Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪
অলীক কুনাট্য বঙ্গে

নাটক যত জমছে, ভারতীয় গণতন্ত্রের আর্তনাদ তীব্রতর হচ্ছে

ঘটনা গড়াল দ্রুত। প্রথমে সিবিআই অফিসারদের নিয়ে যাওয়া হল স্থানীয় থানায়। আটক করা হল। রাজ্যপালের হস্তক্ষেপের পর তাঁরা ছাড়া পেলেন। দেশ জুড়ে বিরোধী নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে টুইট করলেন। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, রাজীব কুমার রাজ্যের সর্বকালের অন্যতম সেরা ও সাহসী অফিসার।

রোচনা মজুমদার
শেষ আপডেট: ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে অলীক কুনাট্য চলছে। হয়তো আরও চলবে। সেন্ট্রাল বুরো অব ইনভেস্টিগেশন-এর (সিবিআই) এক দল অফিসার, সংখ্যায় নাকি ৪০ জন, ‘কোনও খবর ছাড়াই’ হাজির হলেন কলকাতার পুলিশ কমিশনার রাজীব কুমারের বাড়িতে। সারদা কাণ্ডে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য কলকাতা পুলিশের শীর্ষকর্তাকে ডেকে পাঠিয়েছিল সিবিআই। রবিবার সন্ধ্যায় একাধিক সংবাদমাধ্যমে শুনলাম, রাজীব কুমার যে শুধু সিবিআইয়ের ডাক উপেক্ষা করেছেন, তা-ই নয়, তাঁর নাকি সন্ধানই পাওয়া যাচ্ছে না। রঙ্গ আরও জমল, যখন শোনা গেল, বেপাত্তা নগরপালকে নাকি বইমেলায় দেখেছেন অনেকেই।

ঘটনা গড়াল দ্রুত। প্রথমে সিবিআই অফিসারদের নিয়ে যাওয়া হল স্থানীয় থানায়। আটক করা হল। রাজ্যপালের হস্তক্ষেপের পর তাঁরা ছাড়া পেলেন। দেশ জুড়ে বিরোধী নেতারা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনে টুইট করলেন। মুখ্যমন্ত্রী বললেন, রাজীব কুমার রাজ্যের সর্বকালের অন্যতম সেরা ও সাহসী অফিসার। তার পর বললেন, রাজীব গোটা দুনিয়ার সেরা অফিসার! রাজ্য বিজেপির মুখপাত্র রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি করলেন। তাঁদের মতে, পশ্চিমবঙ্গে যে রাজনৈতিক বিপর্যয় চলছে, রাজীব কুমারের কুনাট্য তার শেষতম উদাহরণমাত্র। এই তর্জায় যে দিকেই থাকুন না কেন, একটা কথা মানতেই হবে— ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে এটা এক বিরল মুহূর্ত। যুক্তরাষ্ট্রীয়তায় মস্ত ধাক্কা লাগল। ভবিষ্যতের বিশেষজ্ঞরা সাংবিধানিক সঙ্কটের নজির দিতে নিশ্চয়ই এই ঘটনার কথা উল্লেখ করবেন।

যে নাটক চলছে, তার থেকে বলিউডি সিনেমার চিত্রনাট্য লেখা যেতে পারে বিলক্ষণ। গোড়ায় পরিষ্কার করে নেওয়া যাক, বিবাদের মূল চরিত্রটি কী। দেশের সর্বোচ্চ তদন্তকারী সংস্থার সঙ্গে সংঘাত এক রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত বাহিনীর, আর সেই সংঘাতের কেন্দ্রে শহরের সর্বোচ্চ পুলিশকর্তা। কেন্দ্রের স্বৈরাচারী ও বিদ্বেষপূর্ণ নীতির বিরুদ্ধে ধর্নায় বসেছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। শোনা যাচ্ছে, পুলিশবাহিনীর বিরুদ্ধে সিবিআইয়ের তদন্ত যাতে না হয়, কলকাতা পুলিশ তার জন্য কলকাতা হাইকোর্ট থেকে আগাম নির্দেশ নিয়ে রেখেছে। শোনা যাচ্ছে, রাজীব কুমারের বাড়ির দোরগোড়ায় সিবিআই পৌঁছে যাওয়ার আসল উদ্দেশ্য অন্য— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও তৃণমূল কংগ্রেসকে জনসমক্ষে হয়রান করা। পরিণতি, পশ্চিমবঙ্গ পরিণত হয়েছে নির্বিকল্প রণাঙ্গনে। এক দিকে প্রধানমন্ত্রী, তাঁর দোসর অমিত শাহ আর বিজেপির বেশ কিছু বড় মাপের নেতা-মন্ত্রীর দিকে যথেচ্ছ কাদা ছোড়া হচ্ছে; আর অন্য দিকে তাঁরাও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে স্বৈরাচারী অপশাসনের অভিযোগে কাঠগড়ায় তুলছেন। এই আক্রমণের পিছনে যে বিজেপি নেতাদের হতাশা বড় বেশি প্রকট, তা বোঝার জন্য খুব রাজনৈতিক প্রজ্ঞার প্রয়োজন নেই। দীর্ঘ দিন ধরেই এই রাজ্যে তাঁরা বহুবিধ বাধার মুখোমুখি হচ্ছেন। অমিত শাহ আর যোগী আদিত্যনাথের হেলিকপ্টার নামানোর অনুমতিও দেয়নি রাজ্য প্রশাসন। অন্য দিকে, তৃণমূল নেতারাও অভিযোগ করছেন, বিজেপি এই রাজ্যে একটি সাংবিধানিক অভ্যুত্থান ঘটানোর চেষ্টা করছে। এই রাজ্যে ৪২টি লোকসভা আসন। ভোটযুদ্ধ যত কাছে আসছে, বিজেপি আর তৃণমূল, উভয় পক্ষই আস্তিন গোটাচ্ছে, সুর চড়াচ্ছে।

এই রাজনৈতিক নাটকের তাৎপর্য একাধিক। প্রথমত, যে ভাবে দেশের হরেক প্রতিষ্ঠানের মেরুদণ্ড ভেঙে গিয়েছে, তাতে শুধু পশ্চিমবঙ্গ নয়, গোটা দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। রবিবারের ঘটনায় বহু রাজনৈতিক নেতার প্রতিক্রিয়াতেই স্পষ্ট, তাঁরা এই ঘটনাক্রমকে গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ হিসেবে দেখছেন। তদন্তকারী সংস্থা হিসেবে সিবিআইয়ের বিশ্বাসযোগ্যতা বেশ কিছু দিন ধরেই প্রশ্নের

মুখে পড়ছে। রবিবার স্পষ্ট হয়ে গেল, রাজনৈতিক অঙ্গুলিনির্দেশে দেশের শীর্ষ তদন্তকারী সংস্থা

আর এক রাজ্যের পুলিশবাহিনী পরস্পরের ওপর চড়াও হতে পারে। আমলাতন্ত্র যখন রাজনীতির চাপের কাছে এ ভাবে নতিস্বীকার করে,

যখন আইনবিভাগ আর শাসনবিভাগের মধ্যে সীমারেখাটি সম্পূর্ণ মুছে যায়, তখন সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয় গণতন্ত্রেরই।

দ্বিতীয়ত, এই ঘটনা দেশের বিচারবিভাগের ওপর প্রভূত চাপ সৃষ্টি করল। সিবিআই আদালতের দ্বারস্থ হয়েছে— পশ্চিমবঙ্গ সরকার যে ভাবে তাদের কাজে বাধা সৃষ্টি করছে, তার থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য। ভারতীয় বিচারব্যবস্থা সত্যিই কতখানি স্বাধীন, গত কয়েক মাসে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বলেই চোখে পড়েছে। দেশের মানুষ আরও এক বার শীর্ষ আদালতের দিকে তাকিয়ে থাকবেন, এই অচলাবস্থায় আদালত কোন অবস্থান নেয়, সেটা দেখার জন্য।

তৃতীয়ত, এই রাজনৈতিক বিবাদে যে ভাবে লিঙ্গের প্রশ্নটি উঠে এসেছে, সে দিকে না তাকালেই নয়। ভারতের সংবাদমাধ্যমের একটা অংশ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে রগচটা, আবেগপ্রবণ, খ্যাপাটে নেত্রী হিসেবেই দেখিয়ে এসেছে। বস্তুত, দেশের শাসকদলের মুখপাত্ররাও এই ভঙ্গিতেই তাঁর বর্ণনা দেন। তাঁর পরিচিতি হিসেবে তৈরি করে দেওয়া হয়েছে একটি ভাবমূর্তি— তিনি আপাদমস্তক সুবিধাবাদী, দায়িত্বজ্ঞানহীন, সংখ্যালঘু তোষণ করতে গিয়ে গোটা রাজ্যটাকেই তাদের হাতে তুলে দিয়েছেন। টেলিভিশনের তর্কে বা অন্যান্য আলোচনাসভায় আমরা তাঁর তথাকথিত সংখ্যালঘু তোষণের কথা শুনি, রাজ্যের উন্নয়নহীনতার কথা শুনি, তাঁর দলের অন্তহীন দুর্নীতির কথা শুনি। লাটিয়েন্স-এর দিল্লি থেকে তাঁর দূরত্ব দুস্তর। তাঁর ইংরেজি ভাঙাচোরা— তা নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে মশকরার অন্ত নেই।

যে কোনও উদ্ভট কবিতাই চালিয়ে দেওয়া হয় তাঁর নামে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে দুটো চেহারায় দেখানো হয়ে থাকে— হয় তিনি নিতান্ত ভাঁড়, নয়তো উন্মত্ত স্বেচ্ছাচারী। গত কাল শোনা গেল, বিজেপির কিছু নেতা তাঁকে ‘তাড়কা রাক্ষসী’ বলে অভিহিত করছেন!

রাহুল গাঁধীর সঙ্গে যেমন সেঁটে গিয়েছে অনপনেয় ‘পাপ্পু’ পরিচয়— অপরিণতমনস্ক, কাঁচা রাজনীতিক— মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেও তেমনই আবেগতাড়িত, কাণ্ডজ্ঞানহীন আর বদরাগী এক মানুষ হিসেবে দেগে দেওয়া হয়েছে। তেমন মানুষ, শুধু মেয়েদের পক্ষেই যেমনটা হওয়া সম্ভব। এই প্রচারটা অকারণ নয়। আসলে, এই ভাবে তাঁর একটা ভাবমূর্তি তৈরি করা গিয়েছে যে তাঁর পক্ষে দক্ষ প্রশাসক হওয়া অসম্ভব। যেন, এত দিনের সব নির্বাচনী জয় ম্যাজিকে সম্ভব হয়েছে। অন্য দিকে, নরেন্দ্র মোদী হলেন শান্ত, প্রাজ্ঞ নেতা— যাঁর ব্যক্তিত্বের ভারেই নাকি ভারত জগৎসভার শ্রেষ্ঠ আসনের নাগাল পেয়ে যাবে। খেয়াল রাখা ভাল, লাটিয়েন্স-এর দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদীও বহিরাগত— বছরের গোড়ায় এক বিরল টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে নিজেই সেই কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন তিনি। কিন্তু, তাঁর ক্ষেত্রে বহিরাগত হওয়ায় কোনও ক্ষতি নেই— তিনিই ভারতকে নিয়ে যাবেন বিকাশের অলৌকিক ভোরে। যদিও, প্রসঙ্গত, গত ৪৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেকারত্বের হার তাঁর আমলেই দেখা গিয়েছে, এই খবরটা বিকাশপুরুষের ভাবমূর্তিতে খানিক হলেও ধাক্কা দিয়েছে, সন্দেহ নেই।

নরেন্দ্র মোদীর এই আগ্রাসী পৌরুষের বিপ্রতীপে প্রতিস্পর্ধী অবস্থানে দাঁড়িয়েছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধৈর্য, আবেগতাড়িত রাজনীতি। রাজীব কুমারকে কেন্দ্র করে যে বিস্ফোরণ হল, তাতে স্পষ্ট— পৌরুষের অহমিকা জোরালো ধাক্কা খেয়েছে। তবে, দুঃখের কথা হল, গল্পটা এখানেই ফুরিয়ে যায় না। এই কুনাট্যের পারদ যত চড়ছে, ভারতীয় গণতন্ত্রের আর্তনাদও ততই তীব্র হচ্ছে।

শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে সাউথ এশিয়ান ল্যাঙ্গোয়েজেস অ্যান্ড সিভিলাইজ়েশন, সিনেমা অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ়-এর শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sit-in Protest TMC CBI Rajeev Kumar
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE