সে দিন টেলিভিশনের পর্দায় ভারতীয় জনতা পার্টির নেতার উদাত্ত ঘোষণা, ‘আমরা ঘোড়া কেনাবেচা করি না।’ শুনেই জানতে ইচ্ছে করল, আজকাল কি তবে হাতির লেনদেন চলছে? অমনি নিজেকে তিরস্কার করলাম— বাজে রসিকতায় সময় নষ্ট না করে জ্ঞান অর্জনে মন দেওয়া উচিত। অতঃপর গুগল-সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে দু’একখানা নুড়ি কুড়োনোর চেষ্টা। এবং যেটুকু যা পাওয়া গেল, তাতেই বেশ পণ্ডিতম্মন্য বোধ করা। এই তো জীবন।
এত প্রাণী থাকতে ঘোড়া কেনাবেচা কেন? কথাটা এল কোথা থেকে? এক কথায়, আমেরিকা থেকে। ব্যাপারটা হল, ঘোড়ার বাজার বেশ গোলমেলে, ন্যায্য দাম ঠিকঠাক যাচাই করা মোটেই সহজ নয়। সুতরাং সেখানে নানা রকম কারচুপি চলত। সেই সূত্রেই উনিশ শতকের শেষের দিকে লেনদেনের দুর্নীতি বোঝাতে হর্স ট্রেডিং কথাটা প্রচলিত হয়। এবং, কী ছিল বিধাতার মনে, ক্রমে সেই প্রসারিত অর্থটি বিশেষ করে কায়েম হল রাজনীতির দুনিয়ায়— এক দলের রাজনীতিককে আর এক দলের কিনে নেওয়ার মহান বাণিজ্যটির নাম হল ঘোড়া কেনাবেচা। অনেক দিন আগে দক্ষিণ ভারতের এক রসিক মানুষ লিখেছিলেন, এই তুলনায় ঘোড়াদের অপমানিত বোধ করার সঙ্গত কারণ আছে। কিন্তু সবার উপরে মানুষ সত্য, ঘোড়ার মুখের কথা কে আর শুনছে!
তবে কথাটা জনপ্রিয় হওয়ার পিছনে একটি বইয়ের বিশেষ অবদান। বইটির নাম ডেভিড হ্যারম। ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত সে বইয়ের লেখক এডওয়ার্ড নোইজ় ওয়েস্টকট। নিউ ইয়র্ক প্রদেশের সিরাকিউস-এর ব্যাঙ্কার ছিলেন তিনি। ডেভিড হ্যারম তাঁর উপন্যাসের নায়ক, সে নিজেও ব্যাঙ্কার, তার পাশাপাশি ঘোড়া কেনাবেচাও করে। সেই ব্যবসার কারচুপি নিয়ে তার কোনও অস্বস্তি নেই, বরং সে মনে করে প্রতিযোগিতার বাজারে সবই চলতে পারে। এই অভিমতের সপক্ষে সে একটা লাগসই নীতিও বানিয়ে নিয়েছে, ধর্ম ও দর্শনের মহান উপদেশকে সামান্য পরিমার্জন করে সে বলে, ‘‘অন্যে তোমার সঙ্গে যা করতে চায়, তুমিও তার সঙ্গে সেটা করো, এবং চটপট করে ফেলো।’’ মানে, অন্যেরা তোমাকে ঠকানোর ফিকির খুঁজছে, সুতরাং তুমিও বসে থেকো না, ঝাঁপিয়ে পড়ো। অর্জুনের প্রতি কৃষ্ণের উপদেশ মনে পড়লে বিস্ময়ের কিছু নেই, প্রেমে রণে এবং ব্যবসায় সব চলতা হ্যায়।
ওয়েস্টকটের দুর্ভাগ্য, তাঁর বইয়ের সাফল্য তিনি দেখে যেতে পারেননি। একের পর এক প্রকাশক তাঁর পাণ্ডুলিপি প্রত্যাখ্যান করেন— প্রকাশকরা যা করেই থাকেন। শেষে যখন শিকে ছেঁড়ে এবং ডেভিড হ্যারম প্রকাশিত হয়, তত দিনে লেখক বিদায় নিয়েছেন। তবে এক দিক থেকে এ বইয়ের জন্মলগ্নটি ছিল মোক্ষম। সেটা মার্কিন দুনিয়ায় এক মাহেন্দ্রক্ষণ। পরের যুগের ইতিহাসবিদরা উনিশ শতকের শেষ তিন দশকের নাম দেন ‘গিল্ডেড এজ’, গিল্টি-করা যুগ। সেই পর্বে মার্কিন অর্থনীতি খুব জোরে দৌড়চ্ছে, ব্যবসাবাণিজ্যের দারুণ প্রসার হচ্ছে, আবার সামাজিক বৈষম্যও লাফিয়ে বাড়ছে, ফলে কুবেরের বিষয়-আশয়ের সমালোচনাও করছেন অনেকেই। সব যুগে সব দেশেই এই খুঁত-ধরা লোকেদের নিয়ে খুব মুশকিল, তাঁরা বাইরের চকচকে ব্যাপারস্যাপার দেখে ভোলেন না, গিল্টির পিছনে কী আছে সেটাও তাঁদের জানা চাই, আর তা-ই নিয়ে হইচই করা চাই। তাঁদের অভিযোগ, ব্যবসা বাড়ছে বটে, কিন্তু ন্যায়নীতি মেনে বাড়ছে না, ব্যবসায়ীরা অনেক কিছু করছেন যা ঠিক নয়, ন্যায্য নয়। এমন পরিস্থিতিতে ডেভিড হ্যারমের অমৃতবাণী হিট করবে, সে আর বিচিত্র কী? তার যুক্তি একেবারে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মতো চাঁচাছোলা: যে কোনও ব্যবসা মানেই আসলে ঘোড়া কেনাবেচা, বোকা বনে যাওয়ার আগে বোকা বানিয়ে দাও, এটাই একমাত্র নীতি।
ডেভিড হ্যারমকে কে আর মনে রেখেছে? এডওয়ার্ড ওয়েস্টকটও বিস্মৃত। কিন্তু ঘোড়া কেনাবেচার মার নেই। মার নেই সেই মহাদর্শনেরও। মানতেই হবে, কর্নাটকে এ বার সেই বাণিজ্য আপাতত মার খেয়েছে। সময়ের অভাবেই হোক, সুপ্রিম কোর্টের ভয়েই হোক, রাহুল গাঁধী ও তাঁর সেনাবাহিনীর কেরামতিতেই হোক, কংগ্রেস-জেডিএস বিধায়কদের ঘোড়ার হাটে আনা যায়নি। কিন্তু এক জ্যৈষ্ঠে শঙ্কা যায় না— ডেভিড হ্যারমের নীতিবাক্য কি এত সহজে তার মহিমা হারাবে? পরাক্রমী অমিত শাহ দুঃখ করে বলেছেন, পনেরোটা দিন হাতে পেলে ঘুরে যেত ছবিটা। কী করে? বিধায়করা নিজের নিজের জায়গায় গেলেই বুঝতে পারতেন, কংগ্রেস-জেডিএস জোট কতটাই ‘অপবিত্র’! শাহজির বড় দুঃখ— কংগ্রেস-জেডিএস বিধায়কদের রাহুল গাঁধী হোটেলে বন্দি করে রেখেছেন, এক বার তাঁরা ছাড়া পেলেই...! ছোটবেলায় একটা খেলা ছিল। কুমিরডাঙা।
একশো কুড়ি বছর আগেকার মার্কিন দুনিয়ার ব্যবসায়ী-লেখকের পবিত্র-অপবিত্রের বালাই ছিল না। লাভের কড়ি ঘরে তোলার জন্য যা করার, ওঁরা বুক ফুলিয়ে করতেন এবং জোর গলায় বলতেন— ‘সব্বাই করে বলে সব্বাই করে তাই।’ আমাদের নেতারাও ও রকম স্বচ্ছ হলে বেশ হত। রাজনীতির বাজারটাকে নয়ন ভরে দেখে ধন্য হতাম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy