Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

রথ, বিপত্তারিণী থেকে পুজোর দিন গোনা শুরু

রথযাত্রার পরে শুক্লা দশমীর মধ্যে মঙ্গল ও শনিবার— এই দুই দিন বিপত্তারিণী পুজো পালিত হয়ে থাকে। বিপত্তারিণী দেবীকে ‘দেবী দুর্গা’-র অপর রূপ মনে করা হয়ে আসছে। লিখছেন শ্রীকান্ত বসুরথযাত্রার পরে শুক্লা দশমীর মধ্যে মঙ্গল ও শনিবার— এই দুই দিন বিপত্তারিণী পুজো পালিত হয়ে থাকে। বিপত্তারিণী দেবীকে ‘দেবী দুর্গা’-র অপর রূপ মনে করা হয়ে আসছে। লিখছেন শ্রীকান্ত বসু

বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দিরে বিপত্তারিণীর পুজো দিতে ভিড়। ফাইল ছবি

বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দিরে বিপত্তারিণীর পুজো দিতে ভিড়। ফাইল ছবি

শেষ আপডেট: ০৬ জুলাই ২০১৯ ০৬:১৬
Share: Save:

আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে রথযাত্রা পালিত হয়। অনেক বনেদি বাড়িতে এ দিন দুর্গাপ্রতিমার কাঠামোয় মাটি পড়ে, পুজো পাঠ হয়। দেবীপক্ষের আগমনের ধ্বনি যেন এই সময় থেকেই শুনতে পাওয়া যায়। আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল রথ ও উল্টোরথের মাঝের দু’দিন বিপত্তারিণী ব্রত পালিত হয়ে থাকে।
এই বিষয়টিকে অনেকে ‘ভগবান বিষ্ণুর বিশ্রামের সময় ভক্তের শক্তি আরাধনা’ বলেও অভিহিত করে থাকেন। রথযাত্রা যদি জীবনের গতির প্রতীক হয় তা হলে বিপত্তারিণী ব্রত সেই গতিকে নিষ্কণ্টক রাখার চেষ্টা। অষ্টাদশ শতকে বর্ধমানের মহারাজ কীর্তিচাঁদ লক্ষ্মীনারায়ণজি মন্দিরে রুপোর রথ তৈরি করে তা প্রতিষ্ঠা করেন। সেই রথ আজও টানা হয়। এ ছাড়া বর্ধমান শহরের রথতলায় দু’টি বড় কাঠের তৈরি রথ নির্মাণ করা হয়। একটি ‘রাজার’ ও অন্যটি ‘রানির রথ’ বলে পরিচিত। দু’টির নাম শ্যামসুন্দর ও লক্ষ্মীনারায়ণ। রথের রশিতে রাজ বংশধরদের কেউ ধরে টান দিলে তার পরে হাতি এং জনসাধারণ তা টানত। তখনও জাঁকজমক করে মেলা বসত। রাজপরিবারের গুরুত্ব অবশ্য বর্তমানে কমেছে। বর্ধমান ছাড়াও রায়না থানার শ্যামসুন্দরে বৈষ্ণব ভাবাপন্ন ধনী বিশালক্ষ্য বসু বিশ শতকের প্রথমে রথযাত্রা আরম্ভ করেন। এটি এই অঞ্চলের একমাত্র রথযাত্রা হওয়ায় প্রচুর মানুষ ভিড় জমান। জমজমাট মেলা বসে, চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও।
পূর্ব বর্ধমানের অম্বিকা-কালনায় রাজা কীর্তিচাঁদ প্রতিষ্ঠিত জগন্নাথ মন্দিরেও রথ টানা হয়ে থাকে। প্রতীকী হিসেবে এই রথটিকে সাত দিন ভিন্ন স্থানে রাখা হয়ে থাকে। কাটোয়ার গৌরাঙ্গবাড়িতেও রথযাত্রা উপলক্ষে রথ টানা হয়। শ্রীচৈতন্য এখানে সন্ন্যাস গ্রহণের পরে নীলাচলে গমন করলে তাঁর স্মৃতিতে রথযাত্রা আরম্ভ হয়েছিল। বর্ধমানের কামালপুরে রথযাত্রা উপলক্ষে লক্ষ্মী-জনার্দন মন্দিরে সকাল থেকে পুজো পাঠ চলে।
রথযাত্রার পরে শুক্লা দশমীর মধ্যে মঙ্গল ও শনিবার এই দুই দিন বিপত্তারিণী পুজো পালিত হয়ে থাকে। বিপত্তারিণী দেবীকে জনমানসে ‘দেবী দুর্গা’-র অপর রূপ মনে করা হয়ে আসছে। এর কারণ হিসেবে অনেকে বলে থাকেন, সমুদ্র মন্থনের সময় মহাদেব হলাহল পান করার পরে দেবী দুর্গা তাঁকে স্তন্যপান করিয়ে রক্ষা করেছিলেন বলেই জনমানসে ‘দেবী বিপত্তারিণী’ নামে পরিচিতা। তবে এ কথার উল্লেখ কোনও শাস্ত্রে পাওয়া যায় না। সেই কারণে অনেকে অনুমান করেন, প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সমাজ থেকে এই পুজোর কাহিনিটি বর্তমানে প্রবেশ করেছে।
এই পুজো সম্পর্কে একটি প্রচলিত কাহিনি রয়েছে। সেই কাহিনি অনুসারে এক হিন্দু রানির গোমাংস দেখার ইচ্ছা হয়েছিল। সে কথা তিনি তাঁর সখী চর্মকার পত্নীকে জানালে তিনি তা সংগ্রহ করে এনে দেন। রানির এ ইচ্ছার কথা সমাজের সকলে জেনে যায়। রাজার কানে কথাটি পৌঁছতে তিনি ভয়ানক রেগে গেলেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি সরেজমিনে তদন্ত করার নির্দেশ দিলে রানি বিপদ থেকে উদ্ধার পেতে বিপত্তারিণীর স্তব শুরু করলেন। রাজা এলেন এবং দেখলেন পুজোর জন্য সর্বত্র ফলমূল ও পুষ্প রয়েছে। তিনি কোথাও গোমাংসের সন্ধান পেলেন না। রক্ষা পেলেন রানি এবং তাঁর চর্মকার সখী। দেবীর প্রসাদ লাভ করে তিনি ধুমধাম করে বিপত্তারিণী ব্রত ও পুজো সম্পন্ন করলেন।
এই ব্রতে চালের তৈরি ১৩টি পিঠে, ১৩টি পান, সুপারি ও ১৩টি ফলের দরকার হয়। লাল সুতোর ১৩টি গিঁট দিয়ে তাতে দুর্বা ঘাস বেঁধে হাতে ধারণ করার রীতি আমাদের সমাজে প্রচলিত রয়েছে। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে, দুর্বা ঘাস হল রাহু গ্রহের প্রতিষেধক। অশুভ সংখ্যা ১৩ থেকে রক্ষা পেতে এই ১৩টি দ্রব্যের সমাহারে দেবীর বন্দনার রীতি প্রচলিত রয়েছে। কথিত রয়েছে, মা যশোদাও নাকি কৃষ্ণকে বিপদ থেকে রক্ষা করতে ছেলেবেলায় তার হাতে তাগা বাঁধতেন। সার্বিক বাঙালি সমাজ এই ব্রতটিকে আপন করে নিয়েছে।
মঙ্গল ও শনিবারকে সাধারণত মানুষ ‘খরবার’ বা ‘উগ্রবার’ বলে থাকেন। এই দিনগুলিতেই দেবীকে প্রসন্ন করার জন্য তাঁর পুজো করা হয়ে থাকে। সমালোচকদের একাংশ বলেন শনি ও মঙ্গল এই দুই গ্রহকে সন্তুষ্ট করতেই সপ্তাহের এই দু’টি দিনে বিপত্তারিণী পুজোর আয়োজন করা হয়। এই ব্রতটি গ্রাম বাংলার নানা স্থানে ব্যাপক ভাবে প্রচার লাভ করেছিল। বর্ধমানের সর্বমঙ্গলা মন্দিরে কাকভোর থেকে বহু মহিলা এসে ভিড় জমান পুজো দেওয়ার জন্য। পূর্ব বর্ধমানে দামোদরের তীরে জামালপুরে বিপত্তারিণী দেবীর পুজোর জন্য একটি পৃথক মন্দির রয়েছে। সেখানেও অনেকে আসেন। পরিবারের সদস্যদের মঙ্গল কামনা করে সকাল থেকে উপোস করে লালপাড় সাদা শাড়ি পরে পুজো দিতে আসেন মহিলারা। বাড়ি ফিরে সকলের মাথায় মঙ্গল পুষ্প ছুঁইয়ে দুর্বা-সহ ডোর বেঁধে তবে তাঁদের ব্রত সম্পূর্ণ হয়। তার পরে নিয়ম মেনে সামান্য প্রসাদ ও জল খেতে পারেন তাঁরা। অনেকে মনে করেন, রথযাত্রা ও বিপত্তারিণী ব্রত বাঙালির শারদ বন্দনার নান্দীমুখ। এই সময় থেকেই শুরু হয়ে যায় দুর্গাপুজোর আর কতদিন বাকি তা গোনার পালা।

বর্ধমানের সাহিত্য ও সংস্কৃতি কর্মী

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Puja Temple
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE