভাষার আদানপ্রদান কি এই প্রবণতা হইতেই উৎসারিত হয় নাই? হয়তো অচেনারা কলসের কানা মারিবে, তবু প্রেম বিলাইব— ইহাই কি বিশ্বভ্রাতৃত্বের সূচনাবিন্দু নহে?

এক মার্কিন সংগঠন প্রশ্ন তুলিয়াছে, জনজাতির যাহারা এই মানুষটিকে হত্যা করিল, তাহাদের হত্যাকারী হিসাবে বিচার হইবে না কেন? একটি দেশ তাহার একটি জনজাতিকে যদি যোগাযোগের যোগ্য বলিয়া না-ও মনে করে, যোগাযোগ করিতে অন্যকে নিষেধও করে, তবু তাহারা কাহাকেও মারিয়া ফেলিলে তাহারা দণ্ডের অতীত হয় কোন নীতিতে? এমন আইন যদি কেহ করেও যে, এই ব্যক্তি বা এই জাতি কাহাকেও হত্যা করিতে পারে, সেই আইনকে তো প্রশ্ন করিবার অধিকার সকলেরই রহিয়াছে। যে ভারতীয়রা সোশ্যাল মিডিয়ায় সাড়ম্বরে লিখিতেছে যে ভারতীয় জনজাতিকে পাশ্চাত্যের ধর্মে দীক্ষিত করিবার প্রয়াসকে সমুচিত জবাব দেওয়া হইয়াছে, তাহারা কেন লিখিতেছে না, এক শান্তিপ্রিয় বিদেশিকে হত্যা করিবার জন্য এই ভারতীয় জনজাতিকে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তি দিবার চেষ্টা হউক? ইহা তো সত্য, জন ওই দ্বীপে গিয়াছিলেন বাইবেল, ফুটবল, মাছ ধরিবার জাল ও কিছু মাছ লইয়া, গান গাহিয়া জনজাতির মানুষদের কাছে ডাকিতে চাহিয়াছিলেন, তাহারা শর নিক্ষেপ করিয়া তাহার উত্তর দিয়াছে। এই প্রকারের উত্তরদানকে তো সভ্যতায় আমরা মন্দ বলিয়াই ভাবিতে শিখিয়াছি। একটি জনজাতিকে সংরক্ষণ করিবার তাগিদ হইতে কি তাহাদের সভ্যতার সকল অনুশাসনের বাহিরে রাখা সঙ্গত? উত্তরে বলা যাইতে পারে, জনজাতিটি তো এই সভ্যতার অন্তর্গত হইবার কোনও আকাঙ্ক্ষাই প্রকাশ করে নাই, অপছন্দও জানাইয়াছে, তাহা হইলে অনিচ্ছুককে জোর করিয়া বহির্বিশ্বের প্রণীত নীতির অংশী করিবার অধিকার কাহারও আছে কি? প্রশ্নগুলি অতিক্রম করিয়া, জনের ডায়েরিতে লিখিত ‘‘আমি মরিয়া যাইলে ইহাদের দোষ দিয়ো না’’ বাক্যটি ভাস্বর হইয়া থাকে। হয়তো ঈশ্বরের চক্ষে ওই বাক্যটিই সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ মনে হইয়াছিল। তিনিও তো আমাদের ‘সভ্য’ ধারণাবলির অনুগামী হইতে বাধ্য নহেন।

যৎকিঞ্চিৎ

সুইডেনে অনেকেই নিজের হাতে একটা মাইক্রোচিপ ঢুকিয়ে নিচ্ছেন, যাতে দোকানে কেনাকাটা করার পর আর কার্ড দিতে না হয়, দরজাও চাবি দিয়ে খুলতে না হয়, হাতটা এক বার ঘোরালেই কাজ হয়ে যাবে। মোবাইল ফোন তো এখনই ব্যবহারকারীর আঙুল বা চোখের মণি বুঝে খুলে যাচ্ছে। অর্থাৎ ভবিষ্যতে ‘পিন’ও মনে রাখতে হবে না, পকেটে কিছু বইতেও হবে না। মানিব্যাগ চুরির ভয়ও রইল না। তবে ডাকাতরা তখন হাত বা আঙুল বা চোখের মণি কেটে নিয়ে যাবে, এই যা দুঃখু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Andaman Islands Sentinalese Tribal American tourist
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE