Advertisement
০২ মে ২০২৪

ইভিএম-কে ভরসার কারণ নেই

একটি রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হয়, যখন তা তার সরকারকে নীতিগত মান্যতা দেয়। এই মান্যতা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে ভোট দেওয়ার মধ্য দিয়ে। শুধু তা-ই নয়, সেই ভোটটা গোপন রাখার মধ্য দিয়েও এই মান্যতা রক্ষিত হয়।

সুমন সেনগুপ্ত
শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৯ ০০:০০
Share: Save:

ইভিএম নিয়ে আলোচনা ফিরে ফিরে আসছে। বহু রাজনৈতিক দল ইভিএম বাতিলের দাবি তুলছে। যদিও এই মূহূর্তে ইভিএম কাজ না করা আর ইভিএমকে প্রভাবিত করার মধ্যে যে সূক্ষ্ম তফাত, তা নিয়ে আলোচনা বেশি চোখে পড়ে না, তবে নাগরিক পরিসরে কান পাতলে কিছু জরুরি প্রশ্ন কানে আসবেই।

একটি রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক হয়, যখন তা তার সরকারকে নীতিগত মান্যতা দেয়। এই মান্যতা দেওয়ার প্রক্রিয়ায় জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটে ভোট দেওয়ার মধ্য দিয়ে। শুধু তা-ই নয়, সেই ভোটটা গোপন রাখার মধ্য দিয়েও এই মান্যতা রক্ষিত হয়। সুতরাং প্রথমত এই ভোটকে গুনতে হবে ঠিক ভাবে; দ্বিতীয়ত, তার গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে। স্বচ্ছতা, যথাযথতা ও গোপনীয়তা: নির্বাচনের প্রধান তিন স্তম্ভ। ইভিএম সম্পর্কে আলোচনা করার অর্থ এর পক্ষে বা বিপক্ষে থাকা নয়, নির্বাচনী প্রক্রিয়াতে ইভিএম ব্যবহার দ্বারা এই তিনটি বিষয়কে মাথায় রাখা হচ্ছে কি না, সেটা নির্ধারণ করার চেষ্টা।

এই মুহূর্তে এ দেশের ইভিএম তিনটি বিষয়েই উত্তীর্ণ হতে ব্যর্থ। জার্মানির সাংবিধানিক আদালত ২০০৯ সালে এক রায়ে এই কথাগুলোই বলেছিল। ফলত, তারা কাগজের‍ ব্যালটে ফেরত গিয়েছে। একই কারণে প্রযুক্তিগত ভাবে অগ্রসর নেদারল্যান্ডস বা আয়ার্ল্যান্ডের মতো দেশও ইভিএম বাতিল করেছে।

মুশকিল হল, ইভিএম স্বচ্ছ এবং ঠিক কি না, ভোটারের পক্ষে তা জানা কঠিন। কোনও ভোটারই নিজের ভোট দেখতে পান না, ঠিক ভাবে তা পড়ল কি না, তা বুঝতেও পারেন না। তাঁর হাতে থাকে একটাই উপায়। মোট ক‍ত ভোট পড়ল, তার একটা হিসেব করা। ঠিক এই কারণেই ভোটার ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেল (ভিভিপ্যাট) মেশিন ভারতে চালু করা হয়। কিন্তু তা দিয়েও সমস্যার পুরো সমাধান হয় না। কারণ এই মুহূর্তে আমাদের নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় সমস্ত ভিভিপ্যাট নথি গোনা হয় না। যদি এ রকম করা যেত যে কোনও নির্বাচনে একটা ইভিএমে গন্ডগোল হলে সমস্ত ভিভিপ্যাট নথি হাতে গোনা হবে, তা হলে বিষয়টা মানা যেত। সে নিয়ম যখন নেই, ইভিএম-কে সন্দেহের ঊর্ধ্বে রাখা যায় কি?

আসা যাক গোপনীয়তার প্রশ্নে। পেপার ‍ব্যালটের যুগে গণনার সময়ে সমস্ত ব্যালট আগে মিশিয়ে দেওয়া হত। ফলে বোঝা যেত না কোন অঞ্চলের মানুষ কোন প্রার্থীকে বা কোন দলকে ভোট দিয়েছে। ফলে নির্বাচন-উত্তর হিংসা থেকেও বাঁচার উপায় থাকত। দ্বিতীয়ত, মানুষ সরকারি সুবিধা পেয়ে বা না পেয়ে সরকারি দলকে ভোট দিয়েছে বা দেয়নি, সেটা বোঝার সম্ভাবনা কমত। ফলে ভোটারকে লক্ষ্যবস্তু বানিয়ে প্রচারের প্রবণতাটা থেকে বিরত করা যেত রাজনৈতিক দলগুলোকে।

এই মুহূর্তে ভারতে ৯,২৭,৫৩৩টি পোলিং বুথ আছে, প্রতিটি বুথে গড়ে প্রায় ৮০০ ভোট, বিজেপি সারা দেশে প্রত্যেকটি বুথের জন্য হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ তৈরি করার চেষ্টা করছে, প্রত্যেকটিতে ২৫৬ জন করে সদস্য। ২০১৪ সালে ভারতে প্রায় ২১ শতাংশ মানুষ স্মার্ট ফোন ব্যবহার করতেন, ২০১৯ সালে অনুপাতটা প্রায় ৩৯ শতাংশে পৌঁছেছে। যদি হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপের মাধ্যমে মেসেজ পাঠানো যায়, তা হলে সেটা কত জনের কাছে যেতে পারে? বিজেপির এক নেতা বলেই ফেলেছেন, এ বারের নির্বাচন হতে চলেছে ‘হোয়াটসঅ্যাপ ভোট’। এই গ্রুপগুলোতে সবচেয়ে বেশি ঘৃণা ও বিদ্বেষমূলক মেসেজ ছড়ানো হয়। রোজ যদি একই মিথ্যে আপনার কাছে আসে, আপনিও হয়তো সেগুলো বিশ্বাস করতে শুরু করেন। ২০১৭ সালে উত্তরপ্রদেশের ভোটে জাত ও ধর্মের নানান গ্রুপের মেসেজের ফলে বিজেপি বিপুল জয় লাভ করেছিল।

ইভিএমে নির্বাচন হলে সময় ও পয়সা, দুই-ই লাগে কম। কিন্তু একই সঙ্গে মানতে হবে যে, জরুরি তিনটি বিষয়কে প্রাধান্য দিতে ইভিএম ব্যর্থ। এই পদ্ধতির কারণে ছাপ্পা ভোট এবং ব্যালট বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা কমে গিয়েছে বটে, কিন্তু এও সত্যি যে, ইভিএমের মাইক্রোচিপ দিয়ে যে ভোট হয় তাকে বিশ্বাস করা ছাড়া গতি থাকে না। কোন সফটওয়্যারে এই মেশিন চলছে, তা-ও জানা থাকে না। ইভিএমকে ইচ্ছেমতো কাজ করানো (‘ম্যানিপুলেট’ করা) যায়, সেটা প্রমাণ করা কঠিন বলেই তো তাকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে বলে দেওয়া যায় না। ইভিএমের বদলে পেপার ব্যালটে ফিরে যাওয়ার পক্ষে যুক্তি হিসেবে এই সন্দেহটুকুই যথেষ্ট। ভারতের নির্বাচন কমিশনের মতে, ভারতের ইভিএম সম্পূর্ণ অন্য রকমের মেশিন, এই মেশিনের সঙ্গে কোনও ইন্টারনেট সংযোগ করা নেই। আর প্রধানমন্ত্রী ‘মন কি বাত’ অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের প্রশংসা করছেন। ব্যবস্থা ভালই। কিন্তু ভোটারদের ভরসা তাতে ফেরত আসছে কি? গত পাঁচটি রাজ্যের নির্বাচনে মেশিনের সুরক্ষা নিয়ে সন্দেহ ব্যক্ত হয়েছে। নির্বাচন কমিশন কি নির্বাচন পদ্ধতির স্বচ্ছতা দিয়ে ভারতীয় গণতন্ত্রকে সন্দেহের ঊর্ধ্বে প্রতিষ্ঠা করতে পারছে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE