Advertisement
E-Paper

বড়দিন: শান্তিনিকেতনে খ্রিস্ট উৎসব

আজ থেকে একশো আট বছর আগে পৌষ উৎসবে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আদি সমাজীয় উপাসনা ছাড়া বিশ্বমানবের বিচিত্র কর্মধারা, আদর্শ, জীবনবোধ ও সাধনা নিয়ে প্রথম খ্রিস্ট উৎসবের সূচনা করেন। সেই থেকে মানবপুত্রের স্মরণে চলছে শান্তিনিকেতনের খ্রিস্ট উৎসব। লিখছেন স্বপনকুমার ঘোষ। আজ থেকে একশো আট বছর আগে পৌষ উৎসবে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আদি সমাজীয় উপাসনা ছাড়া বিশ্বমানবের বিচিত্র কর্মধারা, আদর্শ, জীবনবোধ ও সাধনা নিয়ে প্রথম খ্রিস্ট উৎসবের সূচনা করেন। সেই থেকে মানবপুত্রের স্মরণে চলছে শান্তিনিকেতনের খ্রিস্ট উৎসব। লিখছেন স্বপনকুমার ঘোষ।

শেষ আপডেট: ২৫ ডিসেম্বর ২০১৮ ০২:২০
আলোয়-আলোয়: খ্রিস্ট উৎসবে সেজেছে উপাসনা গৃহ। ফাইল চিত্র

আলোয়-আলোয়: খ্রিস্ট উৎসবে সেজেছে উপাসনা গৃহ। ফাইল চিত্র

বছর (ইংরেজি) যখন ফুরিয়ে আসে, হিমেল হাওয়ায় পাতা ঝরতে থাকে, ঠিক তখনই নবীন সাজে সেজে ওঠে পৌষমেলা। ৭ পৌষ রাঙামাটির রৌদ্রছায়ায় ঢল নামে মানুষের। অসীম বৈচিত্র্য নিয়ে আজও প্রাণবন্ত হয়ে আছে পৌষমেলা। শীতের কনকনে হাওয়া উপেক্ষা করে সারা দেশের নানা পথ এসে মিলে যায় ‘সব পেয়েছির দেশ’ শান্তিনিকেতনে, পৌষের মহামিলন মেলায়।

১৯০৫ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রয়াণের পর থেকেই তাঁর কনিষ্ঠ পুত্র রবীন্দ্রনাথ আশ্রমের প্রাণপুরুষ হয়ে ওঠেন এবং প্রধান রূপকারও। সেই সঙ্গে তিনি পৌষমেলারও প্রেরণার উৎস। কবি এই সময় থেকেই শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয়ের কর্মধারায় নানা পরিবর্তন সাধন করেছিলেন। সেই সঙ্গে আশ্রমে কিছু নতুন উৎসব-অনুষ্ঠানের প্রবর্তন করেন। কবি তাঁর চিন্তাভাবনার মধ্যে দিয়ে রূপান্তর ঘটিয়েছিলেন পৌষমেলার। এই রকম এক নতুনত্বের অভিলাষ থেকেই শান্তিনিকেতনে খ্রিস্ট উৎসবের সূচনা। সেটি পৌষ উৎসবের অঙ্গীভূত— ঔপনিষদিক ও খ্রিস্টীয় ভাবনার সামঞ্জস্য বিধানে বিন্যস্ত।

আজ থেকে একশো আট বছর আগে, ১৯১০ সালের পৌষ উৎসবে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে আদি সমাজীয় উপাসনা ছাড়া বিশ্বমানবের বিচিত্র কর্মধারা, আদর্শ, জীবনবোধ ও সাধনা নিয়ে প্রথম খ্রিস্ট উৎসবের সূচনা করেন। সেই থেকে মানবপুত্রের স্মরণে চলছে শান্তিনিকেতনের খ্রিস্ট উৎসব।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছেলেবেলায় খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বী বিভিন্ন মানুষজনের সঙ্গে মেলামেশা করতেন। এই আন্তরিক মেলামেশা ও যোগাযোগের সুযোগের ফলে কবি পরবর্তীকালে যিশু খ্রিস্টের উজ্জ্বল জীবন ও খ্রিস্টধর্মের প্রতি গভীর ভাবে শ্রদ্ধাশীল হয়ে উঠেছিলেন। আমরা জানি যে, এক জন ইউরোপীয় মিশনারির বাড়িতে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অল্প বয়সে শ্রীকণ্ঠ সিংহের সঙ্গে প্রায়ই যেতেন। সেন্ট জেভিয়ার্স স্কুলে পড়াকালীন একজন খ্রিস্টান ধর্মযাজক অধ্যাপক ফাদার ডি. পেনেরান্ডার সান্নিধ্য, সাহচর্য ও প্রভাব কবির জীবনে বিশেষ ভাবে ছায়া ফেলেছিল। এই অভিজ্ঞতার বর্ণনা দেখতে পাই তাঁর লেখা জীবনস্মৃতি বইটিতে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘তাঁহাকে দেখিলেই মনে হইত, তিনি সর্বদাই আপনার মধ্যে যেন একটি দেবোপাসনা বহন করিতেছেন.... আজও তাহা স্মরণ করিলে আমি যেন নিঃস্তব্ধ দেবমন্দিরের মধ্যে প্রবেশ করিবার অধিকার পাই।’’

রবীন্দ্রনাথের কাছে যিশু হয়ে উঠেছিলেন ‘মানবপুত্র’, ‘মহাত্মা’, ‘পরম মানব’, ‘কল্যাণের দূত’ এবং সেবা পরায়ণ প্রেমের দীক্ষাগুরু। যিশুর সত্য, ন্যায় ও মানবকল্যাণের উজ্জ্বল জীবনাদর্শ কবির কাছে বরণীয় হয়ে উঠেছিল বহুকাল ধরে। সে কারণে ন্যায়নিষ্ঠ, সত্য, প্রেম, অহিংসা ও মানবতার কথা উল্লেখ করতে গিয়ে তিনি বার বার স্মরণ করেছেন যিশু খ্রিস্টকে। রবীন্দ্রনাথের কাছে যিশু খ্রিস্ট ছিলেন আর্তপীড়িত মানুষের মুক্তিদাতা।

মহাপুরুষদের চরিত্র ও উপদেশ ভাল ভাবে জানার ও বোঝার জন্য তাঁদের জন্মদিন বা মৃত্যুদিনে আশ্রমে নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল। বুদ্ধদেব, চৈতন্যদেব, কবীর, হজরত মহম্মদ, গুরুনানক প্রমুখ মহাপুরুষদের স্মরণে অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। সে পর্বে আশ্রমে প্রথম খ্রিস্ট উৎসব অনুষ্ঠিত হল।

দেশব্যাপী বড়দিনের একটা চর্যারীতি আছে। শান্তিনিকেতনের খ্রিস্ট উৎসব ধর্মীয়তার মোড়ক ছিন্ন করে। সম্প্রদায়ের বন্ধন ঘুচিয়ে হয়ে ওঠে স্বতন্ত্র উদ্‌যাপনের দিন। ১৯১০ সালের পৌষ উৎসবে রবীন্দ্রনাথ প্রথম খ্রিস্ট উৎসবের উপাসনা পরিচালনা করেন। অজিতকুমার চক্রবর্তী খ্রিস্ট নামে একটি বই লেখেন। এই বইটিতে কবি তাঁর লেখা ছোট ভূমিকায় যিশুর জীবনের মূল কথাটি তুলে ধরেছিলেন। ‘বড়োদিন’ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘‘আজ পরিতাপ করার দিন, আনন্দ করবার নয়। ... বড়োদিন নিজেকে পরীক্ষা করবার দিন, নিজেকে নম্র করবার দিন।’’ পরিতাপ, আত্মপরীক্ষা ও নম্রতার এই বোধে খ্রিস্টীয় ও ভারতীয় বোধের আশ্চর্য সম্মিলন ঘটেছে।

ভারতবর্ষের বাইরে বিদেশের মাটিতে থাকলেও পৌষ উৎসব ও খ্রিস্ট উৎসবের জন্য কবির মন নিবিড় ভাবে আচ্ছন্ন হয়ে থাকত। খ্রিস্ট উৎসব প্রসঙ্গে এমনই এক দৃষ্টান্ত দেখতে পাই ১৯১২ সালের বড়দিনে, আমেরিকার ইলিনয় থেকে হেমলতা দেবীকে লেখা এক চিঠিতে। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, ‘‘আজ খৃস্টমাস। এইমাত্র ভোরের বেলা আমরা আমাদের খৃস্টোৎসব সমাধা করে উঠেছি। রথী, বৌমা শিকাগোতে গেছেন। কেবল বত্মিক, সোমেন্দ্র এবং আমি এখানে আছি। আমরা তিনজনে আমাদের শোবার ঘরে একটি কোণে আমাদের উৎসব করলুম। কিছু অভাব বোধ হল না। উৎসবের যিনি দেবতা তিনি যদি আসন গ্রহণ করেন তাহলে কোনও আয়োজনের ত্রুটি চোখে পরেই না। তাঁকে আজ আমরা প্রণাম করেছি, তাঁর আশীর্বাদ আমরা গ্রহণ করেছি।’’

তিন দিন ব্যাপী পৌষ উৎসবের শেষ আনন্দের দিন খ্রিস্ট উৎসব। শীতের সন্ধ্যায় শান্তিনিকেতনের মন্দিরে জ্বলে ঝাড় লণ্ঠনের সারি। উপাসনাগৃহের মেঝে নানা রঙের আলপনায় সুসজ্জিত। মন্দিরের চারদিক মোমের আলোয় আলোকিত হয়ে ওঠে। সব মিলিয়ে এনে দেয় এক অপূর্ব স্নিগ্ধতা। খ্রিস্ট উৎসবের উপাসনায় মহামানবের প্রতি অন্তরের গভীর শ্রদ্ধা জানাতে সকলে এসে সমবেত হন মন্দিরের ভাবগম্ভীর পরিবেশে।

মোমের আলোয় মুখরিত ‘ক্রিসমাস ক্যারোল’-সহ একেবারে শান্তিনিকেতনের প্রথা ও রীতিনীতি অনুযায়ী উদ্‌যাপিত হয় খ্রিস্ট উৎসব। উচ্চারিত হয় উপনিষদের মন্ত্র। রবীন্দ্রনাথের গান ‘একদিন যারা মেরেছিল তারে গিয়ে’ গাওয়া হয়। আর পাঠ করা হয় কবির লেখা থেকে। পড়ে শোনানো হয় বাইবেলের অংশবিশেষ। ছাত্রছাত্রীরা সমবেত কণ্ঠে গান পরিবেশন করেন। খ্রিস্ট উৎসবের উপাসনা শেষে মন্দিরের সামনে বৈতালিক দল ধীরে ধীরে সমবেত হন। হাতে মোমবাতি নিয়ে সীমাহীন আকাশে অজস্র তারার ভিড়ে গান গাইতে গাইতে যান মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের তপস্যাপূত ধ্যানবেদী আলোকমালায় সজ্জিত ছাতিমতলায়। গানের সুর ভেসে আসে— ‘মোর হৃদয়ের গোপন বিজন ঘরে প্রিয়তম হে জাগো জাগো।’

যিশুকে আমাদের হৃদয়ের মধ্যে জাগিয়ে তোলার প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে প্রতিবারই শেষ হয় খ্রিস্ট উৎসব। ধীরে ধীরে কোনও এক সময় এই মিলনমেলা ভেঙে যায়। কিন্তু সকলের মনেই পৌষমেলা ও খ্রিস্টোৎসব উজ্জ্বল বিভা নিয়ে জেগে থাকে। তারই সঙ্গে দেশ-বিদেশের হাজারো মানুষের কাছে অগ্রিম পাঠিয়ে দেয় আগামী মহামেলার নিমন্ত্রণ।

লেখক প্রবীণ আশ্রমিক ও প্রাবন্ধিক

(মতামত ব্যক্তিগত)

Christmas festival Shantiniketan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy